বুদ্ধিজীবী দিবস ও প্রজন্মের দায়
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৩৮
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস পরিকল্পিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পাকিস্তানের এদেশীয় দোসর আল-বদরের সহায়তায় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করে। পরবর্তীতে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের নির্মম হত্যা করা হয়। এ দু’টি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত। যেখানে আমাদের সোনালী সন্তানরা শায়িত।
যে স্বপ্ন, আশা ও মূল্যবোধ নিয়ে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এএনএম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভীনরা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। সেই মূল্যবোধের কতটুকু আমরা অর্জন করতে পেরেছি, চেতনা ধারণ করতে পেরেছি, তা আজ প্রশ্নে উদ্রেক করে।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সাক্ষী রেখে ইতিহাস বিকৃতিকে রুখে দেওয়া আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে শপথ আমরা প্রতিবছর নেই, বধ্যভূমিতে অঞ্জলি অর্পণের মধ্য দিয়ে তার কতটুকু আমরা তরুণ প্রজন্ম ধারণ করি? নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলা কিংবা সঠিক ইতিহাসের চর্চায় আমাদের অবস্থান থেকে আমরা কতটুকু সজাগ, সেই হিসেব আজ নিজেদেরই করতে হবে। কারণ তরুণ প্রজন্মই পারে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিতে। সেজন্যই নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক চেতনা ও মূলবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হবে কেন্দ্র থেকে প্রান্তিকে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, প্রস্তুতির আহবান করেছিলেন, সেই বার্তাটি তৃণমূলে, দুর্গমে পৌঁছাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তরুণরা। এই তরুণরাই দেশের মানুষের মধ্যে আশা জাগানিয়া পরিবেশ তৈরি করে। মানুষের মধ্যে উদ্দীপনার পরিবেশ তৈরি আর ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার প্রাথমিক কাজটি আসে তরুণদের কাছ থেকেই। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বুদ্ধিজীবী দিবসের চেতনায় এই তরুণদের ভূমিকা নিতে হবে অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের।
বুদ্ধিজীবীদের জীবন পাঠ, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তা তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র হতে পারে। অগ্রজদের এগিয়ে আসতে হবে সঠিক নির্দেশনা দিতে, সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে। একাত্তর, ডিসেম্বর ও মার্চের চেতনাসহ সব চেতনার ভেতর দিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সুখী ও সমৃদ্ধ দেখতে হলে বুদ্ধিজীবীদের চেতনাকে ধারণ করতে হবে।
বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনী, নাটক সিনেমা কিংবা পত্রিকার পাতায় যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে জনমত সৃষ্টি করেছিলেন, এখন সময় এই প্রজন্মের। মেধা ও সৃজনশীলতার পাঠ অনুধাবন করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করা। সমাজ ও রাষ্ট্রকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবন মান উন্নয়নে অগ্রসর হওয়া।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা তাদের লেখনীতে সংগ্রাম কিংবা বিদ্রোহের যে সবক দিয়েছিলেন, যেভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতেন, শিক্ষাক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রসরমান হয়েছিলেন, অন্যায় ও অন্যায্য বিষয়গুলোকে যেভাবে প্রত্যাখ্যানের ডাক দিয়েছিলেন, দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে যেভাবে অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধ রুখে দাঁড়াবার সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন, সেগুলোকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে এই প্রজন্মকে। ১৪ ডিসেম্বর শোকের দিন, এই দিনটি হোক তরুণ প্রজন্মের সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শপথের দিন।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষক