আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে চাই পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন
১৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:৩৪
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতে এবং বাজারকে স্থিতিশীল এবং ভাইব্র্যান্ট রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আমরা দেশব্যাপী সকলে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও গতিশীল পুঁজিবাজার দেখতে চাই। যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ভালো শিল্প উদ্যোক্তারা বাজার থেকে টাকা তুলবে এবং তা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ, আবাসন, নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করবে এবং দেশের শিল্প উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে। দীর্ঘমেয়াদী শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপর বাড়তি কোনো চাপ থাকবে না।
বর্তমান বাজারের গতিপ্রকৃতি দেখে আমরা বলতে পারি—পুঁজিবাজারের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা সকলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। তারই প্রতিফলন আমরা এক্সচেঞ্জের টার্নওভারে দেখতে পাচ্ছি। আমরা সকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ডেইলি টার্নওভার পাঁচ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। শুধু ইকুইটি মার্কেটের উপর নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে আসার জন্য বিএসইসি এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি (সিসিপি) চালু হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের ডে সেটেলমেন্ট সহ নতুন নতুন প্রডাক্টস, সুকুক ডেরিভেটিভস/ফিউচার চালু করার প্রচেষ্টা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এসএমই প্লাটফর্ম ডিএসই তৈরি করে ফেলেছে। সরকারি ভালো ভালো শেয়ার বাজারে এনে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশীয় ভালো ভালো প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার বাজারে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সফল, সৎ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ বাড়ছে। বন্ড মার্কেট মজবুত হচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে জিডিপি-তে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের অবদান ৫০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জ এগিয়ে যাচ্ছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে। কোনো অবস্থাতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বিএসইসি কমিশনকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বিএসইসি যত কঠোর অবস্থানে থাকবে বাজার ততো বেশি ভালো থাকবে।
বিএসইসি কোনো অবস্থাতে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, ইনডেক্সকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। শেয়ারের দাম উঠানামা করলে ইনডেক্স বাড়ে এবং কমে। সেটাই স্বাভাবিক। বাজারে ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে। ফ্রি ফ্লট শেয়ার যে কোম্পানির বেশি থাকে সে কোম্পানির শেয়ার ম্যানিপুলেট করে বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ যেসব কোম্পানির মৌল ভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি তারা নিজস্ব শক্তিতে বাড়ে। এই সকল শেয়ারের ইপিএস, পি/ই রেশিও, রিজার্ভ, বিজনেস এক্সপেনশন, কোম্পানি, মূলধন, দক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কারণে দক্ষ বিনিয়োগকারী বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে। অপর দিকে ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার, স্মল পেইড-আপ ক্যাপিটাল শেয়ার, নন-পারফরম্যান্স শেয়ারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ম্যানিপুলেট করে সহজে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। এই সকল কোম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে বিএসইসি এবং এক্সচেঞ্জকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বাজারকে এগিয়ে নিতে হলে লিস্টেড কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ জরুরি।
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ২৪ শতাংশ ধারণ করে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—এই সফল প্রতিষ্ঠানের ফ্রি ফ্লট শেয়ার অনেক বেশি। বিনিয়োগকারীদের হাতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার আছে। বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকে যারা স্পন্সর/ডিরেক্টর আছেন তাদের বুঝতে হবে। তারা ব্যাংকের মালিক নয় তারা শেয়ারহোল্ডার। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এই সকল স্পন্সর/ডিরেক্টরদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকায় চলে, সেসব পরিচালকের টাকায় চলে না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকেরা ২০০৯-১০ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে, ১০ টাকার শেয়ার মার্কেটে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আজ সেসব শেয়ারের দাম ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে। উদ্যোক্তা, পরিচালকরা বলেন উনারা ব্যাংক ভালোভাবে পরিচালনা করছেন, যদি তা হয় সেসব উদ্যোক্তা পরিচালকগণ যারা ১০ টাকার শেয়ার ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন তারা এখন শেয়ার বাইব্যাক করছেন না কেন? কারণ তারা ভালো করে জানেন তারা ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে ব্যাংকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত ম্যানেজমেন্টের সাথে নামে বেনামে ভুল তথ্য দিয়ে, ভুয়া জমি দেখিয়ে, জাল দলিলপত্র দাখিল করে সরকারি খাস জমি বন্ধক রেখে, ডোবা-খাল-জলাশয় দেখিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ব্যাসেল-৩ পরিপালন করার অজুহাতে বছরের পর বছর শুধুমাত্র বোনাস শেয়ার ইস্যু করে নিজেদের শেয়ার সংখ্যা বাড়িয়েছে অপর দিকে বেশি দামে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা প্রচণ্ড লোকসানের কবলে পড়েছেন। অপরদিকে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া যে সকল কোম্পানির মৌল ভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি, বাজারে তাদের শেয়ারের দামও বিগত বছরগুলোতে অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু ভালো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার ধরে রাখতে পারলে কোনো অবস্থাতেই বিনিয়োগকারীকে লাভ দিতে না পারলেও লোকসান গুনতে হয় না, ইতিহাসের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়।
ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। যে কোনো অবস্থায় ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ ও সৎ ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের বুঝাতে হবে এটা তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান নয়। ব্যাংক আমানতকারীদের আমানতের টাকায় চলে, এর মালিক সকল শেয়ারহোল্ডার। এখনও অনেক ব্যাংকের তথাকথিত স্পন্সর, ডাইরেক্টররা ব্যাংকগুলোকে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন। তারা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তারা নিয়মনীতিরও তোয়াক্কা করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতেরও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমার জানা মতে, অনেক ব্যাংক তাদের বোর্ড মিটিং, কমিটি মিটিংয়ের প্রসিডিং মিনিট আকারে রাখেন না, রেকর্ড করে রাখেন। রেকর্ড যে কোনো সময় ধ্বংস করা সম্ভব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ উদ্যোগ নেবেন যাতে করে ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিটি মিটিংয়ের প্রসিডিং মিনিট আকারে রাখেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। ব্যাংকের বর্তমান কার্যপরিচালনার প্রণালী, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বতন্ত্র পরিচালকদের ব্যাংকে অবদান, সব কিছুর দলিল হলো বিভিন্ন মিটিং এর মিনিটস, যা আর্থিক খাতের সুশাসন আনয়নে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে বলে আমি মনে করি।
বিএসইসি কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাংক একসাথে কাজ করে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সৎ, পেশাদার ক্ষুদ্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। যে সকল বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানের দুই শতাংশ শেয়ার আছে তাদের পরিচালনা পর্ষদে সহজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্পন্সর, ডাইরেক্টরদের কোনো কোনো ওজর, আপত্তি চলবে না। কারণ আমরা বাস্তবে দেখি স্পন্সর ডাইরেক্টররা তাদের পছন্দমত পরিচালক নিয়োগ দিতে চান, এটা বন্ধ করতে হবে। যাদের দুই শতাংশ শেয়ার আছে তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ করে দিতে হবে। এতে যদি বোর্ডের আকার বাড়ে তাতে কোন অসুবিধার কারণ নেই। বরং এতে করে যারা বাজার থেকে শেয়ার কিনে পরিচালক হবেন তাদের দায়িত্ব, আরও বেশি থাকবে। এতে করে স্বতন্ত্র পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যৌথ পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকের লুটপাট বন্ধ হবে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বে। তাতে করে বাজার আরও ভালো ও বড় হবে। ব্যাংকের লেনদেন আরও বাড়বে।
বর্তমানে যে সকল স্পন্সর, ডাইরেক্টরদের বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ আছে, যারা বিভিন্নভাবে ঋণখেলাপী হয়ে আছেন অথবা যারা অবৈধভাবে ব্যাংকের লুটপাট খাতে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকে অবশ্যই ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর আইনের মধ্যে থাকতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে ব্যাংক ব্যবস্থা যত ভালো থাকবে দেশের অর্থনীতি ততো ভালো থাকবে। পুঁজিবাজারও ভালো থাকবে। এখনই উপযুক্ত সময় সব কিছু ঠিকঠাক করার। ঋণ খেলাপিকে কঠোর আইনের আওতায় এনে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের টাকা লোন করে যাতে কেউ পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজরদারী বাড়িয়ে সরকারের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আমি আগে অনেকবার বলেছি এখনও বলছি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। দেউলিয়া আইনের সংশোধন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কাউকে জেল দিয়ে কোনো লাভ হবে না। লাইফস্টাইলে হাত দিলে দেখবেন অনেক টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। কেউ আর নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করবে না। দেউলিয়া ঘোষণার কারণে তার বাড়ি গাড়ি কিছুই থাকেবে না, ছেলেমেয়েদের দামী স্কুলে পড়াতে পারবে না। প্লেনে চড়তে পারবে না। বিদেশে যেতে পারবে না। বড় বড় সরকারি বেসরকারি পার্টিতে যোগ দিতে পারবে না। এই সকল ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশ, চায়না, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ভারত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি থেকে ৭০- ৯০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সফল অর্থমন্ত্রীকে এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনার সফলতা দিন দিন বাড়ছে। অনুরোধ করবো আপনি অর্থনীতির বিভিন্ন দিকগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই জায়গায় বাস্তবতার আলোকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
এই মহামারিতে দেশের সবাই আর্থিকভাবে কষ্টে আছে। সফল, সৎ ও দক্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ বিশেষ করে, গার্মেন্টস মালিকেরা তাদের ইন্ডাস্ট্রি চালিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন যাতে করে দেশে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত কেউ কর্মহীন হয়ে না পড়ে। অপর দিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা আরাম-আয়েশে থাকবে তা হতে পারে না। এই সকল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থানে না থাকলে, ঋণ আদায়ে সঠিক এবং বাস্তব উদ্যোগ না নিলে, ভালো ভালো উদ্যোক্তারা হতাশ হয়ে পড়বেন। অনেকে হয়তো ভাববে অথবা ভাবতে শুরু করেছেন যে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে অথবা ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালকের সহায়তায় যদি টাকা নেওয়া যায় তাহলে বেশি সৎ থেকে থেকে লাভ কী? এতে টাকাও পাওয়া যাবে এবং টাকা ফেরতও দিতে হবে না। এই ধরনের একটি মানসিকতা তৈরি হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং অবশ্যই ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আবারও বলছি, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা অনেক বেড়ে যাবে এবং লেনদেনও বাড়বে। বিএসইসি কমিশনকে আমি অনুরোধ করবো আপনারা যত কঠোর হবেন বাজার ততো গতিশীল হবে।
বিনিয়োগকারী কোন সময়ে, কোন দামে শেয়ার কিনবে এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। পৃথিবীর সব দেশে শেয়ারের দাম বাড়ে এবং কমে। ডিমান্ড, সাপ্লাইয়ের উপর শেয়ারের দাম নির্ভর করে। বিএসইসি কোন সময় কোন শেয়ারের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করতে পারে না। এবং এটা বলতে পারে না যে, কোন শেয়ারের দাম এত বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী একমাস তার দর বৃদ্ধির তদারকি করতে। বিএসইসি-এর কাজ এটা নয়। বিএসইসি’র মূল কাজটি হলো বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ইনসাইডার ট্রেড, মার্কেট ম্যানিপুলেশন বন্ধ করা। বিএসইসি বলবে না কোন কোম্পানির শেয়ার ভালো, কোন সেক্টরের শেয়ারগুলো ভালো হবে ইত্যাদি। এটা বিএসইসি’র কাজ নয়। বিনিয়োগকারী ঠিক করবে সে কী পাবে। এটা তার দায়িত্ব। আমাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে হবে, নিজের সুবিধা মতো কোনো আইন তৈরি করা যাবে না এবং কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না।
যে সকল কোম্পানির ফ্রি ফ্লট শেয়ার বেশি সেগুলোর ম্যানুপুলেশন করে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত: এখনতো ব্যাংকের টাকা তার নিয়মের মধ্যে থেকে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, ম্যানুপুলেশন কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ, কৃত্রিমভাবে বাজারকে বাবল করে দেওয়া এখন আর সম্ভব নয়। বাজারে কালো টাকা আসছে, বড় বড় বিনিয়োগ আসছে, দিন দিন বিনিয়োগকারী বাড়ছে। আমি মনে করি, এই সকল বিনিয়োগকারী সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করছেন। বড় বড় বিনিয়োগকারীর সুবিধা হলো ভালো শেয়ার তারা যে দামে কিনুন না কেন শেয়ারের দাম যদি পড়েও যায় তারা চিন্তিত হন না কারণ তারা শেয়ারটা ধরে রাখার ক্ষমতা রাখেন। পুঁজিবাজারের ইতিহাসে দেখা গেল, একটি ভালো এবং ফান্ডামেন্টাল শেয়ারের দাম পড়ে গেলেও পরবর্তীতে তার দাম আবারও বাড়ে। অতএব, ভয় হলো শুধু ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের, যারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাজারে আসেন, যারা বাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে চান না এবং অল্প সময়ে লাভ করতে চান। তাদের জন্য সবচেয়ে রিস্ক থেকে যায়। আমি বার বার বলছি যারা স্বল্প টাকা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসবে তারা যেন সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করেন।
বিএসইসি কমিশন বাজারে স্বচ্ছতা/জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন। অতএব, আপনার দায়িত্ব আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের একটি অংশ পুঁজিবাজারে দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ করুন। আশা করি আপনি লাভবান হবেন। শুধু বুঝবেন টাকাটা যেহেতু আপনার, দিনের শেষে লাভও আপনার লোকসানও আপনার। এখানে কাউকে বিশেষ করে সরকারকে অথবা বিএসইসি কমিশনকে আপনার দুষ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরিশেষে বলবো, বাজারের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসি সুশাসন অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১০০ ভাগ সঠিক ডিসক্লোজারের ভিত্তিতে ভালো ভালো কোম্পানি আনতে হবে। বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে, সরকারি ভালো শেয়ার এনে বাজারকে আরও বেশি গতিশীল করতে হবে। পুঁজিবাজার হচ্ছে শিল্পায়নে এবং কর্মসংস্থানে টাকার মূল উৎস, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়।
আমি দৃঢ়ভাবে আমার বিগত দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝি সরকার, অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, এক্সচেঞ্জসহ সবাই পুঁজিবাজারের জন্য সঠিক কাজটি করে যাচ্ছে। এভাবে বিএসইসি কমিশনের সব সময়ে কঠোর অবস্থানের কারণে বাজার অনেক দূর যাবে। হাজারও বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ আসবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো উন্নয়নে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আগামী তিন বছরে দেশের পুঁজিবাজারে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে, ইনশআল্লাহ। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সফল অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সরকার বড় বড় অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে তা কোম্পানিতে রূপান্তর করে, পুঁজিবাজারে তার শেয়ার ছেড়ে জনগণ থেকে টাকা নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারবে।
জনগণের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান। যদি পুঁজিবাজার ভালো থাকে সবচেয়ে লাভবান হবে সরকার। উন্নয়নের জন্য টাকার একটি বড় অংশ আসবে জনগণের সঞ্চয় থেকে। তাতে করে জনগণের সঞ্চয়ের টাকা অনুৎপাদনশীল খাত, যেমন জমিতে বিনিয়োগ কম হবে অথবা টাকা বিদেশে পাচার হবে না। এটাই হবে সরকারের বড় সাফল্য।
লেখক: সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড