গ্রেনেড হামলায় কিবরিয়া হত্যা; আজও বিচার হয়নি
২৭ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:২০
আজ ২৭ জানুয়ারি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়ার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর পূর্ণ হলো আজ। শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, কর্মজীবনে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ঝানু কূটনীতিবিদ, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা কিবরিয়া জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন রাজনীতির মাঠেও। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে নিজের নির্বাচনী এলাকায় এক জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জঙ্গীগোষ্ঠীর গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি।
তাকে বাঁচাতে না পারার পেছনে তৎকালীন সরকারের নিদারুণ অবহেলা এবং নিষ্ক্রিয়তাও দায়ী ছিল। দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে অন্তত কিবরিয়াকে বাঁচানোর সুযোগ পাওয়া যেত। সেদিন কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলীসহ ৫ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক মানুষ। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছরেও এর বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে নিহতদের পরিবারসহ সমগ্র জেলাবাসির মধ্যে।
সেদিন বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া। জননন্দিত নেতার উপস্থিতিতে জনসভায় প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। সভা শেষে সহকর্মীদের নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে বৈদ্যের বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটে আসতেই তাকে লক্ষ্য করে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গীরা। পরিকল্পনা করে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তের সময়টা বেছে নিয়েছিল তারা যেন আধো অন্ধকারে হামলা চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে পারে। বিকট শব্দে গ্রেনেডের বিস্ফোরণে এবং আহতদের গগনবিদারী চিৎকারে মুহূর্তে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেখানে। তাৎক্ষণিক নিহত ও আহত হন অনেকে, ক্ষতবিক্ষত কিবরিয়াসহ আহতদের দ্রুত নিয়ে আসা হয় হবিগঞ্জের সদর আধুনিক হাসপাতালে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। দ্রুত হেলিকপ্টার যোগে তাদের ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করার জন্য আবেদন জানানো হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন ভয়াবহ হামলার পরেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের অবহেলা ও স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি। ফলে সড়কপথেই তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় কিবরিয়ার। স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি।
কিবরিয়াসহ এতোগুলো মানুষের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে হরতাল অবরোধে হবিগঞ্জ শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পরদিন ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান এমপি বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক মামলাটির স্বাভাবিক তদন্ত না হয়ে দলীয় বিবেচনায় পরিচালিত হতে থাকে। বিশেষ করে তখনকার সময়ে ঘটা অন্য সকল জঙ্গি হামলার মতো এই হামলার পেছনে থাকা মাস্টারমাইন্ডদেরও বাঁচিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হতে থাকে। যাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছিল, তাদের সবাই ছিলেন স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। তাদেরকেই মূল আসামী দেখিয়ে মূল অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।
বাধ্য হয়ে বাদী আবদুল মজিদ পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র না রাজি আবেদন করেন তিনি। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। সরকারের আপিল হাইকোর্ট খারিজ করে দেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব পায় সিআইডি। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামী করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দায়ের করেন। এই অভিযোগপত্রে যোগ হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, লস্কর-ই তৈয়বা সদস্য আব্দুল মজিদ কাশ্মীরি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু’র ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন, মহিউদ্দিন অভি, শাহেদুল আলম দিলু, সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, ফজলুল আলম মিজান, মিজানুর রহমান মিঠু, মোহাম্মদ আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, মুফতি সফিকুর রহমান, বদরুল এনায়েত মো. বদরুল, বদরুল আলম মিজানের নাম।
কিন্তু কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া এই অভিযোগপত্রের উপরেও হবিগঞ্জের জুডিশিয়াল আদালতে না রাজি আবেদন করেন। আবেদনের কারণ হিসেবে আসমা উল্লেখ করেন, যেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোটের অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা কর্মীদের পরস্পর যোগসাজশে হরকাতুল জিহাদ সদস্যদের সহায়তায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সিলেটের মেয়র বদর উদ্দিন কামরানের ওপর দুই দফা হামলা, আওয়ামী লীগের এমপি জেবুন্নেছা হকের বাসায় গ্রেনেড হামলা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা, সুরঞ্জিত সেনের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ও কিবরিয়ার ওপর বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলা সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং তিনি মনে করছেন এর সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের আরও অনেকেই জড়িত। এই অভিযোগপত্র যথাযথভাবে দাখিল হয়নি। বিশেষ করে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমদাদুল হককে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মূল তথ্য উদঘাটন হবে বলে আসমা কিবরিয়া দাবি করেন।
তার না রাজির ভিত্তিতে আবারও অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। তার ভিত্তিতেই এখন পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম চলছে। সর্বশেষ চার্জশিটে আরও বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা এবং চারদলীয় জোট সরকার ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ৩৫ জনকে আসামি ও ১৭১ জনকে সাক্ষী করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা পারুল। ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী এ মামলার ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আসামীদের মধ্যে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিন জনের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতাসহ আরও বেশ কিছু জটিলতায় বছরের পর বছর ধরে চলছে কিবরিয়া ও তার সাথে নিহতদের হত্যামামলার বিচার কার্যক্রম।
পাকিস্তান আমলে কূটনৈতিক মিশনের সদস্য হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা কিবরিয়া একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের হয়ে কাজ শুরু করেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন সংগঠনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এবং বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক অসামান্য কূটনৈতিক ও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার একাত্তরে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল। কিবরিয়া সেই যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য এবং ওয়াশিংটনের সিনিয়র কলামিস্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সে সময়ে তিনি ওয়াশিংটন থেকে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতেন, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি, মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় হানাদার বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে পারত।
একজন সৎ, যোগ্য, ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবে শাহ এম এস কিবরিয়া ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তার পেশাগত অসামান্য অর্জনগুলোও। কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে সাফল্যের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী হিসেবে বৃদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, ক্ষুদ্র পরিসরের কৃষিঋণ কার্যক্রম, স্বল্পব্যয়ে গৃহায়ণ স্কিম, যুব কর্মসংস্থান কর্মসূচি এবং ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন যা তৎকালীন সময়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে প্রভূত ভূমিকা পালন করেছিল। তথ্যপ্রযুক্তি সামগ্রীর শুল্কমুক্ত আমদানির ক্ষেত্রেও তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেন। ১৯৯৮ সালের বন্যার প্রভাব মোকাবিলায় তিনি কাউন্টার সাইক্লিক্যাল পলিসি গ্রহণ করেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সার্থকতা ছিল জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের কাছে তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন তিনি।
একজন অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রী কিংবা ক্লিন ইমেজের পলিটিশিয়ান—যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন, আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন সবসময় জনগণের কল্যাণে, জীবনমান উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে। প্রতিদানে মানুষ তাকে ভালবেসেছিল, তার মৃত্যুতে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, আজও তাকে স্মরণে রেখেছে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারে নোংরা হয়ে পড়া রাজনীতিতে কিবরিয়ার মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৎ ভালো মানুষেরা যদি এভাবে খুন হতে থাকেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর ধর্মান্ধ উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ছোবলে, এবং তাদের বিচারের অপেক্ষা এভাবে দীর্ঘায়ীত হতে থাকে যুগ পেরিয়ে, তবে ভালো মানুষেরা কেন রাজনীতিতে আসবেন? এই প্রশ্ন করার সময় হয়েছে বোধহয়।
আওয়ামী লীগ শাহ এম এস কিবরিয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া