Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধ করুন


১৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:০৪

করোনা মহামারির প্রকোপে লকডাউন পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য হলেও ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যা কিছুটা কমেছিল। নিউ নরমাল জীবন শুরু হতে না হতেই আবার শুরু হয়েছে বায়ুদূষণের মহোৎসব। বায়ুদূষণের শহরের মধ্যে ঢাকা শীর্ষ দশ থেকে নেমে গেছে। পুনরায় ‘যেই সেই’ অবস্থা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। কারণ বায়ুদূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এতদিন প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লি ছিল বায়ুদূষণে শীর্ষে। সেই দিল্লির চেয়ে দ্বিগুণের বেশি দূষিত এখন আমাদের এই ঢাকা। টানা কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণে ঢাকা বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে প্রথম দিকেই থাকছে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান-এয়ার ভিজুয়াল জানায়, একিউআইয়ের (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) সূচক অনুযায়ী বিগত সপ্তাহে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল ঢাকার বাতাস। কে না জানে, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস যানবাহন, সড়ক ও বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ। একই সঙ্গে রাজধানীর চারপাশের ইটভাটাগুলোও দূষণের অন্যতম কারণ। বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস যখন ধুলোবালি তখন এই মহামারিকালে করোনাভাইরাসের জীবাণু সহজে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন’ সম্প্রতি বায়ুর মানের দিক থেকে এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা দিয়ে জানায়, ‘বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ এমন এক দুষিত পরিবেশে বাস করছে, যেখানকার বাতাসের মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনে থাকা পিএম ২.৫ মাইক্রন স্তরের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদফতরের মানমাত্রায় মানুষের স্বাভাবিক বায়ু গ্রহণ ক্ষমতা ৫০ একিউআই। সেখানে ঢাকার বায়ুদূষণ সূচক ৫০২। দূষণকবলিত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’-এর মতে, ‘বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকার পরিবেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা বলাই বাহুল্য। বাতাসে ভাসমান কণা, পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম বা সূক্ষ্ম ভাসমান কণা) শারীরিক সমস্যার অন্যতম কারণ। ঢাকাসহ বড় বা মাঝারি শহরের বাতাসে ভাসমান কণা বেশি রয়েছে। এর ফলে ছোটদের শ্বাসনালীর সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষত, যারা বাড়ির একতলায় থাকেন, তারা বেশি দূষণের শিকার হচ্ছেন। বয়স্কদের ঝুঁকি আরও বেশি। বেশি বয়সে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বার বার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। বাড়ে হৃদরোগ এবং ব্রেইন স্ট্রোকের আশঙ্কাও। তাই প্রায়ই দেখা যায়, রেগে গিয়ে চিৎকার করতে করতে কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এছাড়া যাদের বাড়ির আশেপাশের বাতাস দূষিত, তাদের কোনো কারণ ছাড়াই রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি ঘটে।

সম্প্রতি ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকার এক গবেষণায় প্রকাশ, বায়ুদূষণের কারণে অন্য অসুখ-বিসুখের পাশাপাশি অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস নামক রোগের গতি বাড়ছে। যার অর্থ, রক্তবাহী ধমনীতে চর্বি জমে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাভাবিক নিয়মে বয়স বাড়লে, ওজন বেশি হলে এবং ভুল খাদ্যাভ্যাসের ফলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস হয় ঠিকই। তবে বায়ুদূষণ এই রোগের গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে হৃদরোগ ও ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। বিশ্বব্যাপী সমীক্ষায় প্রকাশ—প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ২৭৫০ জন মারা যায় বায়ুদূষণজনিত নানা শারীরিক সমস্যায়। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন— বাতাস, শব্দ-সহ অন্যান্য দূষণ মানুষ ও পরিবেশের অন্য প্রাণীদের উপর কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গাড়ি ও কারখানার ধোঁয়ার পাশাপাশি বাড়িতে রান্নার জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত লাকড়ির চুলা বা কেরোসিন স্টোভের ধোঁয়াও আমাদের হৃদপিণ্ড, ফুসফুস-সহ সামগ্রিক শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। রান্নার ধোঁয়াতে থাকে সূক্ষ্ম ভাসমান কণা। যেগুলো অত্যন্ত ছোট্ট (২.৫ মাইক্রন)। বিপদ ডেকে আনে এরাই। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় এই ভাসমান কণাগুলো শ্বাসনালী দিয়ে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা জানান, পিএম ছাড়াও দূষিত বাতাসে থাকে নাইট্রোজেন, সালফার ও কার্বন মনোক্সাইড। এসব রাসায়নিক একই সঙ্গে ধমনীর ভেতরে লাইনিং-এর কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দেয়। এর ফলে হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কের ধমনীতে কোলেস্টেরলের প্রলেপ জমে। ফলে প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট-সহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এভাবে বাতাসের ভাসমান কণা হৃদরোগীদের ‘কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেইলিওর’-এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে হৃদরোগ এবং ব্রেইনস্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

ঢাকার বিষাক্ত বাতাসের যে চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি এবং এর প্রভাবে মানুষের রোগব্যাধির কথা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাতে আমাদের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। শীতকালে এমনিতেই বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ এ সময়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা দূষণকারী পদার্থ ওপরে উঠতে পারে না। সম্প্রতি স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০২০-এর গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা করে যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই), ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস ও ইভালুয়েশনস গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ প্রোজেক্ট। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে ৭৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর বিশ্বজুড়ে মারা গেছে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ নবজাতকও রয়েছে।

ঢাকা এমনিতেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বায়ু, পানি, শব্দ সব দিক থেকেই পরিবেশ দূষণের আয়োজন এখানে। ঢাকায় পর্যাপ্ত গাছপালা ও জলাধার নেই। একটি শহরের অন্তত বিশ ভাগ বৃক্ষাচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় তা মাত্র ৩/৪ ভাগ। ফলে বিপুল পরিমাণ নির্গত কার্বন গ্যাস অক্সিজেনে পরিণত হতে পারে না। আবার পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায়, ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। ফলে সারা বছরই এসব ধূলিকণা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে উড়ে বেড়ায়। বিশেষত শুষ্ক মৌসুম বা শীতে ঢাকার বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত জলাধারের অভাবে বালু, অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা পানিতে থিথু হতে পারে না।

দীর্ঘমেয়াদী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব ভয়ংকররূপে প্রতিভাত হলেও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা আমাদের হতাশ করে। বায়ুদূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান আমাদের যতোই হতাশ করুক আমরা বিস্মিত নই। বায়ুদূষণ রোধে পরিকল্পিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক। জানা যায়, ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে রাজধানীতে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও ২০১৯ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর পরও বায়ুর মান উন্নয়নের কিছুই হয়নি। স্থাপনা তৈরি কিংবা ইমারত নির্মাণের যথাযথ বিধি থাকা সত্ত্বেও মানা হয় না। ভবন তৈরির সময় নির্মাণ কাজ কোনো কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া কিংবা পানি ছিটিয়ে কাজ করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা যেমন হয় না, তেমনি এসবের তদারকিও নেই। এছাড়াও উন্নয়নমূলক কাজ যেমন ফুটপাত সংস্কার, উড়াল সেতু নির্মাণ ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চললেও সেখানে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। পরিবহনের ধুলাবালি কমাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছেই না, বরং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন। ইটভাটাগুলো আধুনিকায়ন হলে দূষণও বহুলাংশে কমবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় এসব দূষণ প্রতিরোধে প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

বায়ুদূষণ মোকাবিলার জন্য দূষণের উৎসে হাত দেওয়া জরুরি। আমাদের উচিত এখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা অবলম্বন করা। অপরিকল্পিত শিল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা ও নির্মাণকাজ নিয়মিত তদারকি করা। সিটি করপোরেশন যদি যথাসময়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারে ও রাত পোহাবার আগেই রাস্তা ধুয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে ঢাকার বায়ুদূষণ ও করোনা কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয় বাড়ানো প্রয়োজন। আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে বায়ুদূষণ রোধ করা অতি জরুরি।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বায়ুদূষণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর