Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হওয়ার কৌশল!


১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ১৪:৪২

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে একশ্রেণির মানুষের আবেগ ভালোবাসা বেশ চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হয়ে যাওয়া— কী দরদ লাগিয়ে, কী শ্রদ্ধা জানিয়ে— বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভাইরাল করা স্ট্যাটাস, অন্যের পোস্টে কমেন্ট করার বিষয়গুলো রীতিমত আগ বাড়িয়ে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ দেখানোর মতো। আবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই শ্রেণির মানুষের উৎকণ্ঠা এতোটাই উতলে উঠেছে— এটিও ভাইরাল করা লাইন ধরে-ধরে কিংবা একই স্ট্যাটাস, একই কমেন্ট ফেসবুকে নিজের নামে পোস্ট করা, অন্যের পোস্টের নীচে তুলে ধরার বিষয়গুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ না করলে খালি চোখে সাধারণই মনে হবে।

বিজ্ঞাপন

‘‘যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর একজন তেলবাজকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, ৩৬ ঘণ্টা লাশ বসে ছিলো জানাজা দেওয়ার জন্য, নেতা পাওয়া যায়নি, মৌলভীরা এসেই জানাজা আর দাফন-কাপন সেরেছিলেন। সেভাবেই এই তেলবাজরা পালাবে শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছুটে গেলে। তবে শেখ হাসিনা মারা গেলেও মৌলভীরা তিনার জন্য তিনার বাবার মতোই দোয়া করবে’’-এই ধরণের স্ট্যাটাস ফেসবুকে একাধিক আইডি থেকে নিজের নামেই পোস্ট করা। আবার অনেকে কপি-পেস্ট করেই অন্যের পোস্টের নিচে কমেন্ট আকারে তুলে ধরেছে।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, “আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগ করে। শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে। আমিও ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগের নানা রকম দুর্নীতির কারণে এখন আর করি না। তবে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি। আচ্ছা, বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, বঙ্গবন্ধু তো থাকবে মনের গহীনে। ভাস্কর্য বানাতে হবে কেন? আল্লাহ’র আজাব থেকে আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে আমরাই রক্ষা করবো। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য চাই না। বঙ্গবন্ধুর কবরে আজাব হোক— কোনো খাঁটি বঙ্গবন্ধুর প্রেমিক চাইবে না। শুধু হাইব্রিডরাই ভাস্কর্য নিয়ে লাফালাফি করে’’— এই ধরণের কথাগুলো স্ট্যাটাস আকারে, আবার অন্যের পোস্টে কমেন্ট আকারে ভাইরাল হচ্ছে, অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এই ধরণের বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের আগমন, এতোবেশি দরদ, এতোবেশি সাধু-নিষ্ঠাবান মানুষগুলোর রাজনৈতিক দর্শন কী— এটি অনুসন্ধান করে জানতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কারণ, তাদের ব্যক্তি সত্তা আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি, তাদের ব্যবহৃত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট জুড়েই ফুটে আছে। অনেকে আবার এক্কেবারে নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে তড়িঘড়ি করে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সাঁজতে গিয়ে নিজেদের আসল উদ্দেশ্যের প্রমাণচিহ্নও মুছতে ভুলে গেছে।

জানি, এই ধরণের কৌশল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও করা হয়েছে। তখন যেহেতু ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিলো না, তাই তখনকার প্রচার করার, এক কান থেকে অন্য কানে পৌঁছানোর মাধ্যমও ছিলো সুনির্দিষ্ট কতিপয় ব্যক্তি ও মহল। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের চায়ের দোকানগুলো ‘প্রচারমঞ্চ’ হিসেবে ব্যবহার হতো। তখনও সুকৌশলে ধর্মের বাণী আনিয়ে-বানিয়ে শোনানো হতো, মানুষকে খারাপ-ভালো আর দোজখ-বেহেস্তের কথা শুনিয়ে এক প্রকার বিভ্রান্ত করতো, নিজেদের পক্ষের জনমত সৃষ্টি করতো, দল-গ্রুপ ভারী করার কৌশল গ্রহণ করা হতো।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা— আমার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে কোনো কিছু নিয়ে পোস্ট দিলেই একশ্রেণির ফ্যান-ফলোয়ার গালাগাল করে কমেন্ট করতে থাকে। আবার এই একই ব্যক্তি, একই কমেন্ট অন্যান্য পোস্টগুলোতেও করে। প্রথম প্রথম মনে করতাম, অল্পবয়স্ক। বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর একজন, আমার স্ট্যাটাসের বিপরীতে তার কাছে কোনো সঠিক তথ্য-প্রমাণ নেই বলেই গালাগাল করে, মন্তব্যকারী তেমন কিছু জানে না— এমন ভাবনা থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিংবা ‘আপনার মতামত দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ’ লিখে কখনো কখনো উত্তর দিয়েও থাকি।

কিন্তু মহান বিজয় দিবস-২০২০ এ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের মহান বিজয়ের শুভেচ্ছা’—লিখে আমার ফেসবুকে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানালে তখন গালাগালির সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়’, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’।

তখনই মূলত ওইসব বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং ব্যক্তির ফেসবুক, স্ট্যাটাস, কমেন্টগুলো নিয়ে কিছুটা স্টাডি করি। কারণ, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে কারা ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এ রূপান্তর করার চেষ্টা করেছে এবং তারা অবুঝ, না চতুর-এটি দেশের সচেতন মহলের সাথে আমিও অবগত। আর তাই এই ধরণের ব্যক্তিদের প্রায় বারশোর উপরে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ে পর্যালোচনা করায় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, তারা নীল নকশা প্রণয়ন করেই ‘বঙ্গবন্ধুপ্রেমী’ সেজে সংঘবদ্ধভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করছে। আবার একই ব্যক্তি অনেকগুলো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অপারেট করছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, পেজ, গ্রুপ খুলেও এমন প্রচারণা করা হচ্ছে। এতে কিছু সফলতাও তারা পেয়েছে— এটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি। তবে বিশেষ করে, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক চেতনা যারা ধারণ করে, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মূল্যবোধগুলো যারা শ্রদ্ধা করে, গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়গুলো যারা গুরুত্ব দিয়ে থাকে, আওয়ামী লীগ না করলেও এদের বিভ্রান্ত করতে পারেনি।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, তৃতীয় বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তি যতটা সহজ হচ্ছে, ততটাই গুজব নির্ভর বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে একটি মহল। যদিও ওই শ্রেণির ব্যক্তি ও মহলের পরিচয় ১৯৭১ সালেই সুনিশ্চিত হয়েছে। তবে, তাদের বংশধর, বিতর্কিত রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করা জনগোষ্ঠীর পরিকল্পনার সঙ্গে বিকৃত ইতিহাসের বিভ্রান্ত ব্যক্তি ও মহলও অজানা কারণে জড়িয়ে পড়ছে, গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে।

রাষ্ট্রযন্ত্র কতটুকু সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করছে—এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, অতীতে অঘটন-গুজব সৃষ্টি হয়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেই। ‘পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’—এই গুজব রাতারাতি রোধ করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে কতিপয় সাধারণ মানুষের জীবনহানীকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আবার নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও গুজব ছড়িয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সর্বশেষ, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও গুজব নির্ভর হয়ে পড়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

কারণ, অপরাজনীতির শিকার জনগোষ্ঠীর একশ্রেণির মানুষ ও তাদের বংশধর পরিকল্পনা গ্রহণ করেই সোশ্যাল মিডিয়াকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করছে। সেই সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ছোবল, জঙ্গি-মৌলবাদের বিষবাষ্পও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল করছে— যেখানে ধর্মের বাণীর সঙ্গে জান্নাত-জাহান্নামের স্বপ্ন-ভয়ও দেখানো হচ্ছে।

পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের তথ্য সূত্রে, চলতি বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে প্রকাশিত ব্যবহারকারীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী— বাংলাদেশে ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা বা ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটির কাছাকাছি। আর বিটিআরসির সর্বশেষ এ বছরের সেপ্টেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৯ কোটি ৫ লাখ। বিশাল এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ফেসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অপারেটিং সিস্টেমস বা অ্যাডমিন প্যানেল বাংলাদেশের হাতে নিয়ে আসা সম্ভব হলে সব ধরণের অপপ্রচার-গুজব দ্রুততার সাথে মুছে ফেলা সম্ভব হবে, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

কারণ, প্রতিটা অপকৌশল বা গুজবে একশ্রেণির মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। হঠাৎ কৌশলে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হওয়ায় কিছু মানুষ তাদের সুরে সুর মিলিয়ে তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। যার ফলে, অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত হয়। বিশেষ করে, গুজব কতটা ভয়ঙ্কর— এটি কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে– এই অপপ্রচার ভাইরাল হওয়ার পর পুরো জাতি বুঝতে পেরেছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অ্যাডমিন প্যানেল নিজস্ব অধীনে নিয়ে আসা সহ কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা করতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর