Friday 11 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমার মা


২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:০৯ | আপডেট: ৫ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:১৩
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আজ মায়ের চতুর্দশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬-এর ২৫ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে সকলের মায়া ত্যাগ করে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানের নিকট মা পরমারাধ্য। আমার জীবনেও মা প্রিয় মানুষ শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মায়ের স্নেহ-আদরে বড়ো হয়েছি। মায়ের পবিত্র মুখখানি যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মনে হয় এখুনি মায়ের কাছে ছুটে যাই। জন্ম থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মা যত্ন করে আমায় গড়ে তুলেছেন। মা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না। শৈশব আর কৈশোরের সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে দু’চোখ ভিজে আসে।

প্রতিবার নির্বাচনী জনসংযোগে যাবার প্রাক্কালে কাছে টেনে পরমাদরে কপালে চুমু খেয়ে সার্বিক সাফল্য কামনায় প্রাণভরে দোয়া করতেন মা। মমতাময়ী মায়ের কোমল স্মৃতি খুউব মনে পড়ে। আমার বাবা ১৯৭০-এর ২৫ এপ্রিল ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন জনসভা ছিল চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাইতে। বাবার মৃত্যু সংবাদ আমার আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে আমাদের প্রিয় নেতা এমএ আজিজকে জানিয়েছিলেন, ‘তোফায়েলের বাবা মৃত্যুবরণ করেছে। ’ সভা শেষে চাঁদপুর হয়ে ২৬ এপ্রিল সকালে গ্রামের বাড়ি পৌঁছাই। ততক্ষণে বাবার দাফন হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হয় ’৭০-এর ১৭ এপ্রিল। প্রতি বছর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে তাদের স্মরণ করি। কিন্তু এবার করোনা মহামারির কারণে সেটি সম্ভবপর হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবা-মায়ের সুখের সংসার। তিন ভাই চার বোনের মধ্যে আমার অবস্থান পঞ্চম। বিদ্যালয় জীবনের সূচনাতে নিজ বাড়িতে থেকে গ্রামের স্কুল কোড়ালিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এরপর বাড়িতে থেকে খায়েরহাট জুনিয়র হাই স্কুল হতে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করে বোরহানউদ্দিন হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই। আজকাল গ্রামে উপজেলায় অনেক হাইস্কুল হয়েছে। তখনকার দিনে এতো হাইস্কুল ছিল না। আমাদের এলাকা বোরহানউদ্দিনে একটি মাত্র হাইস্কুল ছিল, সেখানে ভর্তি হই। বোরহানউদ্দিন হাই স্কুলে আমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়েছে। স্কুলে তখন কোন হোস্টেল ছিল না। সেই ছোট্টকালেই যখন আমার বয়স মাত্র ১৩ তখন আত্মীয়-স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। কষ্ট হলেও মা আমাকে আদর করে লেখাপড়ায় নিয়মিত উৎসাহ যোগাতেন। সপ্তম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মান্নান স্যার (যিনি এখনো বেঁচে আছেন) বললেন, ‘তুমি ভালো ছাত্র। ভোলা সরকারি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে চারটি আসন খালি আছে, পরীক্ষা দাও। ’ শ’খানেক ছাত্র ভর্তি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। আমি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হই।

১৯৫৭’র জানুয়ারি মাসে ভোলা সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়ে স্কুল হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। শুরু হয় হোস্টেলে থেকে লেখাপড়ার পালা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মোট চৌদ্দটি বছর হোস্টেলে ছিলাম। মা আমাকে আদর করে ‘মনু’ বলে ডাকতেন। সবসময় বলতেন, ‘মনু, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো। ’ মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। মাকে ছেড়ে জীবনের প্রথম হোস্টেল জীবন। মন পড়ে থাকতো মায়ের কাছে। অপেক্ষায় থাকতাম কখন মায়ের কাছে যাবো। প্রতি সপ্তাহে ছুটির আগের দিন মায়ের কাছে চলে যেতাম। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধূলার প্রতি ছিল অপার আগ্রহ। বাবা-মায়ের আদরের ছিলাম। কখনোই কাছ ছাড়া করতে চাইতেন না। স্কুলের শিক্ষকগণ স্নেহ করতেন। মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক সচিব হিসেবে বরিশালে তার সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। প্রেজেন্টেশন লাইনে আমার স্কুলের শিক্ষক তসীর আহমেদ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তখন বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে বললাম, বঙ্গবন্ধু, আমার স্যার। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে বললেন, ‘তুমি এখনো সালাম করো নাই। ’ আমি দ্রুত তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। পরিবার, বিশেষ করে মা, শিক্ষালয় এবং বঙ্গবন্ধুর থেকে অর্জিত মূল্যবোধ দিয়েই গড়ে উঠেছে আমার জীবন ও আচরণ।

১৯৬০-এ ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এটা বেদনাদায়ক। তখন ছোট্ট একতলা কাঠের লঞ্চে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে ২৪ ঘণ্টা লাগতো। সেজন্য ঢাকা কলেজ ছেড়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হই। কলেজ থেকে সাপ্তাহিক ছুটিতে লঞ্চযোগে ভোলায় মায়ের কাছে একদিন থেকে ফিরে আসতাম। কলেজে ছাত্র অবস্থায় ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তারপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি, ডাকসু ভিপি, ছাত্রলীগ সভাপতি। ’৭০-এর ৩ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগে যোগদান। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ভোলা-দৌলতখাঁ-তজুমুদ্দী-মনপুরা আসনে আমাকে মনোনয়ন দেন। মাত্র ২৭ বছর ১ মাস ১৫ দিন বয়সে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। মনে পড়ে, ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের কথা। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জীবনের প্রথম জনসভা। সেদিন ছিল ‘শপথ দিবস’। স্লোগান তুলেছিলাম, ‘শপথ নিলাম শপথ নিলাম মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করবো। ’ আমরা সেই শপথ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছি। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে আসাদ-মকবুল-মতিউর-রুস্তম-আলমগীর শহীদ হয়। সেই দিনগুলোতে মা চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাতেন, প্রাণভরে আমার জন্য দোয়া করতেন।

’৭০-এর ১২ নভেম্বরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের প্রাক্কালে ভোলার দাসের হাটে আমার নির্বাচনী জনসভা ছিল। সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে যখন রওয়ানা করেছি, তখন মা কঠোরভাবে নিষেধ করে বলেছিলেন, ‘এই দুর্যোগের মধ্যে তুমি আজ যেও না। ’ মায়ের কথা রেখেছিলাম। নয়তো সেদিন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভোলার ৫ লক্ষাধিক লোকের সাথে আমিও মৃত্যুবরণ করতাম। মা এবং মাতৃভূমি আমার কাছে সমার্থক। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের দেরাদুনে মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলতাম, ‘প্রিয় নেতা, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন জানি না! যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন মায়ের কোলে ফিরে যাবো না। ’ সেদিনের সেই শপথও আমরা জীবনবাজি রেখে বাস্তবায়ন করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছি। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে আমি ও রাজ্জাক ভাই ১৮ ডিসেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ২৮ ডিসেম্বর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত মায়ের কোলে ফিরে আসি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দী। ১৫ আগস্টের দু’দিন পর ১৮ আগস্ট আমার বাসভবনে এসে খুনিদের অন্যতম মেজর শাহরিয়ার (যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ (তারও ফাঁসি হয়েছে) বলপ্রয়োগে আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে আমার উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীরের উপর দিয়েই আমায় টেনে নিয়েছিল ঘাতকের দল। ২৩ আগস্ট গৃহবন্দী অবস্থা থেকে জনাব ইএ চৌধুরী আমাকে এবং জিল্লুর রহমানকে বঙ্গভবনে খুনি মোশতাকের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থানরত খুনিচক্র আমাকে নানাবিধ প্রস্তাব ও মৃত্যুভীতি প্রদর্শন করা সত্ত্বেও সে-সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি।

’৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। আমি তখন কারাগারে। সারা দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা। দিনের পর দিন অবর্ণনীয় অবস্থায় কেটেছে। আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয়নি। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগ্নি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থেকেছেন। তিনি একবছর ছিলেন কলাবাগানে। মা এই বাসায় থেকেছেন এবং সেই কঠিন দিনগুলোতে কষ্টকর জীবন যাপন করেছেন। সে-সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সামান্য টাকা ছিল। জিয়াউর রহমান অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছিল। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেওয়ার বহুরকম চেষ্টা করেছে। কোন দুর্নীতি আবিষ্কার করে মামলা দিতে পারেনি। আমার বনানীর বাড়ী-এই বাড়ীর জমি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন-’৭৫-এর ৩০ জুলাই বরাদ্দ হয় আমার স্ত্রীর নামে। আমার বড় ভাই ’৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই যখন হলিফ্যামিলি হাসপাতালে মা তখন অসুস্থ। আমাকে বলেছিলেন মাকে দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি গিয়েছিলাম। মা বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই মায়ের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। সংবাদ পেয়ে বঙ্গবন্ধু আমার তৎকালীন সরকারি বাসভবনে এসে আমাকে আদর করে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আমার ভাইয়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করে মৃতদেহ হেলিপ্যাডে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ভোলায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। সে-সময় যতদিন ভোলায় ছিলাম-১২ থেকে ৩০ জুলাই-প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু আমার খবর নিতেন।

আমার এপিএস ছিল শফিকুল ইসলাম মিন্টু। ১৫ আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে কতিপয় সেনাসদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজী না হওয়ায় মিন্টুকে হত্যা করে। তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। আমার মেজো ভাইকে গ্রামের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ’৭৫-এর ৫ অক্টোবর খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমি তখন ময়মনসিংহ কারাগারে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে বন্দী। তিন ছেলের দু’জন মৃত একজন কারাগারে। মায়ের তখন করুণ অবস্থা। এই অসহায় অবস্থায় মা জীবন কাটিয়েছেন। আমার মেয়ে ডাঃ তাসলিমা আহমেদ জামান মুন্নী ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতো বড় হয়ে ডাক্তার হবে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মা ওকে ভীষণ আদর করতেন। মায়ের স্মৃতি আমার মেয়ে ধরে রেখেছে। মা যখন চিকিৎসাধীন আমার মেয়ে ও জামাতা উভয়েই মায়ের সেবা-যত্ন করেছে।

’৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আমি ৩৩ মাস ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দী ছিলাম। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এলে ’৮৩-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাকে গ্রেফতার করে প্রথমে সেনানিবাসে পরে সিলেট কারাগারে প্রেরণ করে। সিলেট কারাগারে গিয়ে মা আমার সাথে দেখা করেছেন। সেদিন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমাদের ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর ’৮৪-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার স্মৃতিসৌধে গ্রেফতার করা হয়। ’৮৫ সালে আমাকে গ্রেফতার করে ১৫ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রেখে পরে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়। ’৮৭ সালে ভোলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন সংসদ সদস্য। গ্রেফতার সংবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে এলে আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যে বরিশালে কারাগারে নির্জন কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। ’৯৬-এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন চলাকালে আমাকে গ্রেফতার করে রাজশাহী কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত ভোলায় গ্রামের বাড়িতে তাণ্ডব চালায়, আমার গাড়ি ভাংচুর করে। বৃদ্ধ বয়সে আমার মাকে এসব দেখতে হয়েছে।

২০০২-এ সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণের পর আমাকে গ্রেফতার করে কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখে। পরে কুষ্টিয়া কারাগারে প্রেরণ করে। ২০০২-এ মায়ের বয়স তখন ৮৮ বছর। অসুস্থ শরীরে তিনি আমাকে দেখতে কুষ্টিয়া কারাগারে ছুটে গিয়েছেন। এক নজর মায়ের মুখখানি দেখে মনে অনাবিল শান্তি অনুভব করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বমোট ৭ বার আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি কারাগারে আমার বৃদ্ধা মা ছেলেকে দেখার জন্য ছুটে গিয়েছেন। সে কি কষ্ট! জেলগেটে যখন মা আমার সঙ্গে দেখা করতেন সর্বক্ষণ আমার মাথা মায়ের বুকে থাকতো। যখন তিনি আমাকে রেখে বিদায় নিতেন, তখন তাঁর দু’চোখে অশ্রুর নদী। দুই ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে এক ছেলে কারান্তরালে। কি নিঃস্ব রিক্ত আমার মা!

সেই দুঃসময়ের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। ’৯৬-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে আমি শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী। বেইলি রোডে অবস্থিত বাসভবন ‘তন্ময়’-এ থাকি। মা আমার সঙ্গে থাকতেন। প্রতিদিন মায়ের আদর নিয়ে দিনের কাজ শুরু করতাম। বনানীর বাড়িতে আমার শয়ন কক্ষের পাশেই মায়ের ঘর। সকালে ঘুম ভাঙার পর মায়ের স্নেহের আলিঙ্গন ছিল নিত্য দিনের পাথেয়। মাকে চুমু দিয়ে সকালে বের হতাম, না ফেরা পর্যন্ত জানালার কাছে তস্বিহ হাতে নিয়ে মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ঘরে প্রবেশ করেই মাকে চুমু দিয়ে শয়নকক্ষে যেতাম। আমার বন্ধু-বান্ধব-স্বজন প্রত্যেককেই মা অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। মা যখন অসুস্থ প্রত্যেকেই তার সেবা-শুশ্রুষা করেছেন। গুলশানস্থ শিকদার হাসপাতালে মায়ের শেষজীবনের চিকিৎসাদি চলে। প্রায় দু’বছর তিনি বাসা এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুর দু’দিন আগে আমি যখন নিজ হাতে মাকে খাওয়াচ্ছি তখন তিনি ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় মা বলেছিলেন, ‘তুমি কী আমাকে মরতে দেবে না?’ আমি বলেছিলাম, মা আপনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তখন আমাকে দোয়া করবে কে? মা বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি আল্লাহ্র কাছে রেখে গেলাম। আল্লাহ্ই তোমাকে হেফাজত করবেন। ’ এটাই ছিল মায়ের সাথে আমার শেষ কথা। মা চিকিৎসাধীন থাকাকালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ফোনে খবরাখবর নিয়েছেন, মায়ের মৃত্যুদিনে বনানীর বাড়িতে এসে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধুর চেতনায় গড়ে উঠেছে আমার রাজনৈতিক জীবন আর মায়ের মানবিক গুণাবলীতে বিকশিত হয়েছে ব্যক্তি জীবন। ’৭৩-এ ভোলার বাংলা বাজারে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছি ‘ফাতেমা খানম গার্লস হাই স্কুল’। সেখানে আজ ৬০ বিঘা জমির উপর মায়ের নামে ‘ফাতেমা খানম ডিগ্রি কলেজ’, ‘ফাতেমা খানম মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র’, ‘ফাতেমা খানম এতিমখানা’, ‘ফাতেমা খানম জামে মসজিদ’, ‘ফাতেমা খানম বৃদ্ধাশ্রম’সহ গড়ে উঠেছে সুবিশাল ‘ফাতেমা খানম কমপ্লেক্স’। এই কমপ্লেক্সে গরীব-দুখির চিকিৎসা সেবায় পিতা-মাতার নামে ‘আজহার-ফাতেমা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর পাশেই নির্মিত হয়েছে অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন করেন। এখানে সংরক্ষিত আছে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জাতির জনকের ঐতিহাসিক অবদানের স্মৃতি-নিদর্শনসমূহ।

মায়ের নামে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ করার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বঞ্চিত মায়েদের সেবাপ্রদান। ভোলা গেলে বৃদ্ধাশ্রমে অবস্থানরত মায়েদের সঙ্গে দেখা করি। এখানে এমন মা আছেন, যার পুত্র এবং পুত্রবধূ উভয়েই ডাক্তার, এমন মা আছেন যিনি অনার্স পাস। কিন্তু তারা এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেই পছন্দ করেন। যখন সেখানে যাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেন। তাদের মাধ্যমে মায়ের ভালোবাসা-আদর অনুভব করি। মায়ের শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। সকলের মতো আমিও মনে করি আমার মা-ই শ্রেষ্ঠ। ঘুম ভাঙার পর যখন লাইব্রেরি কক্ষে আসি তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার ছবি, তার পাশে মায়ের সঙ্গে আমার ছবিটির নিচে দাঁড়াই। বঙ্গবন্ধু এবং মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে জীবন আমার ধন্য। মা সর্বদা অপরের কল্যাণের কথা ভাবতেন। আমার প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল, ‘বাবা, কেউ যদি তোমার কাছে হাত পাতে, কাউকে খালি হাতে ফেরত দিও না। ’ যখন ভোলা যাই যতটুকু পারি মায়ের নির্দেশ পালনের চেষ্টা করি। এমন মমতাময়ী মায়ের সন্তান হতে পেরে আমি গর্বিত, ধন্য!

ভোলায় গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে আমার পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত, সেখানে কবর-ফলকে হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলি উৎকীর্ণ আছে এভাবে-

‘মা, বাবা চলে গেছেন অনেক আগে
চির নিদ্রায় শায়িত আছেন তোমারই পাশে
তুমিও চলে গেলে আমাদের
সকলকে কাঁদিয়ে,
তবুও তোমরা আছো সর্বক্ষণ
আমাদের হৃদয় জুড়ে।
মা, প্রতি মুহূর্ত তোমাদের অভাব
অনুভব করি। ’

তোমার মনু (তোফায়েল)

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর