Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জ্ঞানসূচকে আমরা কেন তলানিতে


২২ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:৩৩

১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমাবর্তনে ভাষণ দিতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, যে দেশে লেখাপড়া না জেনেই মন্ত্রী হওয়া যায় সে দেশে ছেলেমেয়েরা কেন কষ্ট করে লেখাপড়া শিখবে? এই কারণেই কিনা জানি না— তবে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালোভাবে লেখাপড়ার কোনো সুযোগ আমরা তৈরি করতে পারিনি। কাজেই তারা ভালো করে লেখাপড়া করে না। কুদরত ই খুদা শিক্ষা নীতি করার পর প্রায় সারাদেশে তিনি তা প্রচার করেছিলেন, তিনি সবার কাছে অনুরোধ করেছিলেন সেই নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য। বঙ্গবন্ধু সুযোগ পাননি; আর পরের সরকার তার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি এবং আমার ধারণা অসূয়াবশত তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা কোনো ভাল শিক্ষানীতি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এবং শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে উদাহরণ দেওয়ার মতো কিছুই করতে পারি না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এখন শিক্ষামন্ত্রীর মুখে শুনেছি তিনি খুদা কমিশনের নীতি বাস্তবায়ন করবেন।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশের মতো এতো বিশৃঙ্খল শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর কোথায় আছে বলে আমার জানা নেই। এতো কম অর্থও কোনো দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয় না। কেনিয়াও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবার চেয়ে দুর্বল ও অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। কোনো ধনী বা মধ্যবিত্ত বা শহুরে পরিবারের কোনো সন্তান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে না। ইংরেজি মিডিয়াম, ইংরেজি ভার্সন, এবতেদায়ি, কওমি প্রভৃতি প্রায় বারো রকমের শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চালু রেখেছি এক দেশে। যার যে রকম টাকা আছে— তার সন্তানদের জন্য সে রকম স্কুল। এমনকি অনেক স্কুল আছে সেখানে কী পড়ানো হয় তা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে না। ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা এদেশের ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস যেমন জানে না, তেমনি মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরাও জানে না। এদেশের সন্তান বড় হচ্ছে ইউরোপ বা আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের সন্তানের মতো। দেশের জন্য এদের কোনো দায় নেই, ভালোবাসা নেই। এরাই ফ্যানাটিক হয় বড় হয়ে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা দরিদ্র ছেলেমেয়েদের অনেক কষ্ট করে পড়ান; বেতন পান পিয়নের মতো। উপায় যাদের নেই তারাই এখানে আসে, স্বভাবতই যারা লেখাপড়ায় দুর্বল।

বিজ্ঞাপন

স্কুল কলেজের অবস্থার কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। অসংখ্য স্কুল কলেজ তৈরি হয়েছে অবৈধ পথে ও উদ্দেশ্যে। বেসরকারি কলেজ তৈরি হয়েছে স্থানীয় নেতা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপরিসীম আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা এখানে কোনো উপায় না পেয়ে চাকরি করে। আর নিয়োগ, এমপিও কিংবা কলেজের নানা অনিয়ম দূর করার জন্য মন্ত্রণালয়ে পদে পদে টাকা ঘুষ দেয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ি থানায় ২৬টি কলেজ। সেই সব কলেজে শিক্ষক ৪০-৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ৫০ জনের কম। এই হলো বেশিরভাগ কলেজের হাল।

শিক্ষকেরা কী পড়ান, কিভাবে পড়ান তা দেখার কেউ নেই। তারা সপ্তাহে দু’দিন বা তিন দিন কলেজে যান। তাদের পাঠদানের পদ্ধতিগত উন্নতির কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। কোনো গবেষণা, লেখালেখি বা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ বা চল নেই। সরকারি কলেজের অবস্থা এর চেয়ে খুব ভালো নয়। সরকারি কলেজে শুধু বিসিএস পাশ করে শিক্ষকেরা যোগ দেন। তারপরে আর লেখাপড়ার করার কোনো প্রক্রিয়ায় তারা থাকেন না। প্রমোশন হয় অটো। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করেন, তবে এর জন্য তার কোনো উন্নতি হয় না। অর্থাৎ শিক্ষকদের মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে প্রমোশন হয় না বলে কেউ আর লেখাপড়া করেন না। তারা কোনো সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামে যোগ দেন না। তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুধু পরীক্ষা নেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা ছাড়াই পরীক্ষা নেওয়াকে তাদের রীতিতে পরিণত করেছে। কখনো খাতা দেখা ছাড়াই পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ার খবর পাওয়া যায়। এর বাইরে আবার অনেক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। গ্রামের কলেজে যেখানে লাইব্রেরি নেই, শিক্ষক নেই সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধভাবে অনার্স খুলে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি। পৃথিবীর কোনো দেশে এত ছেলেমেয়ে সম্মান কোর্সে পড়ে বলে মনে হয় না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা অনার্স বা মাস্টার্স করছে তারা কী মানের লেখাপড়া করছে সেটা সবাই জানে। অনেকের ধারণা আমাদের শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়ার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রধানত দায়ী।

এইসব সরকারি বেসরকারি কলেজে যে লেখাপড়া হচ্ছে সেটা শুধু সংখ্যা দিয়েই বিচার করা যাবে। গুণগত লেখাপড়া এটা তো নয়। এরা ভর্তি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন দেশে শ’খানেক বিশ্ববিদ্যালয়। বেশিরভাগ বেসরকারি। সেখানে হাতে গোণা কয়েকটি মানসম্পন্ন ,বাকিগুলো স্রেফ কোচিং সেন্টার, বিদ্যা নিয়ে প্রহসনমুলক বাণিজ্যকেন্দ্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে, এর লেখাপড়া নিয়ে কেউ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। কারণ এখানেও নানা সমস্যা। একসময় সবচেয়ে মেধাবী যারা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন, এখনও হচ্ছেন— তবে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। একসময় ক্যাডার সার্ভিস (প্রশাসন) ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতেন অনেকে, এখন আর দেন না। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর প্রশাসনের ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। বিগত অর্থমন্ত্রী তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি বাতিল, তাদের বেতন বা স্কেল কয়েক ধাপ নামিয়ে দিয়েছেন। এখন তো শিক্ষকেরা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো সরকারি স্কলারশিপ পান না। মন্ত্রণালয়ে আসা স্কলারশিপের খবর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে অন্তিম সময়ে, তখন আর কেউ দরখাস্ত করতে পারে না। এর ফলে মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তারা এমনকি পুলিশের কর্মকর্তাও পিএইচডি করছেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পিএইচডি যে কাজে লাগে অন্য সংস্থার মানুষের তা কাজে লাগার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের বাইরেও জীবনমান বাড়ানোর জন্য কোনো সুযোগ নেই। আগে যা ছিলো তা এখন খর্ব কারা হয়েছে। গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাজেটের শতকরা দুই ভাগ। যা দিয়ে গবেষণাগারের টেবিলের ম্যাট কেনা যায় না বলে একজন রসায়নের শিক্ষক আমার কাছে খেদোক্তি করেছিলেন। বই কেনার জন্য বছরে দেওয়া হয় দুই হাজার টাকা। সেটাতে সরকারি অডিট আপত্তি আছে। অর্থাৎ অবসরের পর কর্তন করা হবে।

এই সুযোগ সুবিধা নিয়ে শিক্ষকেরা চলতে পারে না বলে তারা অন্যত্র কিছু করা সুযোগ খোঁজেন। কেউ ব্যবসা করেন, কেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, কেউ করেন শেয়ার বাজারের ব্যবসা। আবার একই দেশে চোখের সামনে অন্যদের রাতারাতি উন্নতজীবন ও অর্থশালী হতে দেখে তারা হীনমন্যতায় ভোগেন। তারা ফতুয়া গায়ে গরমে ঘামতে ঘামতে ছাতা হাতে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে সন্তুষ্ট থাকলে বা কেউ একজন পাজেরো গাড়ির কাদা ফতুয়ায় ছিটিয়ে দিলেও মন খারাপ না করলে হয়তো তেমন কিছু হতো না। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ফলে প্রকৃত, যথাযথ, মানসম্পন্ন ও গুণগত শিক্ষা দেওয়ার অবস্থায় তারা থাকেন না। এর পরে রাজনৈতিক বিবেচনায় কম মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ব্যাপার তো আছেই।

আমরা তাহলে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা থেকে জ্ঞানসূচকে কেন পিছিয়ে গেলাম সেটা তো স্পষ্ট। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকার শিক্ষকদের বেতনভাতা, সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। কখনো তা আমাদের চেয়ে তিনগুণ। আমারা শিক্ষকদের ছোট করে দেখছি। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র আর দুর্নীতির কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলেছি। বেতনভাতা, সুবিধা বাড়ালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে সেটাও নয়। তবে প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই কয়েকমাস আগেও ঢাকায় গিয়ে অনশন করেছেন তাদেও বেতনভাতা বাড়ানোর জন্য। আমাদের বাজেটে শিক্ষার যে বরাদ্দ— তা খুবই নগণ্য। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যে হিসেব দেখায় তা সবটা শিক্ষার জন্য ব্যয় হয় না।

শিক্ষা নীতির বাস্তবায়ন, সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, তদারকি এবং মেধাবীদের শিক্ষকতায় মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের জ্ঞানকাণ্ড নিয়ে মানুষ আজ কথা বলছে; বিদেশিরা কটাক্ষ করছে। আমাদের নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব ছিলো, জ্ঞানদর্শন ছিলো। সোমপুর বিহারে (বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য) বৌদ্ধভিক্ষুরা যে মানের জ্ঞান চর্চা করতো— তা তখন পৃথিবীর কোথাও ছিলো না। আমাদের অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্মের জ্ঞানালোক যেভাবে বিকশিত করেছেন তার তুলনা নেই। কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের একজন কিশোর ছোটদের নোবেল সমতুল্য পুরষ্কার পেয়েছে। একজন যোগ দিয়েছে নাসায় বিজ্ঞানী হিসেবে। আমাদের দেশের হূমায়ুন কবীর পাইলটবিহীন বিমানের নকশা করেছিলেন। গোটা আফ্রিকায় আইটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন বাংলাদেশি। আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদেরকে উপযুক্ত সুযোগ দিলে তারাই আমাদের জ্ঞানসূচক উন্নত করবে।

আমাদের জ্ঞানসূচক তলানিতে এসেছে। এই অবনমনের কারণ আমাদের জানা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রকৃত জ্ঞানচর্চার সুযোগ-সৃষ্টির ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে আমরা আবার জ্ঞানসূচকে একটা সম্মানিত স্থানে পৌঁছাতে পারব।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

জ্ঞানসূচক বাংলাদেশ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর