Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বুক বেঁধে দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিসনে ভাই’


১৮ মার্চ ২০১৮ ১৬:১৬

হাজার বছরের শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, দারিদ্র্য শেষ কথা নয়। অবিশ্রান্ত জীবনের পথচলা, মানুষের অসামান্য সৃজনক্ষমতা ইতিহাসকে থামতে দেয়নি। ক্রমাগত পথ কেটে চলেছে। পুরনো যা কিছু অপরিবর্তনীয়, অনতিক্রম্য মনে হতো কোনোকালে, কালের পরিক্রমায় তাই হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক। মানুষের এ যাত্রায় ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ একদল অগ্রপথিক। নিশ্চল, স্থানু অচলায়তন ভেঙে মানুষের ইতিহাস অগ্রসরমানতার ইতিহাস।

বিজ্ঞাপন

এখনো বিপুল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অনটন, পশ্চাদপদতা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। ক্ষুধা পেটে নিয়ে রাতে বিপুল মানুষ ঘুমোতে যায়। সাঈদীর মুখাবয়ব ‘চন্দ্রে দর্শনে’র আষাঢ়ে গল্পে কিছু মানুষ উম্মত্ত তাণ্ডবে মাতে। বিগত শতাব্দীর সূচনায় যে দেশে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে নেমেছিল অসামান্য সৃজনশীল তরুণ, হোক তা সংখ্যায় নগণ্য, সে দেশে বুদ্ধি, যুক্তির কথা বলার জন্য, দীপ্তিময় তরুণ বুদ্ধিজীবী থেকে পক্ককেশ পরিণত বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্বদেশ সিক্ত হয়। ঋণের অনন্ত চক্করে ঘুরে ঘুরে চাষা গলায় দড়ি দেয় বা তার বাস্তুভূমি ছেড়ে পালায়। এ দেশেই হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে, জনতার তিল তিল আমানত সিঁদ কেটে নয়, প্রকাশ্য আলোয় চুরি করে প্রাইভেট হেলিপ্যাড বানায় কেউ কেউ।

বিজ্ঞাপন

যদিও এ দেশের উন্নয়ন বাজেট আর পরনির্ভরশীল নয়। প্রবৃদ্ধির চাকাও সচল। প্রতি বছর স্ফীত হয় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়। রাজধানীর মীরপুর রোড ধরে এগিয়ে গেলে ডানে, বাঁয়ে তাকালেই শপিং মল আর মল। বসুন্ধরা, যমুনা, মিমি… কোনো মার্কেটই ক্রেতাশূন্য নয়। যেকোনো বড় শহরেই বড় কিংবা ছোট সড়কে দাঁড়ালেই সারি সারি অজস্র ঝাঁ চকচকে গাড়ি আর গাড়ি। কবেই পেরিয়েছে দেশের বাজেট লক্ষ কোটি!

এক কোটি মানুষ প্রবাসী। তৈরি পোশাক শিল্প ও তার ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে ও কাজে আছে প্রায় কোটির কাছে মানুষ। হাজারে নয়, লাখ লাখ নারী প্রতিদিন ছোটে কাজে। এটাও মনে রাখতে হয়, দারিদ্র্যের দুঃসহ ভার কমেছে অনেক। মঙ্গাক্রান্ত অঞ্চল মুক্ত হয়েছে অনেকখানি। ভিখিরি কমেছে। কাজ বেড়েছে। শিশু মৃত্যু কমেছে। শিক্ষা বেড়েছে। আয়ু বেড়েছে।

তবুও কি এই সত্য নয়, এ দেশে এত টাকা কামিয়েও ধনবানরা ছুটছে বিদেশে পাড়ি জমাতে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ নিদেনপক্ষে মালয়েশিয়া পছন্দের তালিকায়। নিজের জন্য না হলেও, সন্তানের জন্য হলেও চাই-ই চাই। তাহলে কি ধনবানদের জন্য বাংলাদেশ ‘কমফোর্ট জোন’ নয়? কি অবস্থা ভিন্ন প্রান্তে? বাড়ি-বাড়ি কাজ করা, গ্রাম থেকে দুটো ভাতের জন্য শহরে আসা মেয়েরা আজ গার্মেন্টসে কাজ করছে। সেও কি আছে ‘কমফোর্ট জোনে’? মধ্যবিত্ত? সে কি ভালো আছে? সাধ আর সাধ্যের প্রতিনিয়ত দহনে জ্বলছে সে-ও। কাজ চাই মন মত। নাই। খাবার, তাতে ভেজাল ভর্তি। যাতায়াত দুঃসহ। ফসল হয় বাম্পার, দাম মেলে না।

না, ‘কমফোর্ট জোনে’ এই জনপদে কেউ নেই! সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের জীবন এত সস্তা আর অনিরাপদ ও অনিশ্চিত। তাই সবচেয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠের জীবনে এত এত অর্থ সমাগম। মধ্যবিত্ত ইজ্জত(!) নিয়ে বেঁচে-বর্তে আছে। এমন একটা সমাজ, যেখানে সবকিছু নিয়ে কামড়া-কামড়ি। অথচ, উন্নয়নের যে চোখ ধাঁধানো গল্পের দিনগুলো আমরা পার করছি, সে দিনগুলোতে এত উন্নয়নের দিনে ন্যূনতম স্থিতিশীলতা নেই। কী বিষ্ময়! তবুও খেয়ে-পরে বেঁচে আছি, এই-ই তো বেশ।

কালের স্বাভাবিক গতিতে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ পরিবর্তন আসেনি। লাখো লাখো মানুষের জীবনদান, কোটি কোটি মানুষের ত্যাগ আমাদের এ অবধি অর্জনের ভিত্তি তৈরি করেছে। এতদূর অবধি যে কথাগুলো বলতে চেয়েছি, তা কারোরই অজানা নয়। একটু চোখ কান খুলে রাখা মানুষের জন্য তো বটেই। কিন্তু ‘বীরের এ আত্মদান, মাতার এ অশ্রুধারা, সবকিছু ধূলায় হবে কি হারা?’ বাসযোগ্য স্বদেশ গড়ার সংগ্রাম কি মুখ থুবড়ে রইবে?

একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই একটু আত্মজিজ্ঞাসার জন্যই এসব কথার অবতারণা। কেউ কি এ দেশে আজ স্বপ্ন দেখে, এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব? যদিও বা দেখে, তাহলেও কি সে স্বপ্নে সঁপে নিজেকে? কেন, আমাদের স্বপ্নের এ দশা? আমাদের বিগত পুরুষেরা কি স্বপ্নের বৃক্ষ রচেননি?

মাত্র কদিন আগে, ৬ মার্চ সিপিবি তাঁদের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করল। এ দলের জন্ম প্রায় ৯০ বছর আগে ব্রিটিশ ভারতে। এ অবধি দলটি প্রবাদ-প্রতিম ত্যাগ, নিষ্ঠা, অঙ্গীকারের ঐতিহ্য স্থাপন করেছে। ব্রিটিশ ভারতে, পাকিস্তান আমলে তো বটেই এমনকি যে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে সে অঙ্গা-অঙ্গীভাবে যুক্ত, সে বাংলাদেশেও এ দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে। এর নেতা-কর্মীদের রক্ত ঝরেছে। যুগের পর যুগ কারাগারে কাটিয়েছে এর নেতা-কর্মীরা। তবুও, স্বদেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য তারা প্রাণপণে সঁপেছেন।

এ দেশের প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, ঘন অমানিশায় অথবা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও এই দলের নেতা-কর্মীদের অভূতপূর্ব আত্মদানের পরও এরা কেন আজ অবধি রাজনীতির মুখ্য কুশীলব নন?

গত ৭০ বছরের ইতিহাসে ৮০’র দশকে সিপিবির ক্রমাগত জনভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সময়টা ছিল সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের। গণতন্ত্র মানে নিছক ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল। আন্দোলনে এই প্রশ্নের সাথে যুক্ত হয় ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর-পেশাজীবীদের দাবি-দাওয়া। এমনকি সংবাদপত্র, বিচার বিভাগ, বাকস্বাধীনতাসহ নানান ইস্যুগুলো আন্দোলনের মাঠে আসে। অতীতের যেকোনো আন্দোলনের তুলনায় শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের রুটি-রুজির ন্যূনতম ইস্যুতে সংগঠিতভাবে একযোগে সারাদেশে নিজেদের অবস্থান প্রদর্শনে সক্ষম হয়।

এ আন্দোলনগুলোতে সিপিবির নিরবচ্ছিন্ন ও সচেতন উদ্যোগ ছিল অনস্বীকার্য। ফলে সিপিবি ক্রমশ মেহনতী শ্রেণীর মধ্যে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে যেমনি সক্ষম হয়, একই সাথে আন্দোলনরত শক্তিগুলোর মধ্যে নিজেদের অপেক্ষাকৃত দৃষ্টিতে আনতেও সাফল্য অর্জন করতে থাকে।

তবে পরিতাপের বিষয় হল, সিপিবি ছাড়াও অপরাপর কার্যরত বাম দলগুলো পৃথক এবং স্বতন্ত্র জোটে অবস্থান নেওয়ায়, বামপন্থার একটি সংগঠিত শক্তি মাঠের লড়াইয়ে যেভাবে দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এই দশকে সিপিবি তার এ যাবত ইতিহাসের চূড়ায় পৌঁছলেও, স্বৈরতন্ত্র অবসানের পর তার ক্রম অধোগতিও দৃশ্যমান। বিশেষত এই দশকের শেষভাগে এক একটি প্রলয়ংকরী ঝড়ে খসে পড়তে থাকে তার পাখার পালকগুলো। এমনকি তার নেতৃত্বের সিংহভাগ খোদ দলই পরিত্যাগ করে।

বার্লিন দেয়ালের ভাঙ্গন, পূর্ব ইউরোপে এবং খোদ সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের যে ধাক্কা, তাকে সামলে বিকাশের নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও সিপিবি পরিণত হয় ক্রমশ প্রান্তিক হতে থাকা একটি দলে। গত আড়াই দশকে রাজনীতির মাঠে সিপিবি কিংবা অন্য কোনো বামপন্থী দল জন-আস্থার নিকটবর্তী হতে পারছে না। সে রকম কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। সমসাময়িককালে নানান ঐক্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু বামপন্থী দল আরও বিভক্ত হয়েছে। নিজেদের অটুট ঐক্যের ও নমুনা রাখতে পারেনি।

দেশে বামপন্থার রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট দলের নেতা-কর্মীদের বিপুল আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও আশা জাগানিয়া কোনো সংবাদ তারা দিতে পারছেন না। বিপরীতে, যে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো দেশে বিদ্যমান তারা যে মানুষের জন্য ইতিবাচক সম্ভাবনার কোনো সংবাদ দিতে পারছেন, তা-ও নয়। ফলে যা ঘটছে, তা হল খোদ মানুষই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। হতাশা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এবং আশাহত মানুষের কোনো কোনো অংশকে টানছে উগ্রধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি। বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। গোটা পাকিস্তানি আমলে খোদ রাষ্ট্রশক্তি প্রতিকুলে থাকার পরও, বিবেকবান মানুষ ততটা অসহায় বোধ করেননি, আজ যতটা করছেন। ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছে থাকা পুরনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো ন্যূনতম গণতান্ত্রিক বিধি বিধানের ভিত্তিতে ও দেশ চালাতে ব্যর্থ, নয়া সূর্যোদয়ের আভাষ নেই, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পোয়াবারো যেন ঠেকায় কে?

এই অবস্থা কেন? এ অবস্থা কি চলতে দেওয়া যায়? না, যায় না। সুতরাং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা আজ জরুরি কর্তব্য বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

আমাদের দেশে ঠিক এ মূহূর্তের প্রধান সংকট কী? এ প্রশ্নের কোনো সাধারণ উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। উত্তর শুনে আবার ধরে নেওয়া হবে, তিনি হয় বিএনপি-জামাত কিংবা আওয়ামী লীগ সমর্থক। চিন্তার ক্ষেত্রে এটা যেন একটা অলিখিত ধারা হয়ে পড়েছে। চিন্তার এই বাইনারি পদ্ধতি স্বাধীন ও সুস্থ চিন্তার বিকাশের প্রবল অন্তরায়। এর বাইরে গিয়ে যদি যুক্তির সাধারণ সূত্র ধরে এগুতে চাই, যদি বলি, মানুষ কী চায়? এক শব্দে শান্তি চায়। শান্তি নাই কেন? কোনো কাজই নিয়ম মতো হয় না। যে কাজই করতে যাই না কেন, সর্বত্র উচ্চারিত কিছু শব্দ শান্তির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে শুনতে হয়। আমরা সে শব্দগুলো খুঁজি। ঘুষ, দুর্নীতি-চাঁদাবাজি, লুটপাট, সন্ত্রাস, দখল, জোর জবরদস্তি, নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, আদিবাসী নির্যাতন, মন মতো কাজের অভাব, শিক্ষাপ্রাপ্তির অভাব ইত্যাদি।

কারা এসব প্রতিবন্ধকতা তথা অশান্তির কারণ? প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় থাকলে এসব করেও যেহেতু পার পাওয়া যায়, কাজেই ক্ষমতা কেন্দ্রের কোনো না কোনো আশীর্বাদপ্রাপ্তরা এটা করে থাকে। আর এসবের সাথে অর্জন হল বিপুল অর্থ ও প্রতিপত্তি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ কেবলমাত্র বামপন্থীদের একক কাজ নয়। অপরাপর বুর্জোয়া, উদারনৈতিক শক্তির জন্য ও তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনকে সুগভীর ও অর্থবহ করার জন্য যেমন, তেমনি তার স্থায়িত্বের জন্যও চাই জনগণের ব্যাপকতম অংশের অংশগ্রহণ। লুপপাটতন্ত্রের সাবেক ও বর্তমান বেনিফিসিয়ারি শক্তি এই কাজ করতে অনিচ্ছুক ও অক্ষম।

তদুপরি, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির বাইরে উদারনৈতিক বুর্জোয়া শক্তির উপস্থিতি যেমন ক্ষুদ্র, তেমনি তার চেয়েও অনেক বেশি জড়বৎ অবস্থানে। স্পষ্টতই, জনগণের ব্যাপকতম অংশের অংশগ্রহণ মানে মেহনতীদের অংশগ্রহণ। এবং তা নিশ্চিত করার জন্য চাই মেহনতীদের নিজস্ব এজেন্ডা। এযাবৎ দৃশ্যমান কিংবা ক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের মধ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আকারে ক্ষুদ্র হলেও তা অপেক্ষাকৃত গতিশীল।

কিন্তু মুশকিল হল, এই বামপন্থা রাজনীতির লড়াইটা করছে অন্যের চত্বরে দাঁড়িয়ে। নিজের প্রাঙ্গণে অপরাপর শক্তিগুলোকে টানতে সে সক্ষম হয়নি। কার্যত নিজের প্রাঙ্গণ নির্মাণ কাজ ও সে সম্পন্ন করতে পারেনি। গত এক যুগের রাজতন্ত্র উত্তর ও রাজতন্ত্র পূর্ব এক দশকের মাওবাদীদের লড়াই থেকে শিক্ষা নেবার দারুণ উপকরণ রয়েছে হাতের কাছেই।

কথাটা বলার কারণ হল, ১৯৯৬ সনে মাওবাদীরা সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছিল ৪০ দফা দাবিতে। এবং লড়াইয়ের বর্শাফলক নির্মাণ করেছিল রাজতন্ত্রের পূর্ণ বিলুপ্তির দাবিকে। ফলে, তখন পর্যন্ত বড় দল নেপালি কংগ্রেস ও বড় বাম দল ইউএমএল রাজতন্ত্রের সাথে নানাবিধ দেন দরবার এক সময় ছুঁড়ে ফেলে রাজতন্ত্র অবসানের আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে।

আজ ইউএমএল মেজরিটি পার্টি হওয়া সত্ত্বেও, নেপালি কংগ্রেস এখন অবধি বড় দল হওয়া সত্ত্বেও শেষ অবধি একটি সেক্যুলার রিপাবলিক নির্মাণ, কনস্টিটিউশন তৈরি এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশের যে এজেন্ডা মাওবাদীদের ছিল, সে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, মাওবাদীরা এ প্রশ্নে জনমতকে একত্রিত করতে পেরেছে। সুতরাং, বড় কিংবা ছোট এই তকমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল, গতিশীল বামপন্থার কর্তব্য নির্ধারণ। তার সূচি ও প্রাঙ্গণ নির্ধারণ। সাথে সাথে একটি চৌকস রাজনৈতিক দল বা জোটের ভাবমূর্তি নির্মাণ এবং কার্যকর ও টেকসইভাবে বিশেষ মূহূর্তে প্রায়োগিক ভূমিকা পালনে সক্ষমতা।

নেপালের মাওবাদীদের সময়ে সময়ে সশস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ পথে, সংসদে ও রাজপথে যুগপৎ ভূমিকায় সাফল্য এই নমনীয়তা ও চৌকস ভূমিকা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। বামপন্থী দলগুলির মধ্যে কারোরই একক শক্তি সমাবেশ এমন পর্যায়ে নয়, তারা এককভাবে জনগণকে আকর্ষণ করতে পারবেন।

বামপন্থীদের মধ্যকার নানান বিতর্কে আজ অবধি অতীত চর্চা যতখানি উল্লেখযোগ্য, বর্তমানের ইস্যুতে ততখানি নয়। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান ঘিরে থাকে সন্দেহ, আস্থার সংকট। সুতরাং তাদের মধ্যকার দূরত্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় উপাদান হল, আস্থা, আন্তরিকতা, দৃঢ়তা।

প্রশ্নটা হলো, তাহলে আওয়ামী লীগ না বিএনপি এই বাইনারি টিকে থাকে কি করে? একদল তার প্রোপাগান্ডাকে এ অবধি নিতে সক্ষম হয়েছে এবং মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে, তারা ক্ষমতায় না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ধূলিষ্মাৎ হয়ে যাবে। সেই চেতনার মানে যখন তারা বুঝিয়ে বলেন, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার আর বাসে-ট্রেনে মানুষ পোড়ানোর দুঃসহ স্মৃতির বাইরে যেতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অন্যপক্ষে, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের মিশেলে, অর্থনৈতিক কোনো ইস্যু ব্যতিরেকে ভারত বিরোধিতা আর বর্তমানের গণতন্ত্রহীনতা ও নিপীড়নের বাইরে যেতে সক্ষম নন। অথচ এরা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না, দেশে ধর্মান্ধ রাজনীতির সর্প নিয়ে দুপক্ষই খেলছে। সীমান্তে মানুষ হত্যার মতো ইস্যু নিয়েও ভারতের সাথে উচ্চবাচ্য করার সক্ষমতা এরা রাখেন না কিংবা অর্থনৈতিক লেনদেনের ভারসাম্য নিয়ে কথা বলাটা গর্হিত মনে করেন।

এ রকম একটি অথর্ব শাসকশ্রেণী যাদের আগাপাশতলা ক্ষমতার ভিত্তি হল লুটেরা পরজীবীরা, তাদের বিপরীতে নয়া সূর্যোদয়ে বামপন্থা কি একমত হতে পারেন?

লেখক: পরিচালক, সমাজ সমীক্ষা সংঘ

 

সারাবাংলা/এসবি/আইজেকে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর