Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উন্নয়নশীল বাংলাদেশ, নতুন এক চ্যালেঞ্জের সূচনা


১৯ মার্চ ২০১৮ ১২:৫৫

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ছেড়ে বিশ্ববাসীর কাছে এখন উন্নয়নশীল দেশ (ডিসি) বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরে ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি দেশের ৪৭ বছরের অর্জন এটি। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে অগ্রগতি এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে এই সাফল্যের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল জাতিসংঘ। শুভদিনে এই সাফল্যের খবর যেন দক্ষিণ এশিয়ার ব-দ্বীপ রাষ্ট্রটির মানুষের মনে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা।

প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিশ্ব
এক সময়ের চরম ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ, এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। আর তাই বিশ্ব এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এ কথা জানা গেছে প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনেও। গতকাল রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি মাথাপিছু আয়ও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বেড়েছে জীবনমানও। আর এসবই বাংলাদেশকে তুলে এনেছে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়।

এ ছাড়া বাংলাদেশের এই উত্তরণে বড় ভূমিকা রেখেছে ২০২০ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ৪৮ থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার জাতিসংঘ ভাবনা।

উন্নয়নশীল দেশের শর্ত কী এবং কেন
বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হওয়া একটি মর্যাদার বিষয়। বিশ্বব্যাপী সাহায্য ও ঋণ দেওয়ার সুবিধার জন্য উন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল—এই শ্রেণীকরণটি করেছে বিশ্বব্যাংক। এর সঙ্গে জড়িত মূলত সাহায্য ও ঋণের বিষয়াদি। এই শ্রেণীবিভাগ থেকেই দেশগুলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাজার-সুবিধা পেয়ে থাকে। সুতরাং এর সঙ্গে জড়িত বাজার-সুবিধা।

বাংলাদেশ ২০১৪ সাল থেকেই উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণীতে সবচেয়ে নিচের স্তরে ছিল। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য ছয় বছরের যে পরিকল্পনা—তাতে চলতি বছরে ঢুকল বাংলাদেশ। ফলে এতদিন বিশ্বের উন্নত দেশ ও দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত, তা আরও ছয় বছর পর্যন্ত পাবে বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে নতুন নতুন সুবিধার দ্বার উন্মোচন হবে।

মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিএনআই) মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে দেশের বিভাজন হল—

নিম্ন আয়ের দেশ: কমপক্ষে ১০৪৫ ডলার 
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ: ১০৪৬ ডলার থেকে ৪১২৫ ডলার 
উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ: ৪১২৬ থেকে ১২৭৪৫ ডলার; আর
উচ্চ আয়ের দেশ: ১২৭৪৬ ডলারের বেশি

উত্তরণের তিন সূচকের আরেকটি হল মানবসম্পদ উন্নয়ন। যা পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি। আছে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার বিষয়টিও। যা নির্ধারণ করা হয়— বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক আঘাত, জনসংখ্যার পরিমাণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিশ্ববাজারের চেয়ে অর্থনৈতিক পার্থক্যের ওপর।

এই তিন সূচকের যেকোনো দুটি অর্জিত হলে একটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের আবেদন করতে পারে। আবার কেবল মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতেও একটি দেশ এলডিসি থেকে বের হতে পারে। তবে এ জন্য মূল্যায়নের বছরে মাথাপিছু আয় নির্ধারিত প্রয়োজনীয় আয়ের দ্বিগুণ হতে হবে।

বিশ্বব্যাংক মাথাপিছু জাতীয় আয় পরিমাপ করে এটলাস মেথড পদ্ধতিতে। এতে একটি দেশের স্থানীয় মুদ্রায় মোট জাতীয় আয়কে মার্কিন ডলারে রূপান্তর করা হয়। এক্ষেত্রে তিন বছরের গড় বিনিময় হারকে সমন্বয় করা হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের ওঠা-নামার সমন্বয়ও হয়। এ কারণে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব আর বিশ্বব্যাংকের হিসাব এক হয় না।

প্রবৃদ্ধির চলমান চাকায় বাংলাদেশ
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই প্রাথমিকভাবে পূরণ করেছে। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অন্তত ৬ বছর একই শর্তগুলো পূরণ করে যেতে হবে।

জাতিসংঘের শর্ত অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ২৫ ভাগের কিছুটা বেশি।

জাতিসংঘের এই নির্ধারক কমিটি প্রতি তিন বছর পরপর বৈঠকে বসে। একটি বিশেষজ্ঞ টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর যেকোনো দেশের মূল্যায়ন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২১ সালে এ বিষয়ে প্রথম মূল্যায়ন হবে। দেখা হবে দেশটি তার অর্জনকে কতটা সুদৃঢ় করেছে। এরপর ২০২৪ সালে আরেকটি মূল্যায়ন হবে।

এই দুটি পর্যালোচনায় উৎরে গেলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব করা হবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্থায়ী স্বীকৃতি দেওয়ার।

‘লক্ষ্য-২০২১’, গন্তব্যের দিশা
উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি অর্জনের পর এবার সরকার ‘লক্ষ্য-২০২১’ ঠিক করেছে। জানা যায়, সরকারের একটি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ছিল ২০১০-২১। সেখানে বলা আছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের লক্ষ্য মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলার করা, একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার হবে ১০ শতাংশ। কেন ২০২১ সাল? এর উত্তরে সরকারের তরফে জানা গেছে, ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর। আর ২০২১ সালকে মধ্যআয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রার মাইলস্টোন করতে চায় বাংলাদেশ।

এদিকে-

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এলেও
এলডিসি হিসেবে পাওয়া সুবিধাগুলো আরও ১০ বছর পাবে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের
এলডিসি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সাল পর্যন্ত
এই সুবিধাগুলো পাবে বাংলাদেশ।

এই ১০ বছরের মধ্যে তিন বছর করে দুই মেয়াদে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এ সময়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে প্রস্তুতি নিতে হবে বাংলাদেশকে। তবে নিজ থেকে বেরিয়ে অতীতে অনেক দেশ আবার এলডিসিতে ঢুকে গেছে এমন নজিরও বিরল নয়। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রোল মডেল হতে পারে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বৈশ্বিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পারলে ‘জিএসপি-প্লাস’সহ অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় ইউরোপে পাওয়া জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই জিএসপি প্লাসের জন্য ব্রাসেলসে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। পূর্ব ইউরোপে আমাদের তৎপরতা আরও বেশি বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বাণিজ্য বাড়াতে জোর দেব। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তুত রয়েছে।’


মো. শাহরিয়ার আলম জানান, ২০২১ সাল বছরটি বাংলাদেশ উদযাপন করতে চায় মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে। সবার আকাঙ্ক্ষা, ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে এমন একটি দেশ, যে দেশটিকে সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

উন্নয়নশীল তকমা—ভালো না মন্দ
উন্নয়নশীল তকমা—ভালো না মন্দ এমন প্রশ্ন চলে আসছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের সর্বনিন্মস্তরে পদার্পণের পরপরই। সারাবাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘ভালো বা মন্দ কিছুই স্পেসিফিকলি (নির্দিষ্টভাবে) বলা যাবে না। এটি একটি অর্জন।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়াতে আমাদের মর্যাদা বাড়ল। এটা দেশের মানুষের এক ধরনের মনস্তাত্বিক অর্জন। আত্মঅহংকারে বিষয়। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ গরিবের দেশ বলতে পারবে না।’ তবে এই অর্জনের পরে কাজ আরও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ।

আতিউর রহমান আরও বলেন, ‘স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটায় বিশ্বের বাণিজ্য সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। কমবে বিনিয়োগের ঝুঁকির হার। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘উন্নয়নশীল তকমা অর্জনের সঙ্গে বৈশ্বিক ঋণের ক্ষেত্রে কিছু সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ও সাহায্যে প্রভাব পড়বে। ভারত ও চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। কিছু সুবিধা চলে যাবে, তার সমান্তরালে সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। যাতে পরবর্তী ধাপের সুবিধাগুলো পেতে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ।’

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি গৌরবের।

তিনি জানান, এই মুহূর্তেই আগের পাওয়া সুবিধাগুলো শেষ হয়ে যাবে না। বরং আগামী বছরগুলোতে আরও নতুন সুবিধা পাওয়ার পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই অন্তবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যাতে এই উত্তরণ বাংলাদেশকে বর্হিবিশ্বে সম্মানিত করে।’

প্রায় একই কথা সারাবাংলাকে জানালেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও। তিনি বলেন, ‘আগামী বছরগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়তে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়।’

তিনি জানান, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে এলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি ঋণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বেশি আসে। এই বিনিয়োগ কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াগুলো শুরু করতে হবে এখন থেকেই।

জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি দেওয়ার সময়ে সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী আবাসিক প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. মাসুদ বিন মোমেন। দ্য গার্ডিয়ানের কাছে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে ড. মাসুদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারণার সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের তকমা একেবারেই বেমানান।

তিনি মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না বাংলাদেশের। কারণ ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপিসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা এখনই খুব একটা পায় না বাংলাদেশ, তাই তেমন ক্ষতি হবে না। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি ও সমঝোতা নতুন করে করার সময় ব্যবসায়িক নেতাদের আলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা এক অবিস্মরণীয় অর্জন।’ বিভিন্ন পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও সুবিধা বাড়ল বলে উল্লেখ করেছেন এই ব্যবসায়ী নেতা। এই অর্জন ধরে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো। সামনের নির্বাচনের আগে আরও ইতিবাচক হবে।’

তবে আশাবাদের পাশাপাশি সংকটের শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘৪৭ বছরের একটি ইকোনোমিক্যাল অর্ব (অর্থনৈতিক বৃত্ত) থেকে বেরোনোর কিছু চ্যালেঞ্জ তো থাকছেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়। এই ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করে যেতে হবে রাষ্ট্রকেই।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সে জন্য দেশের নীতি নির্ধারকদের পরিপক্কতা অর্জন করতে হবে। বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেগোসিয়েশনের (দর কষাকষি) ক্ষেত্রে দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আগামী বছরগুলোতে যেন দেশে কোনোভাবেই অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সংকট তো কিছু আছেই। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে বিভিন্ন ঋণের ক্ষেত্রে যে গ্রেস পিরিয়ড (অতিরিক্ত সময়) পাওয়া যেত তা হয়তো আগের মতো পাওয়া যাবে না। বেড়ে যাবে সুদের হার, ঋণ সংক্রান্ত ব্যয় বাড়বে। ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ও যাবে কমে। মোট কথা ঋণের ক্ষেত্রে বাধা আসবে।’

ড. জাহিদ আরও বলেন, ‘বাণিজ্যে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে শুল্ক সুবিধা কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রফতানির বাজারে নতুন শর্ত যোগ হবে। বৈদেশিক রফতানির বাজার বিশেষ করে নতুন পণ্য রফতানির প্রাথমিকভাবে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। বৈদেশিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর সাহায্য ও বিদেশি ফান্ড আসাও বন্ধ হয়ে যাবে।’

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। এই খাতে দেশি-বিদেশি আরও বিনিয়োগ আসতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়াতে দিনরাত কাজ করতে হবে।’

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি যুগোপযোগী করার ওপর বেশি জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থনীতি সংস্কারে এখনই কিছু কাজে হাত দিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘সমাজের সকল ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পৃক্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সুশাসন ও সামাজিক বৈষম্য দূর করতে আরও কাজ করার আছে।’ বিশ্ববাজারে টিকে থাকার মতো নীতি সংস্কার করে মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দেওয়ার কথাও বলেছেন খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ।

প্রভাব ঋণ ও রফতানিতে
বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রফতানিসহ বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। যেমন তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায় বাংলাদেশ, যেটি বাংলাদেশের প্রধান রফতানি আয়ের সংস্থান করে। নতুন স্বীকৃতির ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া সেসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কাও করেন অনেকে।

বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের ২৭ বিলিয়ন ডলারই আসে এসব দেশ থেকে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। ২০২৭ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা কমে যাবে।

তবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলে (নিম্নমধ্য আয়ের দেশ অর্থাৎ এলডিসি) যে সব চ্যালেঞ্জ আসবে তা মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলে মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চাকরি ও সমাজসহ সার্বিকভাবে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বাড়বে। আমাদের জিএসপিসহ বেশকিছু সুবিধা থাকবে না। কিন্তু জিএসপি প্লাস সুবিধাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যে দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। কোনো কারণে বিনিয়োগের একটি পথ বন্ধ হলে শত পথ বের করতে হবে। তারপরও দেশটাকে মধ্যম আয়ের দুষ্টচক্রের সদস্য থেকে বের করে আনতে হবে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বড় অর্জন

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণকে
স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতীয় জীবনের বড় অর্জন
হিসেবে দেখছে সরকার। এ অর্জনের জন্য ২২ মার্চ
সংবর্ধনা দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
একই দিন সারাদেশে আয়োজন করা হবে আনন্দ মিছিল।
এই আনন্দ উৎসব চলবে ২৬ মার্চ অর্থাৎ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত।

সাফল্য উদযাপনের অংশ হিসেবে ২০ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী সরকারের সব বিভাগের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি পালন করা হবে। এ সময়ে দেশের সব এনজিও, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানায় মালিক-শ্রমিক সাফল্য উদযাপন উৎসব করবে। এতে থাকবে শ্রমিকদের মধ্যে ভালো খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ। এর বাইরে সারা দেশে রোডশো হবে। ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় হাতিরঝিলে হবে লেজারশো। একই দিন রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে।

স্বপ্ন এবার সামগ্রিক উন্নয়নের
স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে বড় এই অর্জনের আনন্দে জাতি আজ আত্মহারা। এই অর্জন দীর্ঘমেয়াদে ফলদায়ক কিনা এই নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে কেবল প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের আকাঙ্ক্ষা সামগ্রিক উন্নয়নের। তবেই উন্নত দেশের পথে এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশের স্বপ্ন হবে স্বার্থক।

সন্দীপন বসু: অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, সারাবাংলা.নেট

সারাবাংলা/এসবি/জেডআই/এমএম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর