ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক রুনুর ‘জয় বাংলা’
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:২৬
২৭ জানুয়ারি বিকেলে সবার চোখ ছিল টেলিভিশনের দিকে। সময়টা ছিল দেশের জন্য স্মরণীয় করে রাখার মতো। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দেশে প্রথমবারের মতো ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হচ্ছিল তখন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপির নানা আলোচনা আর সমালোচনার মুখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও করোনা প্রতিরোধে উদ্যোগী ভূমিকায় যাত্রা শুরু করেছে। সাহসী এই যাত্রা, সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। মহামারি মোকাবেলায় একমাত্র পথই হলো ভ্যাকসিন।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। দেশে সবার আগে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের টিকা নিয়ে নার্স রুনু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যারা টিকা নিয়েছেন তাদের সবার মুখেই ছিল ‘জয় বাংলা’।
করোনার থাবায় গোটা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষা কার্যক্রম অচল। অনেক উন্নয়ন প্রকল্প গতি হারিয়েছে। কমেছে রেমিটেন্স প্রবাহসহ বৈদেশিক বিনিয়োগ। জনশক্তি রফতানিসহ গার্মেন্টস খাতেও কমবেশি ধাক্কা লেগেছে। বন্ধ হয়েছে অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠান। বড় বড় ফ্যাক্টরিও খরচ চালাতে না পেরে লে অফ ঘোষণা করেছে। অর্ডার কমতে কমতে গোটা গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। বেকার হয়েছে বহু মানুষ। পেশা পরিবর্তন করে জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছে অনেক পরিবার। গোটা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থেকে শুরু করে উন্নয়নের গতি প্রায় স্তিমিত। এগিয়ে চলার চাকাটি একেবারেই আস্তে আস্তে চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘টিকা’ সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে নিয়ে আসতে পারে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ বা দ্বিমত থাকার কারণ নেই। যারা টিকা নেওয়ার বিরোধিতা করছেন তারা নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছেন। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সবার আগে উচিত ছিল টিকা নেওয়ার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে না পারলে রাজনীতি কাদের জন্য? কিসের জন্য; একথা ভুলে গেলে চলবে না। এই জায়গা থেকে বিএনপি যদি ভ্যাকসিন ইস্যুকে সবার মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করার দায়িত্ব পালন করত তাহলে এই সিদ্ধান্তটি সরকারকে সহায়তা করা বলে না। আর প্রয়োজনে সরকারকে সহায়তা করা তো বিরোধী দলের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আমাদের দেশে এ ধরণের চিন্তা বা অভ্যাস না থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন নজির কম নয়। দেশ ও মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব তো রাজনৈতিক দলগুলো এড়িয়ে যেতে পারে না। বিরোধিতার খাতিরে সবকিছুতে বিরোধিতা করতে নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময় ও বাস্তবতা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলে এর সুফল সহজেই ঘরে তোলা যায়।
প্রশ্ন হলো টিকা নিতে কেন ভয় পাব। ভয় থেকেই বিরোধিতা বা অসহযোগিতা করা। কিন্তু মহামারি তো ঠেকাতে হবে। বাঁচাতে হবে মানুষের জীবন। সুরক্ষিত করতে হবে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের। কথা হলো যেসব দেশের মানুষ ভ্যাকসিন নিচ্ছে সেখানে কি সবার মৃত্যু হচ্ছে? হয়ত বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা থাকতে পারে। সেটা টিকা ছাড়াও ভিন্ন কারণেও হতে পারে। এটাকে সার্বিকভাবে মিলালে চলবে না। করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরুর পর ইসরাইলে ১০ লাখের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে টিকা দেওয়ার এটাই সর্বোচ্চ হার। ইসরাইলের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১১ দশমিক ৫৫ জনকে এই টিকা দেওয়া হয়েছে। তার পরেই রয়েছে বাহরাইন। সেদেশে এই হার ৩ দশমিক ৪৯। তৃতীয় স্থানে ব্রিটেন, হার ১ দশমিক ৪৭।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ওয়েবসাইট, যারা বিশ্বব্যাপী এর ওপর নজর রাখছে তারা এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। যাদের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে তাদের এই হিসেবে ধরা হয়েছে। ফ্রান্সে টিকা দেওয়া শুরু হয় ২৭ ডিসেম্বর। বছরের শেষ নাগাদ তারা ১৩৮ জনকে টিকা দিতে সক্ষম হয়। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ জার্মানিতে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সে ৪০ ভাগ মানুষ জানিয়েছে যে তারা টিকা নিতে আগ্রহী। কিন্তু চীনে এই হার ৮০ ভাগ, ব্রিটেনে ৭৭ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯ ভাগ।
ভারত সরকারের একটি প্যানেল এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকাটি অনুমোদন করেছে এবং দেশটি এ বছরের মাঝামাঝি নাগাদ ৩০ কোটি মানুষকে এই টিকা দিতে চাইছে। এদিকে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচী নিয়ে জরিপ পরিচালনা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট। এতে সরকারকে তিনটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বুধবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে জরিপ দলের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে তিনটি পরামর্শ দিয়েছি।
জরিপের ফলাফল নিয়ে তিনি বলেন, আমরা দেখি ৮৪ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী। কিন্তু তার মধ্যে ৩২ শতাংশ এখন নিতে আগ্রহী বাকি ৫২ শতাংশ পরে নিতে আগ্রহী। অনেকে টিকার মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আবার বলেছেন অন্যরা নিলে আমরা নেবো। এজন্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীরা টিকা নিতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। ৮৭ শতাংশ নারী টিকা নিতে চান। অন্যদিকে ৮২ শতাংশ পুরুষ আগ্রহ দেখান। সরকারি তথ্য মতে পাঁচ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে টিকা নিতে এক লাখ ৮৬ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন। ৩৮টির বেশি জেলায় ইতিমধ্যে টিকা গেছে। বুধবার প্রথম দিন গণটিকা কর্মসূচির শুরুতে আমরা দেখেছি সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি টিকা নিয়েছেন। এ ঘটনা টিকা নিয়ে মানুষের অনিশ্চয়তা কাটাবে বলে বিশ্বাস করি।
শেষ কথা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। টিকা নিয়ে এই স্লোগান দিয়েছেন নার্স রুনু ভেরোনিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান গোটা জাতিকে দেশপ্রেম ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। নিশ্চিত হয়েছিল বিজয়। আশাকরি রুনুর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আছড়ে পড়বে দেশের সব প্রান্তে। মনোবল বাড়াবে সব ঘরের মানুষের। জনে জনে বাড়বে সচেতনতা। করোনা প্রতিরোধে জেগে উঠুক দেশের মানুষ। সৃষ্টি হোক ভ্যাকসিন নেয়ার জাগরণ। দ্রুতই করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক দেশ। দূর হোক এই বিশ্ব ব্যাধি।
লেখক: সাংবাদিক, অধিকারকর্মী