সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অনন্য উদ্যোগ এতিম শিশু সুরক্ষা
২২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:০৫
আমাদের সমাজের একটি বৃহৎ অংশ এতিম শিশু। পিতা কিংবা মাতা-হীন একটি শিশুর একাকী জীবন কতটা অসহায়ত্বের, তা অনেক সময় আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এতিম শিশুদের জীবিকায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিষয়টি উপলব্ধি করে বর্তমান সরকার এতিম শিশুদের সহায়তার বিষয়টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করে।
বাংলাদেশে এতিম শিশু সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবার স্বামী বা পিতার উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু হঠাৎ করে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা গেলে পুরো পরিবারটি দিশেহারা হয়ে পড়ে। আর্থিক দৈন্যে পড়ে, পরিবারটি বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিরন্তর লিপ্ত থাকে। ফলে পরিবারের ছোট শিশুটিও তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়। অনেকক্ষেত্রেই সামাজিকভাবেও শিশুটি বঞ্চনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এভাবে বাংলাদেশ প্রতিদিন এক একটি এতিম শিশু সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যা সামগ্রিক উন্নয়নকে যাতে কোনোভাবে ব্যাহত করতে না পেরে সেজন্য এতিম শিশুর সুরক্ষায় সরকারের বহুমুখী কর্মসূচি প্রশংসনীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ আগস্ট এতিমদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “আমি তোমাদের একটি কথা বলতে চাই, তোমরা অনাথ এবং অসহায় নও, তোমরা আমার অত্যন্ত কাছের এবং আপনজন। আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সবসময় তোমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন আমি তোমাদের পাশে আছি”। তিনি আরও বলেন, “তোমাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করাই আমার সব সময়ের প্রচেষ্টা”। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যই দেশের সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের জনগণ অবহেলিত দুঃস্থ এতিম শিশুদের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণে বদ্ধপরিকর। অনেকেই এতিম শিশুদের লালন-পালনের জন্য বেসরকারিভাবে এতিমখানা পরিচালনা করে আসছে। বেসরকারি এসকল এতিমখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদফতর সহযোগিতা প্রদান করে। বেসরকারিভাবে এতিমখানাসমূহ প্রথমত: স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী নিবন্ধন প্রদান এবং পরবর্তীতে নিবন্ধন-প্রাপ্ত বেসরকারি এতিমখানাসমূহের শিশুদের প্রতিপালন, চিকিৎসা এবং শিক্ষা প্রদানের জন্য আর্থিক সহায়তা করা হয়, যা ক্যাপিটেশন গ্রান্ট নামে পরিচিত। বর্তমানে ৩ হাজার ৭২৮টি বেসরকারি এতিমখানার ৯৭ হাজার এতিম শিশুকে এই সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। গত অর্থ বছরে মাসিক ২ হাজার টাকা করে প্রায় ২৩২ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদফতরের কার্যক্রম শাখা বেসরকারি এতিমখানা নিবন্ধন এবং প্রতিষ্ঠান শাখা এই ক্যাপিটেশন গ্রান্ট পরিচালনা করে।
দরিদ্র এতিম শিশুদের মানবসম্পদে পরিণত করাই এই ক্যাপিটেশন গ্রান্টের প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়াও স্নেহ-ভালবাসা ও আদর-যত্নের সঙ্গে এতিম শিশুর লালন-পালন নিশ্চিতকরণ, তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা, শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা সাধন নিশ্চিতকরণ, শিশুর পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা প্রদান এবং পুনর্বাসন ও স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কর্মক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য এতিমদের কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানে সরকারের উদ্যোগও প্রশংসনীয়।
বর্তমান সরকার বেসরকারি এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট বরাদ্দ ও বণ্টন নীতিমালা ২০১৫ প্রণয়ন করে, যা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট প্রদানে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর পর্যায়ে নিবিড় তদারকি এবং মনিটরিং জোরদারকরণের ফলে এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে দেশের এতিম শিশুদের প্রতিপালনে বেসরকারি পর্যায়ে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া ফেলেছে। বলা যায়— বেসরকারি এতিমখানায় ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট বরাদ্দ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কর্মসূচির একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের উপর ভিত্তি করে সামাজিক নিরাপত্তামূলক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষত উদ্ভাবনীমূলক পাইলট কর্মসূচি সৃজন, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী অথবা প্রান্তিক বা বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যেসকল মানুষের নিকট সেবা পৌঁছানো কঠিন তাদের মধ্য থেকে সম্ভাব্য উপকারভোগী চিহ্নিতকরণ এবং সকল এতিম শিশুকে সহায়তার আওতায় নিয়ে আসতে সরকারের নানামুখী কর্মসূচি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। এতিম শিশুদের দারিদ্র্যতা, অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক সমস্যা নিরসনে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসাও জরুরি।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা এবং বরাদ্দ প্রতিবছরই বাড়ছে। আগামীতেও বাড়বে। এ কর্মসূচির আওতায় যাদের আনা হয়েছে— তারা একসময় খুবই অবহেলিত ছিলো। আজ এ সুবিধার আওতায় তারা সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে, যা তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক মহৎ উদ্যোগ, যা সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের এক বৃহৎ প্রচেষ্টা।
সফিউল আযম: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষক