আউশ-আমনে যা তা— বোরোতেও ওয়ার্নিং
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:১৮
পুস্তকে, রচনায়, বক্তৃতায় কৃষিপ্রধান দেশ বলা হলেও— গণমাধ্যমে কৃষির খবর নেহায়েতই কম। যদ্দূর আসে তার ট্রিটমেন্টও দুর্বল। চাল, ডাল, পেঁয়াজ ইস্যু হয় কৃষিসংবাদ হিসেবে নয়— দাম বাড়া-কমার একটি পণ্য হিসেবে। অর্থনীতিতেও কৃষি ও কৃষকের পজিশন কেবল সংখ্যার মতো। সেই ধারা জাতীয় বাজেটেও। স্বীকার করতে কৃপণতা থাকা উচিত নয়, করোনা মহামারিকালেও বীরত্ব দেখিয়েছে কৃষি ও কৃষক।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড অবস্থানে রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। করোনা এগুলোর প্রতিটিকেই নাস্তানাবুদ করেছে। কিন্তু কৃষিখাত কাবু হলেও ভাঙেনি। মচকেওনি। উপরন্তু, দেশ বাঁচিয়ে রাখার স্টিয়ারিংয়ে কৃষি ও কৃষক। শুধু ভাতের সংস্থান? না। সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোনো কিছুরই অভাব বোধ করতে দেয়নি। অথচ ধানের ন্যায্য মূল্য পায়নি কৃষকরা। সবজি ফলিয়ে কাঁদছে। মৌসুমি ফল নিয়েও বিড়ম্বনা।
এরমাঝেই শীত জেঁকে বসেছে। উত্তরবঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে ঘন কুয়াশা। শস্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে। শীত-কুয়াশায় বোরোর বীজতলার কী অবস্থা শহরসভ্যতার অনেকেরই অজানা। কৃষকরা গণমাধ্যমে খবর প্রচারের অপেক্ষায় নেই। নিজ গরজেই ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছে। কিন্তু, ফল মিলছে না। এ অবস্থায় বীজতলা পচে বোরোর চারা সংকটের শঙ্কায় কৃষকরা। কৃষিবিভাগের তৎপরতা এখনো দৃশ্যমান নয়। সেই অপেক্ষায়ও নেই কৃষকরা। অভিজ্ঞতা দৃষ্টে ছত্রাকনাশক ছিটানোর পাশাপাশি তারা কুয়াশা থেকে বাঁচাতে বীজতলা ঢাকছে পলিথিন দিয়ে। বন্যা ও বিরূপ আবহাওয়া গত মৌসুমে আমন-আউশ ছারখার করেছে। আবাদ ব্যাপক হলেও ফলন ভালো পায়নি। দামও পায়নি কৃষকরা। এবার শীত-কুয়াশার রক্তচক্ষু বোরোর দিকে। গত কয়েকদিনে উত্তরাঞ্চলে শীত-কুয়াশার তোড়ে দিন-রাতের তফাৎ কমে গেছে। দিনের বেশিরভাগ সময় থাকছে অন্ধকার। সূর্যের তাপ না পাওয়ায় বীজতলায় চলছে ছত্রাকের দাপট। কোথাও কোথাও চারা হলুদাভ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। চারা পোড়া ও ঝলসানো রোগও দেখা দিয়েছে। ধানের চারায় হঠাৎ ছোট ছোট সাদা পোকার আক্রমণ হয়েছে। বারবার কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে গতবছর বোরোর ফলন হয়েছিল দুই কোটি এক লাখ ৮১ হাজার ৩৭৯ মেট্রিকটন। এ বছর বোরোর লক্ষ্যমাত্রা দুই কোটি পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৪৭০ মেট্রিকটন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ধান রোপণ শুরু হয়েছে শুধু হাওর এলাকায়। অন্যান্য এলাকায় চারারোপণের প্রস্তুতি চলছে মাত্র। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, সামনে শীত-কুয়াশা মিলিয়ে শৈত্যপ্রবাহ তীব্র হতে পারে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তখন করোনার প্রকোপ তীব্র হবে। কিন্তু, কৃষি অধিদফতরের বার্তা ভিন্ন। তারা বলছেন, বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার মতো শীত না-ও পড়তে পারে। তাপমাত্রা বাড়লেই যে সকল বীজতলা আক্রান্ত হয়েছে— সেগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, দেশে উৎপাদিত ধানের সিংহভাগই বোরো। এ সময়ের ধানের ফলনও তুলনামূলক বেশি। যেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে আউশ ও আমনের ফলন যথাক্রমে ২ দশমিক ৫৫ ও ২ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন, সেখানে বোরোর ফলন ৪ মেট্রিক টনেরও বেশি। উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আমন। তবে গত মৌসুমে আমনের ফলন মার খেয়েছে। সামনে বোরোর উৎপাদন কমলে তা পুরো বছরের সার্বিক উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এ অবস্থায় বোরো রক্ষায় বাড়তি পদক্ষেপ জরুরির চেয়েও জরুরি। নইলে সামনে খুব খারাপ খবর অপেক্ষমাণ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন