সোনালী দিনের সোনালী রেখার সাক্ষী
২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:১৭
নব্বই দশকে যখন গ্রাম বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ‘যাত্রাশিল্প’ অন্ধকার যুগের মধ্যে—তখনও অনেক এলাকায় ভালো ভালো যাত্রার কথা শুনেছি। দেখেছিও। মূলত আকাশ সংস্কৃতির অবাধ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ শিল্পের দর্শকদের মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এরসঙ্গে আস্তে আস্তে যুক্ত হতে থাকে ভিসিআর দেখা, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ অর্থাৎ ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের সুযোগ। ফলে মানুষের রুচির পরিবর্তনও প্রকাশ পায়। যা মূলত শেকড় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। এভাবেই পর্যায়ক্রমে যাত্রা সংস্কৃতির বুকে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে গ্রামীণ সংস্কৃতির সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়তে থাকে।
এখন তো যাত্রা করার অনুমতি দেওয়াই হয় না স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এটি অঘোষিত নিয়ম। কারণ প্রকৃত শিল্প চর্চা আর নেই। শীত মৌসুম চলছে। আমন কাটার পর, বেরো মৌসুম শুরুর মাঝখানের সময়টাই যাত্রা গানের জন্য উপযুক্ত। এ সময়েই গ্রামের মানুষের দীর্ঘ অবসর। বিশেষ করে কৃষকদের। তাই অবসর বিনোদনের অন্যতম সংস্কৃতি ‘যাত্রা’ ছিলো সবার কাছে বেশ পছন্দের। বলতে গেলে মনের খোরাক মিটাতো। সবাই সন্ধ্যার পর প্রস্তুতি দিয়ে দলবেঁধে ছুটতেন যাত্রা দেখতে।
দর্শকদের রুচিতে যখন অশ্লীলতা ভর করেছে—অর্থাৎ অপসাংস্কৃতিক; তখনও কলা কৌশলীরা নিরন্তর চেষ্টা করেছেন সংস্কৃতির মূল ধারায় নিজেদের ধরে রাখতে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও তা হয়ে ওঠেনি। যাত্রা মানেই অশ্লীল নৃত্য, কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য দেখাতে হবে। খোলামেলা নাচ গান যত সময় চলে—দর্শকদের ততো সময় ধরে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু বইয়ের গল্প আর শেষ ফুরায় না। এক পর্যায়ে দর্শকরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। বই কোনো রকম মাঝপথে আসার পর দর্শক শূণ্যতায় যাত্রাপালা শেষ করতে হয়।
আমি নিজেও গ্রামের ছেলে হিসেবে এক সময় যাত্রা পালার নিয়মিত দর্শক। নিজের চোখে দেখেছি যাত্রা শিল্পের ধ্বংসের শেষ অংশটুকু। কিভাবে দর্শকের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। কিভাবে পথে বসেছে যাত্রা শিল্পে নিয়োজিত মানুষ। তখন এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের যা করণীয় ছিলো—তা করা হয়নি। ফলে পুরো শিল্পই এখন শিকেয় তোলে রাখার অবস্থা। এই সুযোগে গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করেছে ওয়াজ মাহফিলের নামে উগ্র মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি-প্রণয় গ্রাস করেছে অপসংস্কৃতি। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে চলার রেওয়াজ কমেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বিষাক্ত ছোবল আমরা প্রায়ই দেখতে পাই।
নেত্রকোনা জেলার ডাকসাইটে যাত্রী শিল্পী ছিলেন আমার দাদু বিমল চক্রবর্তী। যিনি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষক। যাত্রায় অভিনয় সুবাদে যাকে মানুষ ‘ভাবনা কাজী’ হিসেবে চেনেন। এই নামে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতেন তিনি। মুখে মুখে তার নামডাক ছিলো। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ আয়োজিত পৌষ মেলায় প্রতিদিন যাত্রা থাকত। সেখানে নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতেন তিনি। আশপাশের এলাকায় যাত্রা হলেই দাদুর ডাক পড়ত। অন্য জেলা থেকেই আমন্ত্রিত হতেন তিনি। ইউনিয়নে বছরে যে ক’টি যাত্রা হতো সবকটিতেই কমবেশি তিনি অভিনয় করতেন। অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করতেন তাদেরও খ্যাতির কমতি ছিলো না। রাতভর কাঁথা গায়ে খড়ের মধ্যে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবাই পালা শুনতেন। অন্ধকার কাটিয়ে ভোর হয়ে সকালের পালা। তখন যাত্রা শেষ হতো। কিন্তু শিল্পীর অভিনয় যেন চোখ থেকে কোনো ভাবেই সরতো না। আমি বহুবার শ্রোতাদের অভিনয় দেখে কাঁদতে দেখেছি। পিনপতন নীরবতা ছিলো পুরো এলাকাজুড়ে। একটি পালা শেষ হওয়ার পর অন্তত মাসখানেক এর রেশ থাকত। পরদিন শিল্পীরা বাজারে এলেই সবাই চারপাশে ঘিরে ধরতেন। চা, পান খাওয়ানের রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। আর প্রতিটি চায়ের স্টলে উত্তাপ ছড়াতো কার অভিনয় কত ভালো হয়েছে—সে গল্পে। কিছুটা হলেও সেই সোনালী দিনের সোনালী রেখার সাক্ষী হতে পেরেছিলাম।
সময় দ্রুত বদলায়। এক সময় বাবা আমাদের দু’ভাইকে যাত্রা গানে যেতে দিতেন না। তখন মনে করতাম তিনি দেখলে দোষ নেই, আমি দেখলেই দোষ। লোকটা এত বেরসিক কেন। যতই বাধা দিক, বাবা চলে গেলেই বন্ধুদের সঙ্গে পালিয়ে চলে যেতাম যাত্রা দেখতে। এখন তো বুঝি, কেন বারণ করতেন। বাবা যাত্রা দেখতে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর বের হতাম। আমরা প্রবেশের সময় বাবা বাড়ি ফিরতেন। কারণ যাত্রা আর যাত্রা ছিলো না। অশ্লীলতাই ছিলো দর্শকদের মূল আকর্ষণ। তাই বাবার মতো অনেকেই যাত্রার পুরনো চেহারা না দেখতে পেয়ে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় ছিলো না। মঞ্চের আশপাশে নারী দর্শক একেবারেই ছিলো না। তেমনি এলাকার বয়স্কদেরও আস্তে আস্তে আর দেখা যেত না। মূল দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর, অন্য একটি প্রজন্ম এ শিল্পকে লুফে নিয়ে ভক্ত হয়েছে নতুন আবেদন নিয়ে।
এর ফাঁকে গ্রামে গ্রামে অনেক কিছু গিয়ে স্থান দখল করেছে। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে, সময়ের কারণে এক শ্রেণিয় মানুষ তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন। এটাও বড় ধরণের পরিবর্তন। সময় বলছে, ভালো কিছুর বিকল্প নেই। শেকড়ের সংস্কৃতি চর্চা না হওয়ায় আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি, একথা সমাজের সব দিক থেকেই আঙ্গুল দিয়ে বলছে অনেক আগে থেকেই।
আবহমান বাংলার এই লোক-ঐতিহ্য এখন শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ হল ছাড়া কোথাও নেই। এটা মূল সংস্কৃতির জন্য অশনি সংকেত। যাত্রা, কবি গান, জারি, সারি, হাডুডু, মেলা, পুতুল নাচ, ধামাইল, পৌষ পার্বণ, বনভোজন সহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সবকিছুই কার্যত ইতিহাসের পাতায়। তবে আশার কথা, নাট্যশিল্পের পাশাপাশি দেশে যাত্রাশিল্পের সার্বিক কল্যাণ, প্রচার ও প্রসারের কথা ভাবছে সরকার। সম্প্রতি জাতীয় সংস্কৃতি নীতি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশোধন খসড়ায় যাত্রা, পুতুল নাচ ও নাট্যচর্চার পরিধি বাড়ানোসহ এর উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে যাত্রা একাডেমি এবং পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলায় যাত্রা একাডেমি করার প্রস্তাব করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নাট্যমঞ্চ করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিতে। যাত্রা, নাট্যশিল্প এবং পুতুলনাট্যের প্রচার-প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে খসড়ায়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের পর থেকেই যাত্রাপালা আয়োজনের ওপর বিধিনিষেধ আসতে থাকে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাধানিষেধ ছিলো না। তবে সরকারের মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে পারেনি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল মান্নান ইলিয়াস সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘২০০৬ সালের জাতীয় সংস্কৃতি নীতি সংশোধন করা হচ্ছে যুগোপযোগী করার জন্য। সকল শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা ও ধর্ম বিশ্বাসকে সমুন্নত রাখতে এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খসড়া নীতিতে যাত্রা ও নাট্যচর্চা বাঁচিয়ে রাখতে কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে।’
জাতীয় সংস্কৃতি নীতির সংশোধন খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘সুষ্ঠু নাট্যচর্চা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নাটক মঞ্চায়নের সকল সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। পর্যায়ক্রমে প্রথমে বিভাগীয় শহরে এবং পরে জেলা শহরে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যাত্রা ও পুতুলনাট্যের মান সংরক্ষণ এবং যাত্রা ও পুতুলনাট্যকে অপসংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত নীতি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে ট্র্রাস্ট গঠন করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে প্রস্তাব হয়েছে খসড়া নীতিতে।
এতে বলা হয়, যাত্রাশিল্পের সার্বিক কল্যাণ, প্রচার, প্রসার ও মানোন্নয়নের জন্য ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় যাত্রা একাডেমি ও পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলায় যাত্রা একাডেমি স্থাপন করা দরকার। প্রান্তিক পর্যায়ে অবস্থানরত নাটক ও যাত্রাশিল্পীদের ভাতা ও প্রয়োজনে অর্থ বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব, যাত্রা উৎসব আয়োজন করতে হবে।
সংস্কৃতিসেবীরা মনে করেন, জেলা উপজেলায় একাডেমি করে শিল্পী তৈরি করার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় যাত্রা মঞ্চ তৈরি করা প্রয়োজন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে শিল্পীদের সম্মাননা দিয়ে এই শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। জুয়া এবং অশ্লীল নৃত্য যাত্রাশিল্পে দুর্দিন নেমে আসার কারণও মনে করেন অনেকে। তারা বলেন, অশ্লীল নৃত্য এবং যাত্রা প্যান্ডেলে জুয়া যাত্রাশিল্প ধ্বংস হওয়ার একটি বড় কারণ। প্রশাসন যাত্রার অনুমতি দেয় না শুধু এই কারণে।
মূল কথা হলো— মূল সংস্কৃতি চর্চা সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা থেকে মানুষকে ফেরাতে পারে। এখন সমাজের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হলো সাম্প্রদায়িক মনোভাব। সামজে যার প্রভাব আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। সুস্থ সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ফাঁকেই মৌলবাদী গোষ্ঠীর পক্ষে সাম্প্রদায়িকতা বীজ বপন করা হয়েছে অত্যন্ত সুকৌশলে। এখান থেকে মানুষকে বের করতে পারে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। এজন্য অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে যাত্রাপালা সহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সবকিছুই সুস্থ ধারায় দ্রুতই ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবি। তাই শুধু পরিকল্পনা নিলেই হবে না, দ্রুত তা বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। এরমধ্য দিয়ে প্রাণ ফিরে পাবে সংস্কৃতি অঙ্গন। মুখরিত হয়ে ওঠবে গ্রাম বাংলা। উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হবে দেশজুড়ে। শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আশায় আশায় দিনগোনা মৃতপ্রায় মানুষগুলোও প্রাণ ফিরে পাবে আবারও। চাঙ্গা হবে অর্থনীতি। দূর হবে মানুষের অভাব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একটি আলোর দেখা পাবে। প্রজন্মকে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়—তবে বাংলাদেশে হবে শান্তির দেশ। হবে বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ। বদলে যাবে গোটা সামাজিক চিত্র।
লেখক: লেখক ও সাংবাদিক; সিনিয়র রিপোর্টার, জনকণ্ঠ