মাননীয় মন্ত্রী, আপনি ইতিহাসের ভুল পাঠ দিচ্ছেন
৬ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৪৫
৪ঠা জানুয়ারি ছিল ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। ১৯৫৩ সালে যা ধর্ম নিরপেক্ষ চেতনায় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ হয়ে উঠে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরের বছর—১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। প্রতিষ্ঠাকালীন সেই সংগঠনের নামও ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ যা ১৯৫৫ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’-এ রূপান্তরিত হয়।
ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করা এই ছাত্র সংগঠনটির ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। তারা স্মারক ডাক টিকেট উন্মোচন করেছেন। ডাক টিকেট উন্মোচন করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব সময়ে ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন।
কিন্তু ডাক বিভাগ উন্মোচিত এই স্মারক ডাক টিকেটে ভয়াবহ ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। লেখা হয়েছে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী”। যে নাম ১৯৫৩ সালে বাতিল করে দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের রূপান্তর—সেই নাম ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ। ১৯৫৩ সালের পর ছাত্রলীগ নিজে কখনও ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেনি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মহোদয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে একজন অত্যন্ত বিনয় সহকারে প্রশ্ন তুলেছেন— ‘এতে কি সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পাচ্ছেনা?’ মন্ত্রী মহোদয় বেশ উষ্মা নিয়ে উত্তর দিয়েছেন—এটি সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে প্রশ্নকারীর মনে!
মোস্তাফা জব্বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য নয়, সে হিসেবে তাকে সরাসরি জনপ্রতিনিধি বলা যায় কি-না জানি না। তবে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসেবে জনগণের প্রতি অবশ্যই তার দায়বদ্ধতা আছে। একজন নাগরিকের অত্যন্ত বিনীত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী হিসেবে উষ্মা প্রকাশ করার সুযোগ তার আছে কি-না, সে প্রশ্ন ও উহ্য থাক।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে ইতিহাস ও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। যে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১৯৫৩ সালে, যে পূর্ব পাকিস্তানের কবর আমরা রচনা করেছি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে—বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তির সময়ে সেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের মহান দায়িত্ব মাননীয় মন্ত্রী ও তার ডাক বিভাগকে কে দিলো? ৪ জানুয়ারি তবে ছাত্রলীগ সারাদেশে কোন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করেছে—বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নাকি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন, তিনি কি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতেন?
‘৭৩ বছর আগে যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল তার নাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল, তাই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সে সময়ের নাম ব্যবহার করা হয়েছে’— এমন যুক্তি যদি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় পেশ করেন, তাহলে পাল্টা প্রশ্নের সুযোগ তৈরি হবে। এ বছর ২৩ জুন কি ‘আওয়ামী লীগ’-এর ৭২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে, নাকি ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর? সম্ভাব্য যুক্তি অনুযায়ী ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’রই হওয়ার কথা!
৯০ দশকের ছাত্রলীগের একজন ক্ষুদ্র কর্মী এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সচেতন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ও দায়িত্বশীল মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের ইতিহাস বিকৃতির নিন্দা জানাচ্ছি। ইতিহাস বিকৃতির সবচেয়ে গভীর শিকার আওয়ামী লীগ স্বয়ং। ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে বারবার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে, এখনও সে চেষ্টা চলছে। কেউ কোনোভাবেই যেন নিজের অজান্তে সেই সুযোগ প্রসারিত না করেন, সতর্ক থাকা জরুরি বলে মনে করি।
লেখক: লেখক ও গবেষক