শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৩৩
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে যে কয়েকজন অমৃত-সন্তানের নাম সগর্বে উচ্চারিত হয়— সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৯৩৫-১৯৬৯) তাদের অন্যতম। তার জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালী জেলার সুধারামপুর থানার সোনাপুর গ্রামে। তিনি ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। কালক্রমে তিনি ‘সার্জেন্ট’ পদে উন্নীত হন। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার হন সার্জেন্ট জহুরুল হক।পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তাজা রক্ত ঢেলে ত্বরান্বিত করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার নাম অমর হয়ে আছে বাঙালির অন্তরে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি নিহত হন। সেই সময়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী যে গণ-আন্দোলন চলছিল, জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ডে তা বেগবান হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকা অবস্থায় পাকিস্তানি বর্বররা এই বাঙালি অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। জহুরুল হকের নির্মম মৃত্যু হলেও, তার তাজা রক্তের ধারা ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে বেগবান করে। চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায়ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হতো ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের সঙ্গে। নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হতো তাদের। সে অবস্থায় যেটুকু না খেলেই নয়, রাজবন্দীরা ততটুকু মুখে তুলতেন। বাকি খাবার কাঁটাতারের বেড়ার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত অভুক্ত শিশুদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন তারা। কিন্তু তাও মেনে নিতে পারত না পাকিস্তানিরা। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্বর পাকিস্তানি হাবিলদার মঞ্জুর শাহ বাঙালি শিশুদের বন্দী শিবিরের সামনে এনে বেদম প্রহার করে। বন্দীরা নিজ কামরা থেকে বের হয়ে এসে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান।
এ ঘটনা সম্পর্কে শহীদ সার্জেন্টের ভ্রাতুষ্পুত্রী মিমি লিখেছেন, ‘মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের লাথি মারা শুরু করে। জহুর মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ান এবং অতর্কিতে মঞ্জুর শাহ’র ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার রাইফেলটা কেড়ে নেন। মঞ্জুর শাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। …জহুর বলে ওঠে, চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি। এই কথা বলার পর জহুর সবলে রাইফেলটি মঞ্জুর শাহ’র দিকে ছুঁড়ে দেন’। এবং পরদিন সে অস্ত্রের গুলিতেই বিদ্ধ হন জহুরুল। মিমি লিখেন, ‘(পাকিস্তানি বর্বররা) রাইফেল খাড়া করে জহুরের গুলিবিদ্ধ পেটের ওপর উঠে দাঁড়াল। রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে সরাসরি পেটের মধ্যে আঘাত শুরু করল। বেয়নেটের আঘাতে জহুরের পেটের সমস্ত তন্ত্রী ছিড়ে যাচ্ছে। তবুও বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যটি ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুটের আঘাতে জহুরের কলার বোন ভেঙ্গে গেল…।’
বীরের মৃত্যুতে ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময়ের পত্রিকার অনুলিপি, ফটোগ্রাফ ইত্যাদির মাধ্যমে ইতিহাসটিকে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।
সার্জেন্ট জহুরুল হক স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন। তার সহকর্মীদের ভাষায়, ‘তাকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি। কোনো কারণে কারো কাছে মাথা নত করেননি’। এজন্যে সহকর্মী বন্ধুরা তাকে ‘মার্শাল’ বলে ডাকতেন।
সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করার খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও অন্যান্য ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। অতিথি ভবনে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এসএ রহমান ও সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদের অবস্থান করতেন। তারা উভয়েই পালিয়ে যান এবং সেখানে মামলার কিছু নথিপত্র পুড়ে যায়। গণআন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের শহীদ স্মৃতি পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ গণ-আন্দোলনের পথ ধরেই পরবর্তীকালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে। জহুরুল হক ‘বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবেন চিরকাল।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন