Wednesday 14 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঘরের ভেতরে ‘বিভীষণ’ রেখে আপস!


১৭ জানুয়ারি ২০২১ ২১:২৪ | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:৫৩

এক
সামুদ্রিক ঝড় বিদায় নেওয়ার সময় তার লেজের ঝাপটায় ধ্বংসলীলার শেষ পর্যায়টুকু সম্পাদন করে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের লেজের দাপট আমেরিকার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ হলো। কলঙ্কের অধ্যায়। যে রাষ্ট্র পুরো দুনিয়ায় গণতন্ত্রের সবক দিতে সবসময় ব্যস্ত, তার আইনসভার গর্ভগৃহে হানাদারদের এই বেপরোয়া তাণ্ডব আক্রমণে সমস্ত নিন্দা বা ব্যঙ্গকে তুচ্ছ করে বিপুল আকারে উঠে আসছে এক বিপুল উদ্বেগ। গণতন্ত্রের বিপদ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, ৬ জানুয়ারি ২০২১ তার স্মারক হয়ে থাকবে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধ নেই। উল্টো তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘ওই হামলার জেরে তাকে অভিশংসন করা হলে আরও সহিংসতা হতে পারে’। ট্রাম্পের এই বক্তব্য সেই দেশের কথিত গণতন্ত্রবিনাশকে উসকে দিচ্ছে। এতদিনে জনসম্মুখে আমেরিকার প্রকৃত চরিত্র ফুটে উঠছে।

বিজ্ঞাপন

এই আক্রমণ আকস্মিক ছিল না, বরং এক অর্থে তা ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতির ‘স্বাভাবিক’ পরিণতি। সেই প্রস্তুতি হিংস্র বিদ্বেষের, কদর্য অসহিষ্ণুতার, সর্বগ্রাসী স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার। এই মানসিকতায় ইন্ধন দিয়ে এবং তাকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, তারপর চার বছর ধরে বিভাজনী বিদ্বেষকে উত্তেজিত করে গিয়েছেন। ভোটে হারার পরেও জনাদেশ অস্বীকার করে প্রেসিডেন্ট থেকে যাওয়ার জন্য উৎকট জবরদস্তি শেষ পর্যন্ত এক চরম মাত্রায় পৌঁছায়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজ হতে আপন ‘সমর্থক’ বাহিনীকে কার্যত ক্যাপিটল হিল আক্রমণে প্ররোচিত করেন। ক্যাপিটল হিলে ঘটা তাণ্ডব পরিস্থিতির ধাক্কায় মার্কিন কংগ্রেস বিবৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে যে, আমেরিকা উচ্ছৃঙ্খল জনতার নয়, বরং আইন মান্যকারী দেশ। বোঝানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উস্কানিতে যা ঘটেছে, তা নতুন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের সেবায় নিয়োজিত শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিবিদদের ইন্ধনে ঘটা দীর্ঘ গণহিংসার ইতিহাস।

বিজ্ঞাপন

পরিসমাপ্তি নয় এখানে। যে বিষাক্ত বিদ্বেষের পিশাচনাচ দেখে দুনিয়া স্তম্ভিত, জো বাইডেনের আনুষ্ঠানিক অভিষেকে এবং সেই অভিষেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘স্বীকৃতি’দানে তার সমাপ্তি ঘটার নয়, সামুদ্রিক ঝড় অপেক্ষা এই দানবের শক্তি অনেক বেশি। সেই শক্তির বীজ রয়েছে সমাজের ভেতরে, নাগরিকদের একটি বড় অংশের মানসিকতায়। গণতান্ত্রিক ঔষধের সাহায্যে এই গভীর ও জটিল ব্যাধিকে প্রশমিত করবার দায়িত্ব বহন করতে হবে বাইডেনকে, এবং কংগ্রেসের দুই সভায় চালকের আসনে অধিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধিদের। কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু এখন কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন রিপাবলিকান পার্টি। মিট রমনি হতে এমনকি মিচ ম্যাকনেল অবধি দলের অনেক নেতা ট্রাম্প ও তার বাহিনীর আচরণের তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে গণতন্ত্রকে বাঁচবার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব সত্যই পালন করতে চাইলে কেবল বিষবৃক্ষের ফলটিকে প্রত্যাখ্যান করলে চলবে না, বৃক্ষটিকেই শেকড়-শুদ্ধ উপড়িয়ে ফেলতে হবে। ট্রাম্প ব্যক্তিমাত্র, ‘ট্রাম্পবাদ’কে উৎখাত না করলে গণতান্ত্রিক আমেরিকার ভবিষ্যৎ সুস্থ হতে পারবে না।

কেবল আমেরিকায় নয়, সবখানে এই অসহিষ্ণু ও হিংস্র বিদ্বেষের দুনিয়াদারি করোনা সংকটকেও ছেপে যাচ্ছে। এই অতিমারিতেও আমাদের দেশে অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। অসহিষ্ণুতা বা বিদ্বেষ নতুন নয়, কিন্তু গত কয়েক বছরে জনজীবনে যেভাবে তার দাপট বেড়েছে, তা অভূতপূর্ব। এই বিপদের উৎসে রয়েছে বিভাজনের বিষকে কঠোরভাবে দমন করবার পরিবর্তে তার কারবারিদের প্রশ্রয় এবং প্ররোচনা দিয়ে সমাজ ও রাজনীতিকে উত্তরোত্তর বিষাক্ত করে তোলার অনাচার। এক অর্থে বাংলাদেশের বিপদ আমেরিকা চেয়ে অনেক বেশি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার শিবিরের বিরুদ্ধে তার দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে গেছে, তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ক্রমশই জোরদার হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও প্রচারেও গণতন্ত্রীদের সংগঠন ছিল দর্শনীয়।

আমাদের দেশে এই গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধার শক্তি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। গণতন্ত্রের ধারক ও রক্ষক বিবিধ প্রতিষ্ঠান ক্রমশ দুর্বল। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। হয়তো নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে ‘সত্যবচনে’ আশার আলো জ্বলছে। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত বোধ করবার উপায় নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার সাম্প্রতিক সত্যবচনে কেউ কেউ বিব্রত, কেউ একমত। তার এ সত্যবচনে বৃহত্তর নোয়াখালীর চিত্র তুলে ধরলেও প্রকৃতপক্ষে এটি সমগ্র বাংলাদেশেরই চিত্র।

এ হলো ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ত্যাগী নেতাদের দীর্ঘদিনে ক্ষোভ, জমানো হতাশা। যা আবদুল কাদের মির্জার কণ্ঠে বেরিয়ে আসলো। মূল্যায়ন না পাওয়া এসব ত্যাগী নেতাদের ক্ষোভ আগামী দিনে আরও বেশি জোরালো হবে, যদি এখনই তাদের দলে ফেরাতে না পারে, সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। কখনও কখনও সেটি রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতৃত্বের ‘দ্বন্দ্ব’ থেকে সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ।

এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে। সত্যিই কি গড়ছে? গড়লেও তা কতটা মজবুত? সাম্প্রতিক রাজনীতি এখন এই সব প্রশ্নে আলোড়িত। ভোট যত আগায়, বিরোধের খেলায় ততই যেন দখল বাড়ে ক্ষমতাসীনের। বস্তুত সাদা চোখে যা সবাই দেখছেন, তাতে তৃণমূলে বিরোধ ছবি খানিকটা হলেও স্পষ্ট। যদিও তাতে প্রতিপক্ষের উল্লাসের আদৌ কতটা কারণ আছে, এখনই হয়তো তা পুরোপুরি বোঝার সময় আসেনি। আরও অনেক কিছু দেখার বাকি।

দুই
নোয়াখালীর একলাশপুরের স্মৃতি এখনও হারিয়ে যায়নি। তার মধ্যেই ঢাকার কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ও লেভেলের ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার খবর সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হলো। শুধু ধর্ষণই নয়, নৃশংস হত্যার বিচারে এক কিশোরীর এই ঘটনাটি আবারও দেশকে স্তম্ভিত করেছে। অত্যাচারের ধরনে নির্ভয়া কাণ্ডের কথা মনে পড়তে পারে। জানা গেছে, নৃশংস অত্যাচারের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই আনুশকাহর মৃত্যু হয়েছে। নারীরা ক্রমশ বুঝে নিচ্ছেন যে, ধর্ষণ-নিগ্রহেই তাদের যন্ত্রণা ফুরাবার নয়। রাষ্ট্রের অসংবেদনশীলতাও তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

টিএসসির স্বপন মামার ‘প্রতিবন্ধী’ ছোট মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছিল গ্রামের মসজিদের সত্তর ছুঁইছুঁই এক মুয়াজ্জিন। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এটা দু’বছর আগে ২৮ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। আর এর পরের বছরের ঘটনা হচ্ছে, সেই আসামী জামিন পেয়েছে এবং জামিনে বের হয়েই স্বপন মামা ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলের নামে করেছে মাদকের মামলা। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি করতে গিয়ে লক্ষাধিক টাকার দেনায় পড়েছেন স্বপন মামা। টাকা ধার করাটা আবার যার ধাতবিরুদ্ধ। তবু তিনি মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পাশবিক অন্যায়ের ন্যায্য বিচার চান।

প্রশাসন যেখানে নারীদের নিরাপত্তা রক্ষায় চূড়ান্ত ব্যর্থ, সেখানে নারীরা নির্ভয়ে বাইরে ঘুরবেন কী উপায়ে? বস্তুত, দেশের বিভিন্ন প্রশাসনের ভেবে দেখা দরকার, সেখানে নারীর অবস্থা কী শোচনীয়। অতীতে নির্ভয়াকাণ্ডের পরেও এই অভিযোগ শোনা গিয়েছিল। কী প্রয়োজন ছিল বাইরে ঘুরে বেড়ানোর? এখন দেখা যাচ্ছে, দিনে-দুপুরে মেয়েরা নিরাপদ নয়। এমনকি পুরুষের উপস্থিতিও যে সর্বদা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে, এমনও নয়। অতঃপর কোনো নারী পথে বের হতে চাইলে তার হয়তো লেঠেল বাহিনীর প্রয়োজন পড়বে। মুরুব্বিরা ফতোয়া দেবেন, বাইরে পা রাখবার সময় তার পোশাক কেমন হওয়া উচিত, কোন কোন আচরণ তিনি করলে পুরুষের চোখে ধর্ষণযোগ্য প্রতিপন্ন হবেন না, কোন কোন পেশায় তার না যাওয়াই সমীচীন। বস্তুত, এই সমাজে ধর্ষণ হলে এখন আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে চর্চাটি ম্লান হয়ে নারীদের আচরণবিধি সংক্রান্ত কথাই অধিক চলতে থাকে। ঘটনা হলো, এ দেশের দুর্দমনীয় পুরুষ-সমাজ যতই ‘চিন্তান্বিত’ হচ্ছে, ধর্ষণের সংখ্যা এবং নৃশংসতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তার কানাকড়িও নারী-সুরক্ষার প্রশ্নে উদ্যোগ নিতে নারাজ। তারা হয়তো মনে করেন, ঘরের ভেতরে প্রহৃত হওয়া এবং ঘরের বাহিরে ধর্ষিত হওয়া নারীজন্মের স্বাভাবিক পরিণতি। তারা জানেন, আলাপ-আলোচনা, প্রতিবাদ সবই ধোঁয়া। সকলই মাত্র কিছু কালের জন্য। অতঃপর প্রশাসন নিজের ‘কাজ’-এ মন দিবে, নারীকে ধান কাটিতে যেতে হবে। কপালে থাকলে পুরুষের লালসার শিকার হয়ে ছিন্নভিন্ন শরীর নিয়ে পড়ে থাকতে হবে রাস্তার ধারে। উন্নত, আধুনিক বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে।

তিন
করোনার দুঃসময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত। এ ক্ষতি টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যাবে না। বিদ্যা যেমন অমূল্য ধন, তেমনি এই ক্ষতিও অমূল্য। শৈশব-কৈশোর হলো বাকি জীবনের ভিত। ভিত দুর্বল হলে বাড়ির মতোই মানুষের ভবিষ্যতও দুর্বল হয়ে পড়বে, অপূরণীয় ক্ষতি হবে জাতির। অন্তত পাঁচ কোটি জীবন এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গড়ে উঠার পর্বে এ কেবল সিলেবাসের পড়ার ক্ষতি নয়, পরীক্ষায় বসতে না পারার লোকসান নয়, এদের প্রত্যেকের জীবনের এ সময় প্রতিটি বছর, প্রত্যেক দিনই শরীর-মনের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জীবনের অভাব নিছক অনলাইনের ক্লাস পূরণ করতে পারে না।

তাছাড়া যে ক্ষতি গৃহবন্দী জীবনে ঘটছে, তার প্রভাব সময়ের গণ্ডিতে আটকে থাকবে না, এর ধকল চলবে আজীবন। তাও যদি অভিভাবক-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সংবেদনশীল সক্রিয়তা ওদের সহায়ক হয়। তেমন সচেতনতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, কারণ এ সমাজে সে রকম দূরদর্শী বিচারবোধের অভাব পদে পদে দেখা যায়। বন্দিজীবনের ক্ষত কারও কারও জীবনসঙ্গী হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলবো, শিশু থেকে তরুণদের কেবল অনলাইন ক্লাসের ওপর বছরের বেশিরভাগ সময় ছেড়ে রাখলে জাতি সুবুদ্ধির পরিচয় দেবে না। এ নিয়ে ভাবতে হবে, মনেকরি সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ আর নেই।

চার
বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার থেকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বৈশ্বিক প্রবণতা বোঝার কোনো উপায় নেই। অথচ বিশ্বের আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২০ লাখ ছুঁতে চলেছে। বাংলাদেশে পরীক্ষা সংখ্যা কমে যাওয়ায় সঠিক সংখ্যা আমাদের অজানা থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশে যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল সবার আগে টিকা পাওয়া যাবে, পরে বলা হয়েছিল ভারত যখন পাবে, আমরাও তখন পাবো। তবে সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা সম্ভব হতে পারে। অবশ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও দ্বিগুণ দামে। মাসে ২৫ লাখ করে ছয় মাসে দেড় কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তার অগ্রাধিকার কতটা সুফল দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। কার্যকর চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত টিকার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সংক্রমণ থেকে রক্ষায় সুস্থ মানুষের চেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে অগ্রাধিকারের নীতিই কি যুক্তিযুক্ত? দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানে দুই মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্তের যর্থার্থতাও প্রশ্নাতীত নয়। দ্বিতীয় ডোজ বিলম্বিত হলে টিকার কার্যকারিতা কতটা অক্ষুণ্ণ থাকবে বা দুর্বল হবে, সেরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিন্তু এখনও হয়নি। ফলে নীতিনির্ধারক মহলসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সমন্বিত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে সবার আগে।

পাঁচ
আমনের ভরা মৌসুম চলছে। কৃষকদের ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠেছে। এমন সময়ে ধান-চালের দাম কম থাকে। ফলন বেশি হলে ধানের দাম কমে যায়, কৃষকের লোকসান হয়, আমরা তাদের লোকসান কমানোর জন্য সরকারকে যদি অনুরোধ করি বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কৃষকদের কাছ থেকে কৃষকদের কাছে সরাসরি ধান কিনতে। সরকার কী করে!

ধান কেটে ঘরে তোলার পরেই কৃষকের ভূমিকা ফুরিয়ে যায়। এক মণ ধান ঘরে তুলতে তার কত টাকা খরচ হয়েছে, কত ঘাম ঝরেছে, এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাকে ধান বিক্রি করতে হয় বাজারে প্রচলিত দরে। যে বাজার চলার কথা মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বতঃস্ফূর্ততার নিয়মে। কিন্তু ধানের বাজারে স্বতঃস্ফূর্ততা অসম্ভব। কেননা, কতিপয় গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের শিকার। আসলে ধানের কোনো ভোক্তা নেই, ভোক্তা আছে চালের। ধানের ক্রেতা মূলত চালকল মালিকেরা। এদেশের ধানচাষীদের হাত-পা বাঁধা পড়েছে তাদের হাতে। এই মালিকেরা একই সঙ্গে চালের ব্যবসায়ীও বটে।

আমাদের দেশে বড় বড় কৃষকের সংখ্যা কম, বেশি জমির মালিকেরা নিজেরা ফসল ফলান না, ছোট কৃষকদের জমি লিজ বা বর্গা দেন। ছোট কৃষকদের নিজের জমি কম। তাদের ঘরবাড়ি ছোট, বাড়ির উঠান ছোট, চুলা ছোট, চুলার জ্বালানি সংগ্রহের সামর্থ্য কম। ফলে তাদের ধান ফলিয়ে বিক্রি করতে হয়। তারা সরাসরি সরকারের কাছেই বিক্রি করতে চান। সরকারও ঢাকঢোল পিটিয়ে সরাসরি তাদের কাছ থেকেই ধান কেনার অভিযান শুরু করে। খাদ্য বিভাগের লোকেরা বলেন, ‘তোমার ধান ভেজা’। সরকার ভেজা ধান কিনতে রাজি নয়। তাই কৃষকদের শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে, ধানের আর্দ্রতার মাত্রা ১৪ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু কৃষকের ধান শুকানোর পর্যাপ্ত জায়গা নেই, ধান রাখার জায়গাও কম। তাই তিনি ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিক্রি করতে চান। এটা তাকে করতে হয় এই কারণে যে ধান বিক্রি করেই সেচের পানির বকেয়া বিল শোধ করতে হবে, সার-কীটনাশকের পাওনা শোধ করতে হবে, ধারকর্জ নেওয়া থাকলে তাও শোধ করতে হবে। সরকারের কাছে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে চালকল মালিকদের কাছে কম দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না। চালকল মালিকেরা সেই চাল নিজের চাতালে শুকিয়ে কিছু সরকারের কাছে বিক্রি করে বাকিটা চাল বানিয়ে বিক্রি করে।

সামগ্রিকভাবে কৃষিক্ষেত্র যে সংকটে ভুগছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ কৃষিকাজ আর তেমন লাভজনক নয়। তবু কৃষি উৎপাদনের যেটুকু বৃদ্ধি হচ্ছে প্রতিবছর, তা ওই লাভের মুখ না দেখা কৃষকদের শ্রমের ফসল। জমির উৎপাদনশীলতা অনেকটা বাড়াতে গেলে শ্রমের পাশাপাশি অন্য উপাদান লাগে, তাতে খরচ বাড়ে, অথচ ফসলের দাম সেই তুলনায় বাড়ে না। কৃষকদের দুর্দশা লাঘব করার আন্তরিক ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ যত দিন পর্যন্ত নেওয়া না হচ্ছে, ততদিন সরকারের কোনো কঠোর পদক্ষেপই চালকল মালিকদের দৌরাত্ম থামবে না। কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের সমাধান সরকার নির্ধারিত দামে সরাসরি তাদের কাছ থেকেই ধান কেনার চলমান অকার্যকর ব্যবস্থাটি কার্যকর করা।

ছয়
বাইরে শত্রু রেখেও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা যায়, শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে জেতা যায়। ঘরের ভেতরে ‘বিভীষণ’ রেখে আপাত আপস করা যেতে পারে, কিন্তু ‘বিকল্প’ রাজনীতির মেরুকরণ হয় না। চেতনা বা আদর্শের পক্ষে মোকাবিলা করা যায় না। এসব আপসনামা নেতাদের রক্ত সরোবর দিনশেষে সাধারণ মানুষ আর তৃণমূল কর্মীদের কাছে ফাঁকা আওয়াজই থেকে যাচ্ছে। বিব্রত হচ্ছে এসব কর্মীরা। হয়তো উপরিভাসা নেতারা সেটা কখনোই অনুধাবন করতে চান না বোধহয়। কর্মীদের আবেগকে তুচ্ছ করা রাজনীতিতে সম্ভব নয়; এবং তা প্রত্যাশিতও নয়। কিন্তু কর্মীদের চাওয়াকেই শেষ কথা বলে ধরে নেওয়ারও কোনো কারণ নেই। কীভাবে জন-আবেগকে আহত না করেও সমাজের, এবং জনগণের পক্ষে কল্যাণকর কাজগুলো করা যায়, তা সন্ধান করাই রাজনীতিকের কাজ। তা আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। গণতন্ত্রের প্রাণভ্রমরাটি আলোচনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। আলোচনার অর্থ এই নয় যে, জনগণের সব কথাই মেনে নিতে হবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আলোচনার মাধ্যমে মানুষের সম্মতি আদায়ের কাজটি অপরিহার্য।

লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন

ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর