রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র; নতুন যুগের সূচনা
২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:০৬
পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই। অর্ধ শতাব্দী আগে শুরু হওয়া এই প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্তমানে ব্যবহার করছে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ। পারমাণবিক প্রযুক্তির আর্থিক, কারিগরি ও পরিবেশগত সুবিধাদির বিষয়টি বিবেচনায় এই প্রযুক্তি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা আজ সর্বজনবিদিত, যা দিন দিন প্রসার লাভ করছে। বর্তমানে ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্প জ্বালানী সম্পদের অধিকারী উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ এই পারমানবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে পারমাণবিক এই উৎপাদন প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আমাদের দেশে ১৯৬১ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুর-কে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। সেই হিসেবে ২০০৯ সালে সরকার ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে। ২০২১ সালের মধ্যে ২০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে ১৩ মে ২০০৯ তারিখে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। ১৫ মার্চ ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে পারস্পরিক সহায়তা সংক্রান্ত একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৩০ নভেম্বর ২০১৭—রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই এবং ১৪ জুলাই ২ ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লি বসানোর কাজের উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পথে পা দিয়েছে এবং দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণ করেছে। আশা করা যাচ্ছে ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ এ কেন্দ্র উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
বাংলাদেশে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সম্পর্কে অনেকের মধ্যেই একটা অজানা উদ্বেগ কাজ করে। এটা আমাদের সীমিত জ্ঞানের কারণেও হতে পারে। তবে জানা যায়, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন এবং আন্তর্জাতিক মান রূপপুর প্রকল্পে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একধরণের সন্দেহ সবসময়ই ছিলো, কিন্তু রাশিয়ার পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে এই প্রকল্পের বর্জ্য অপসারণের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা যায়, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের নির্মিত প্রযুক্তির অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় কোনো ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে না। এটাও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে যে কোনো দুর্ঘটনায় এর তেজস্ক্রিয় পদার্থ লোকালয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই এটাকে ঝুঁকিমুক্তই বলা যায়।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রথমেই প্রয়োজন পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ। দেশের সকল মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বর্তমান পারমানবিক বিদ্যুৎ দিয়ে যেসব সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে, তন্মধ্যে: পারমাণবিক প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বাধুনিক নিরাপদ প্রযুক্তি এবং নিশ্চয়তাদানকারী টেকসই উৎস, এটা জ্বালানী শক্তি আমদানিতে নির্ভরতা হ্রাস করে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি একটি উপায় যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে নির্ভরযোগ্য ও উন্নততর করে, আন্তর্জাতিক শক্তি-সরবরাহ বাজারে নিয়মিতভাবে তেল/গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা এবং জ্বালানি শক্তিতে উন্নত দেশসমুহে তেল/গ্যাস-এর মজুদ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল/গ্যাস-এর মূল্য সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাসের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে যথাযথ উপায়ে ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পাদনের মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন থেকে শুরু করে রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশের মানুষের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
আশার কথা, রাশিয়ায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভিভিআর ১২০০ এর দু’টি চলমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৮০ জন তরুণ নয় মাস থেকে দেড় বছর মেয়াদী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। যা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
একথা অনস্বীকার্য যে, দেশের স্বার্থে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী মহল, বিশেষজ্ঞ এবং সর্বস্তরের পেশাজীবীদের মাঝে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে তুলে ধরা গেলে এবং সঠিক ও নিষ্ঠার সাথে, সততার সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে উদ্যোগী হলেই যথাসময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সহজতর হবে।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হলে উৎপন্ন বিদ্যুৎ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও সচল ও মজবুত করবে। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
সফিউল আযম: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ