বিজয়ের মাসে প্রমত্ত পদ্মা জয়
১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৫৯
বাংলাদেশের মানুষের কাছে পদ্মাসেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আসলে পদ্মাসেতু শুধুমাত্র স্বপ্ন নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার যার সফল বাস্তবায়ন হতে চলছে। গোটা জাতিকে সঙ্গে নিয়ে বিজয়ের মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরেকটি বিজয়ের ইতিহাস রচিত হল বাংলাদেশে। বিজয়ের মাসে যেন আরেকটি বিজয় উপহার পেল জাতি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে সম্পন্ন হলো পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শেষ হতে চলেছে বহু অপেক্ষার প্রহর। সব কাজ শেষে আগামী বছর নাগাদ চলাচল শুরু হবে এই সেতুর উপর দিয়ে। ১০ ডিসেম্বর সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সব অনিশ্চয়তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করল বাংলাদেশ।
বিজয়ের এই মাসে পদ্মাসেতুর ৪১ টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হওয়ার মাধ্যমে নানা কাঠখড়, ঘাত-প্রতিঘাত, গুজব, আরও কত বাধা পেরিয়ে দৃশ্যমান হলো সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এতে নৌপথের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কোটি মানুষ।
এদেশের মানুষের প্রাণের শিল্পি আবদুল আলীমের জনপ্রিয় গান ‘নদীর কুল নাই কিনার নাই’ শুনে হয়তো কেউ ভাবেনি কখনো এই কুলকিনারহীন পদ্মা নদীতেই একসময় সেতু নির্মান হবে। সত্যিই কি কোনো কূল-কিনারা নেই? এই নদীর রক্ষুসী থাবায় লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে নদীর অতল তলদেশে, নৌকা-জাহাজ ডুবেছে কত, কত মানুষ হারিয়ে গেছে নদীর স্রোতে। এখনও সেই রাক্ষুসী পদ্মায় বাড়িঘর ভাঙে, জাহাজ ডোবে, মানুষ মরে। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে যখন সেতু দৃশ্যমান তখন কি বলবে সমালোচকরা। প্রমত্তা, কীর্তিনাশা, পদ্মার বুকে যে মহান কীর্তি স্থাপিত হচ্ছে তা দেখে শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে।
পদ্মাসেতু নিয়ে ঘটেছে নানা ঘটনা। দেশি-বিদেশি বহু ষড়যন্ত্রও হয়েছে। হয়েছে রাজনৈতিক নোংরা খেলা আর দেওয়া হয়ছে নোংরা বক্তব্য। মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন তৎকালিন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ যদিও সত্য বলে প্রমানিত হয়নি। এই সকল প্রতিকূলতার মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ পশ্চিমা দাতাসংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশের জনগনের সহযোগিতায় পদ্মাসেতুর কাজ শুরু করেন। যদিও আমাদের দেশের নোংরা রাজনীতি থেকে মুক্তি পাননি তিনি। এই ক্ষেত্রে বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করে আমাদের রাজনীতিকরা প্রতি মুহুর্তই সমালোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। এমন বক্তব্যও এসেছে যে, পদ্মাসেতু ভেঙে পড়ে যাবে, তাই জনগন যেন সেই সেতু ব্যবহার না করেন।
সকল সমালোচনার মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা দিয়ে এমন এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে বসলেন, যা শুনে বাংলার মানুষ আশ্চর্য হয়ে গেল। তিনি পরিষ্কার ঘোষণা দিলেন, ‘পদ্মাসেতু নিজেদের অর্থায়নেই হবে।’ এই ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মনে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই রকমের চিন্তাই উঁকি দিতে থাকে। আস্তে আস্তে প্রমত্তা পদ্মার বুকে একটি একটি পিলার উঠতে থাকে আর তার স্প্যান বসতে থাকে। কাজ শুরুর পর শুরু হয় নানা গুজব। আতংক সৃষ্টি করতেই একটি বিশেষ মহল এই সকল গুজব সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু, গুজবে কান না দিয়ে ধীরে ধীরে স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ চলতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে শেষ স্প্যানটা বসার মধ্য দিয়েই পুরো সেতুটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ফলে নতুন আশায় বুক ভরে ওঠে পদ্মা নদীর দুই পারের মানুষের। সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল এতদিন তাদের। এই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে। এই সেতু শুধু তো সেতুই নয়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সব বাধা অতিক্রম করে দুর্বার বেগে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে অবিচল এই সেতু তারই বিস্ময়কর ঘোষণা।
যে জাতি বিশাল পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল সেই জাতির জন্য পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন নতুন বিজয়। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, একদল বাঙালি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে, আরেক দল বাঙালি সেই জীবনজয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে বরং ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এটা আমরা পলাশীর প্রাঙ্গণে দেখেছি, দেখেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও। পদ্মাসেতু নিয়ে আমাদের দেশের জাতীয় নেতৃত্বের বুদ্ধিহীন বক্তব্য আসলে জাতিকে কি বার্তা দিয়েছে। আজকের ও আগামী প্রজন্মের নিকট এই নেতৃত্বে কি অবস্থান। তাদের কথাবার্তা কি দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার অবহেলিত মানুষকে আঘাত করেনি? ‘জোড়াতালি’ দিয়ে যে পৃথিবীর কোনো ‘মেগা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হয় না’ এটা সম্ভবত তারা বুঝতে সক্ষম ছিলেন না।
ডিসেম্বর মাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত বিজয়। ১৯৭১ সালের এই মাসেই আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ বীর নারীর ত্যাগের ফলশ্রুততেই অর্জিত এই বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে যে স্বাধীন বাংলার বিজ বপিত হয়েছিল, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জাতিকে দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় এই মাসে। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে আত্মপরিচয় লাভ করে বাংলাদেশ। অর্জন করে সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত পতাকা।
প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এসব স্প্যান চীনে তৈরি করে জাহাজযোগে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পদ্মাসেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মাসেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে আর অল্প সময়ই অপেক্ষা করতে হবে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বসানো স্প্যানগুলোতে রেলওয়ে স্ল্যাব ও রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজও চলমান। সেতুতে প্রয়োজন হবে দুই হাজার ৯১৭টি রোডস্ল্যাব। এরই মধ্যে এক হাজার ২৩৯ টির বেশি স্ল্যাব বসানো হয়েছে। রেলওয়ের জন্য প্রয়োজন হবে দুই হাজার ৯৫৯টি রেলস্ল্যাব। যার মধ্যে এ পর্যন্ত এক হাজার ৮৬০টির বেশি বসানো হয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছরের ওপর। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুটি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মাসেতুর কাঠামো। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব যে সত্যি সত্যিই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে এদেশের মানুষ সেটা উপলব্ধি করছে। পদ্মাসেতু শুধু একটি স্বপ্ন নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন। বিজয়ের এই মাসে নতুন করে আবার বাংলাদেশকে চিনল সারা বিশ্ব। গোটা জাতিকে সাথে নিয়ে বিজয়ের মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরেকটি বিজয়ের ইতিহাস রচিত হলো বাংলাদেশে।
আমাজান নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্ত নদী পদ্মার বুকে দাঁড়িয়েছে পিলার। যাতে বসানো হয় স্প্যানগুলো। পদ্মাসেতু শুধু একটি সেতু নয়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে একটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার প্রতীকও। জাতির মাথা উঁচু হয়েছে এতে। মহান বিজয়ে দিবসে লাখো শহীদের অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলছি, শুধুমাত্র দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এই শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের বহু অপূরনীয় স্বপ্নই পুরণ করা সম্ভব।
লেখক- রাজনীতিক, কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বা্য়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন