যাদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৪৬
১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য বেদনাবিধুর একটি দিন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে এনে রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করেছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত-বিকৃত লাশ এই দুই বদ্ধভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল। কারো কারো মৃতদেহ শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। যদিও মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই এই নিধনযজ্ঞ চলেছিল। অনেকের লাশ পাওয়াও যায়নি। তবে ১৪ ডিসেম্বরের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করেই প্রতিবছর এই দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রায়েরবাজার ও মিরপুর বদ্ধভূমিতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। বাঙালি জাতি নয় মাসের অসম সাহসী এক যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলো। পাকিস্তানিরা পরাজয় নিশ্চিত জেনেই বাঙালির ওপর চরম প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলো। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে নিঃস্ব করার জন্যই— বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে বধ করা হয়েছিলো। স্বাধীন হলেও বাঙালি যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, মেধা ও মনন চর্চায় এগিয়ে যেতে না পারে, সেটাই ছিলো পাকিস্তানিদের লক্ষ্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে বিজয় অর্জন পর্যন্ত শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ মুক্তচিন্তার অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিলো। তাদের কয়েক জনের নাম: গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবুল খায়ের, রাশিদুল হাসান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, সন্তোষ ভট্টাচার্য, এম মুর্তজা, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা.শামসুদ্দিন, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, আনম গোলাম মুস্তফা, আলতাফ মাহমুদ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রনদা প্রসাদ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, নূতন চন্দ্র সিংহ, মেহেরুন্নেসা, নজমুল হক সরকার, ডা.আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী, ডা. আাসাদুল হক, মীর আব্দুল কাইউম, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড.হাবিবুর রহমান। এছাড়াও আরও অনেককে হত্যা করা হয়েছিলো। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও জহির রায়হান খুন হয়েছেন ওই ঘাতকদের হাতে। সর্বশেষ খবর হলো, ১ হাজার ২২২ জনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এদের নামের তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দ্রুত প্রকাশ করা হলে সবাই তাদের সম্পর্কে জানতে পারবে।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নাম জানা যায়। তালিকা প্রস্তুত করতে সহযোগিতা করা ছাড়াও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। এ বি এম খালেক মজুমদার, মাওলানা আব্দুল মান্নান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল কাদের মোল্লাসহ আরও অনেকেই প্রত্যক্ষ হত্যাকারীর ভূমিকায় থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের শাসন-শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির ধারাবাহিক যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার পেছনে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিলো বুদ্ধিজীবীদের। রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরির বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরির উপাদান-উপকরণ সংগ্রহ-সরবরাহ করতেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ সমাজের চিন্তাশীল প্রাগ্রসর মানুষেরা। গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক-অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটনে বড় ভূমিকা পালন করেছেন শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, পহেলা বৈশাখ পালন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি জাতি-মানস গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিলো। রাজনৈতিক আন্দোলনের সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরালো ভূমিকা পালন করায় পাকিস্তানি শাসকদের রাগ-ক্ষোভ ছিলো বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে। তাই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানিদের টার্গেট।
আমরা আমাদের শত্রু-মিত্র চিনতে অনেক সময় ভুল করি। শত্রুদের প্রতি দরদ দেখাই। নানা সম্পর্কসূত্র আমাদের দুর্বল করে। আমরা ভুল করি এবং চরম খেসারত দিয়ে তারপর অনুশোচনা করি। কিন্তু আমাদের শত্রু পক্ষ ভুল করে না। পাকিস্তানিরা ঠিকই তাদের শত্রু চিহ্নিত করেছিলো এবং তাদের নিষ্ঠুরভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় করেছিলো। ওরা কারো বয়স, শিক্ষা, মর্যাদা, সম্মান, খ্যাতি, দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি কিছুই বিবেচনা করেনি। নারী-পুরুষ সব কিছু তুচ্ছ বিবেচনা করে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে এবং নির্দয় যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদসহ বাছাই করে সব কৃতী মানুষদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে তারা পৈশাচিক উল্লাস করেছে। তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হয়েছেন পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মানবসেবায় ব্রতী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ। বাদ যাননি অজাতশত্রু আত্মভোলা দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। নয় মাস ধরেই একদিকে যেমন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং বেপরোয়া ধর্ষণ চলেছে, অন্যদিকে তেমনি চলেছে বেছে বেছে কৃতবিদ্য মানুষদের হত্যা। পরাজয়ের আগ-মুহূর্তে তারা দলে দলে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গেছে বদ্ধভূমিতে।
অনেক চেষ্টা করেও তারা যখন পরাজয় এড়ানো অসম্ভব মনে করেছে তখন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বুদ্ধিজীবীদের পাইকারীভাবে হত্যা করেছে। যাদের হত্যা করা হয়েছিলো তাদের অনেকেরই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিলো না, কেউ কেউ অত্যন্ত নিরুপদ্রব জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু বাঙালি হওয়ার অপরাধেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। তারা বেঁচে থাকলে তাদের মেধা ও কর্ম দিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন– এই আশঙ্কা থেকেই তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে।
আমরা এটা জানি যে— একটি জাতির মনন গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বেধে দেওয়া ছাঁচে। সব লড়াকু মানুষের লড়াইয়ের পথ ও কৌশল এক হয় না। কেউ লড়াই করেন অস্ত্র হাতে, কেউ গান করে, কেউ কবিতা লিখে, কেউ ছবি এঁকে, কেউবা খেলার মাঠে নৈপুণ্য দেখিয়ে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার যোগ ফল সফলতা তথা যুদ্ধ জয়। সবার রক্তের সিঁড়ি বেয়েই আমরা উড়াতে পেরেছি স্বাধীনতার পতাকা । পেয়েছি একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড এবং জাতীয় সঙ্গীত- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা ও অপমানের বিষয় এটাই যে, আমরা একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে প্রকৃত অর্থে পরাভূত করতে পারিনি । আমরা বিজয়-আনন্দে মত্ত হলে তারা ঘাপটি মেরে থাকে, আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা আবার ফণা তোলে। দেশে আজ যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নতুন করে ফণা তুলছে, এটা কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? তারা জীবন দিয়েছিলেন এমন একটি মুক্ত স্বদেশের জন্য যেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর সুযোগ কারো পাওয়ার কথা নয়। অথচ আজ দেশের উল্টো যাত্রা আমরা মেনে নিচ্ছি নানা কুযুক্তিতে। আমরা পুনর্বাসিত করছি আমাদের শত্রুদের। ক্রমাগত পিছু হটছি নিজেরা। অনেক বিলম্বে হলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ঘাতক-দালালদের কয়েকজনকে চরম দণ্ড দিতে সক্ষম হলেও এখনও তাদের আস্ফালন বন্ধ হয়নি। তাদের কয়েকজন দেশের বাইরে পালিয়ে আছে। দেশের মধ্যেও আছে কারো কারো অবাধ বিচরণ। ক্ষমতার রাজনীতির সংকীর্ণ নানা হিসাব-নিকাশে, সমীকরণে এখনও কেউ কেউ পাচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা আবেগপ্রবণ হই, আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করি। কিন্তু আত্মদানকারী শহীদদের কাছ থেকে আমরা সাহসী হওয়ার প্রেরণা কি পাই? যারা অকুতোভয়ে মরণ শঙ্কারে চরণে দলে গেছেন তাদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে তখনই, যখন আমরা প্রিয় স্বদেশকে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমতাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবো।
শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক