অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার, এক বাবার অপেক্ষার অবসান
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৪২
দীর্ঘ ছয় বছর। অবশেষে অপেক্ষার অবসান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রকৌশলী, লেখক, ব্লগার ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি)। বিচারের রায়ে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থী ব্লগার শফিকর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘আসামিরা সাংগঠনিকভাবে অভিন্ন অভিপ্রায়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে। সে কারণে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য’।
শুধু মুক্তচিন্তা নয়, যে কোনো ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যে কোনো ধরনের অবিচার, কুসংস্কার অথবা বৈষম্যের প্রতিবাদে ক্ষুরধার লেখনীতে যেমন সদাসক্রিয় ছিলেন অভিজিৎ, ঠিক তেমনি মুক্তমনা ব্লগের পাশাপাশি প্রাণের উৎস, শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব, সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র মধ্যকার সম্পর্কের মতো বৈচিত্র্যময় এবং ভিন্নধর্মী বিজ্ঞান এবং নানারকমের বিষয়ে অসাধারণ যুক্তিভিত্তিক ও সহজবোধ্য বই লিখেছেন তিনি। যা অসংখ্য কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটিয়েছে দারুণভাবে। খুব কঠিন সব বিষয়ে চমৎকার যুক্তি-তথ্য ও অভিনব লেখনশৈলীতে পাঠকের সামনে তুলে আনতে পারতেন মানুষটা, যে কারণে তার বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানী গবেষণা ও লেখাগুলো বিজ্ঞানের নানা বৈচিত্র্যময় বিষয়ে আগ্রহী করে তুলেছে অজস্র কিশোর-তরুণকে। তার চিন্তা-দর্শন-লেখা সরাসরি প্রভাব ফেলছিল অনুসন্ধানী তারুণ্যের মনন গঠনে, মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রশ্নের মাধ্যমে নতুন কিছু জানার আগ্রহ তৈরি করছিল, সে কারণেই উগ্র ধর্মান্ধ খুনির দল, ধর্মব্যবসায়ীর দল, ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মানূভূতিতে আঘাতের বায়বীয় অজুহাত প্রচার করে তৈরি করেছিল তাকে হত্যার ক্ষেত্র। এই অজুহাতই তারা ব্যবহার করেছিল তাকে নৃশংসভাবে খুনকে জায়েজ করার জন্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ধর্মান্ধ ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই নোংরা অপকৌশল সফলভাবে কার্যকর হয়েছে, ধর্মভীরু জনগণের একটা বড় অংশ নীরব থেকেছে, একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ধর্মের নামে এই খুন ইনিয়েবিনিয়ে সমর্থন করেছে, বৈধতা দিয়েছে।
অভিজিৎ রায় ঠিক কেমন মানুষ ছিলেন, সেটার সামান্য ধারণা পাওয়া যায় তার এই বক্তব্যে, ‘আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশেপাশের বহু কাছের মানুষ, বন্ধুবান্ধব সবাই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোনো রাগ নেই, নেই কোনো ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত পাই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা’।
এ মামলায় অভিযুক্ত ছয় আসামির মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আর উগ্রপন্থী অনলাইন এক্টিভিস্ট শফিউর রহমান ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিজিৎ রায় ঢাকা আসলে বিভিন্ন সময় ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে সরাসরি কুপিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল ফারাবী। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও সরাসরি প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করার অপরাধে ফারাবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আসামীর প্রত্যেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। এদের প্রধান সমন্বয়ক ও সংগঠন প্রধান মেজর জিয়াকে ক’দিন আগে দেওয়া প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলাতেও মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলাম দুই জঙ্গি সংগঠনের জঙ্গিরা লেখক-প্রকাশক-ব্লগার-শিক্ষক থেকে শুরু করে অনেক বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বছরব্যাপী। প্রতিক্ষেত্রেই তারা ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভূতির বায়বীয় অজুহাত ব্যবহার করেছে তাদের এই নৃশংসতা জায়েজ করতে। আর যেখানে মত-পথ-দল নির্বিশেষে এই কোপানো আর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল, সেখানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হয় চুপ ছিলাম অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেছি। ফলে দিন দিন এই উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিরা আস্কারা পেয়েছে, তাদের স্পর্ধা বেড়েছে, বেড়েছে তাদের হামলার তীব্রতা ও ক্ষেত্র।
সেজন্যই আজ রায়ের খবর পাওয়ার পরেও জঙ্গিদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা তো বহুদূরের কথা, চরম নোংরা স্পর্ধা দেখা যাচ্ছে। ফারাবীকে রায়ের পর কিছুটা বিমর্ষ দেখালেও বাকি তিনজন রায়ের আগে ও পরে ছিল একই রকম ‘উৎফুল্ল ও উদ্ধত’। তাদের একজন দুই আঙুল তুলে ‘ভি’ চিহ্নও দেখিয়েছে। আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, সহযোদ্ধা হারানোর বিচারের রায়ই পেয়েছি কেবল, কিন্তু যুদ্ধটা এখনো শেষ হয়নি।
শুধু আমজনতা নয়, এ দেশেরই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল-শিক্ষিত-ভদ্রসমাজের সুধীজনেরা প্রত্যেক লেখক-প্রকাশক-ব্লগার-মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যার পর ‘নাস্তিক মরলে আমরার কী’, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে তো মরবই’, ‘’বুঝলাম মাইরা ফেলা ঠিক না, কিন্তু লেখালেখি কইরা অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া কি ঠিক?’, ‘মারা ঠিক হয় নাই, কিন্তু এগুলা লেখা কি ঠিক হইছে?’, ‘মারছে ভালো করছে, কর্মফল পাইছে, উচিত শিক্ষা হইছে’, ‘অনুভূতিতে বিশ্বাসে আঘাত দেবে আর মারবে না?’, ‘বিশ্বাসে আঘাত আসলে তারা মারতেই পারে, কিভাবে তাদের জঙ্গি বলেন’ ইত্যাদি নানাপ্রকার কারণ দেখিয়ে তোয়ালে নিয়ে দৌড়ে এসে জঙ্গিদের হাতের তাজা রক্ত মুছে দিয়েছিলেন। এই মেরুদণ্ডহীনদের নানা রঙ আর নানা তরিকার তোয়ালের আপ্রাণ মোছামুছিতে এতোগুলো নৃশংস খুন জায়েজ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বিশ্বাসে আঘাতের অজুহাতে যাকে তাকে যখন তখন খুন করে ফেলা যায়, সেটা ‘ঠিক’ রায় দিতে এবং খুনিদের বীর হিসেবে অভিনন্দন জানানোর জন্য জাগ্রত জনতা তো আছেই।
চাইলেও এগুলো ভোলা যায় না। ভোলা যায় না যে এরপর জঙ্গিদের চাপাতি নানা লাশ টপকে পৌঁছে গেল হলি আর্টিজান রেস্তোরায়। ধর্মকে ব্যবহার করে জবাই আর কুপিয়ে ফালাফালা করা হলো এতোগুলো মানুষকে। ভিনদেশের, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, নিরপরাধ মানুষগুলোকে বিনা কারণে মেরেছিল জঙ্গিরা। গর্ভবতী মা পর্যন্ত রক্ষা পায়নি জঙ্গিদের হাত থেকে। ঠাণ্ডা মাথায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল, জবাই করেছিল তাদের।
অভিজিতের মৃত্যু এলোমেলো করে দিয়েছিল তার পুরো পরিবারকেই। সন্তানকে পৈশাচিকভাবে মেরে ফেলার পর থেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন বাবা ড. অজয় রায়। কিন্তু তবুও হাল ছাড়েননি, সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে গেছেন দিনের পর দিন। কিন্তু নানা অসুখ তাকে ভালো থাকতে দিলো না। আগে থেকেই ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি ফুসফুসের সমস্যাজনিত রোগেও ভুগছিলেন অনেক দিন থেকেই। তার ব্রংকাইটিস, সিওপিডি জটিলতা ছিল। এই মানুষটা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অজয় রায় কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন । সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য হিসবে নিয়োজিত ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে অসম্ভব সৎ ও নির্বিরোধী মানুষটার জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।
অভিশপ্ত ওই দিনটায় মানুষটা হারান তার সন্তানকে, যে সন্তান চাইলেই বিদেশের মাটিতে নিরাপদে থাকতে পারতেন। তবুও অভিজিৎ উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গিদের শত হুমকি আর ভয় উপেক্ষা করে অমার্জনীয় দুঃসাহসে দেশে ফিরেছিলেন একুশের বইমেলায় অংশ নেওয়ার জন্য। স্বজন হারানোর ব্যথায় আজ যে সিদ্ধান্তকে আমাদের মনে হয় নিদারুণ ভুল, কেন ফিরে আসলো মানুষটা, না আসলেই তো বেঁচে থাকতো। দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকতো, অন্তত এভাবে অকালে তাকে হারাতে হত না। তবে মানুষটা যে ছিলেন তার বাবার মতোই অসমসাহসী, জন্মভূমিকে ভালোবাসার মাশুল দিতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন চিরতরে!
আজ অভিজিৎ রায়ের হত্যার বিচারের রায়ের দিনে ওই একরোখা অসমসাহসী মানুষটাকে মনে পড়ছে। সন্তানের হত্যার বিচারের অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রহর পেরিয়ে ক্লান্ত পায়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেছেন অজয় রায়, দেখে গেলেন না তার সন্তানকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যাকারীদের ফাঁসীর রায় হয়েছে। অভিজিতের খুনিদের বিচারের রায় পেলেও অভিজিৎকে মেরে ফেলে মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং বিজ্ঞানচর্চার ধারাকে চাপাতি দিয়ে থামিয়ে দেওয়া উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী জঙ্গিরা, ধর্মব্যবসায়ীরা থেমে নেই, ক্যানসারের মতো দিন দিন বেড়েই চলেছে তাদের বিস্তার। অভিজিৎ হারিয়ে গেলেও আলো হাতে আঁধারের যাত্রীরা সময়ের প্রয়োজনে চলছেই, লড়াইটা কিন্তু কখনো শেষ হয়নি।