৬৫’র বেশি বয়সীদের কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন না দেওয়ার কোনো কারণ নেই
২৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৯:০৫
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যে অনুমোদনের পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। কয়েক দিনের ভেতরেই হয়তো অনুমোদন পেয়ে যাবে। এর ভেতরেই জার্মানি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটি ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষকে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আর এই খবর চারদিকে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের দেওয়া যাবে না।
কিন্তু ষাটোর্ধ্ব মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে করোনা ভ্যাকসিনে। কারণ আক্রান্ত হলে এই বয়সীদের মধ্যেই মারা যাওয়ার হার বেশি।
একটা ভ্যাকসিন কখন দেওয়া যাবে না? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যদি দেখা যায় যে ভ্যাকসিন দেওয়াতে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে অথবা ভ্যাকসিনটি কোনোভাবেই রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী না, শুধু তখনই কেবল ভ্যাকসিনটি না প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। এমন ঘটনা কি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ঘটেছে?
অ্যাস্ট্রাজেনেকা আলাদাভাবে বৃহৎ পরিসরে ৪০০ জন ৫৬-৮০ বছর বয়সের মানুষের উপর তাদের ভ্যাকসিনটির ফেইজ-২ ট্রায়াল চালিয়েছে যুক্তরাজ্যে। ট্রায়ালের ফলাফলে তারা দেখিয়েছে যে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দুটি পূর্ণ ডোজ বৃদ্ধ মানুষের (৫৬-৮০ বছর) শরীরেও একই রকম ইমিউন রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম, যেরকমটি দেখা গেছে ১৮-৫৫ বছরের মানুষের শরীরে। ভ্যাকসিনটি বৃদ্ধদের শরীরেও পর্যাপ্ত পরিমান নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম। উপরন্তু ভ্যাকসিনটি বৃদ্ধদের শরীরে কোন প্রকার খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি, বরং তাদের ভেতর সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ধরণ ছিল অনেকটাই হালকা (ল্যানসেট, ১৯ নভেম্বর ২০২০)।
যুক্তরাজ্য এবং ব্রাজিলে চালানো ফেইজ-৩ ট্রায়ালে তারা দেখিয়েছে যে তাদের ভ্যাকসিনটি গড়ে ৬২-৭০ শতাংশ কার্যকরী, যেখানে ৫৬ থেকে ৭০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ছিল গড়ে ১০ শতাংশের উপরে (ল্যানসেট, ৮ ডিসেম্বর ২০২০)। জার্মানি অবশ্য দাবি করছে যে এই বয়সের অন্তর্ভুক্তি ছিল ৪ থেকে ৮ শতাংশ। অ্যাস্ট্রাজেনেকা অবশ্য বলছে ১০ শতাংশ অন্তর্ভুক্তির কথা। জার্মানির যুক্তি হচ্ছে যেহেতু ভ্যাকসিনের ফেইজ-৩ ট্রায়ালে ৫৬-৭০ বছর বয়সের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৪ থেকে ৮ শতাংশ তাই এই গ্রুপের মানুষের উপর কার্যকরীতার ফলাফল অতটা নির্ভরযোগ্য নয়।
এটা ঠিক যে ফেইজ-৩ ট্রায়ালে ৫৬ থেকে ৭০ বছরের উপরের বয়সের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ২০-২৫ শতাংশ হলে সবচেয়ে ভাল হতে। তবে, অন্যদিকে এটাও ঠিক যে ভ্যাকসিনটি বৃদ্ধদের উপর বিশেষ ভাবে চালানো ফেইজ-২ ট্রায়ালে শক্তিশালী ইমিউনোজেনিক রেসপন্স ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এতে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভ্যাকসিনটি বৃদ্ধদের উপরও কাজ করবে।
বাংলাদেশে সেরামের বানানো অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন বা কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের প্রয়োগ পুরোদমে শুরু হতে যাচ্ছে। এ সময় মিডিয়াতে এ ধরণের নেতিবাচক খবর দেশব্যাপি টিকাদান কর্মসূচীকে ব্যাহত করবে।
সম্প্রতি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকবিতন্ডা চলছে। কারণ অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ইউরোপে তাদের ভ্যাকসিনের সরবরাহ মার্চ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তাদের ইউরোপে ভ্যাকসিন সরবরাহকারী বেলজিয়াম কোম্পানিটির উৎপাদন কমে গেছে। আর এই খবরেই জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলো ভিষণ চটেছে! মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন বন্দোবস্তে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ফাইজারও বলে দিয়েছে যে তারাও ইউরোপে ভ্যাকসিন সরবরাহ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। ভ্যাকসিনের বন্দোবস্তে ব্যার্থ হয়ে সেই রাগ এখন তারা ঝাড়ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার উপর!
আমাদের, বাংলাদেশিদের ইউরোপের খামখেয়ালিতে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে ৭০ বছরোর্দ্ধদের। আমাদেরও এই ভ্যাকসিন দিতে কোন সমস্যা নেই। তবে যাদের বয়স ৮০ বা ৯০ এবং যাদের শারীরিক অবস্থা খুবই নাজুক তাদের ক্ষেত্রে যেকোন ধরনের ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
লেখক- এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
সারাবাংলা/আরএফ
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস কোভিশিল্ড