শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বুলেটের সামনে দাঁড়ানো ডঃ জোহার গল্প!
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৬:৩৯
জীবন বাজি রাখা শব্দটা প্রায়ই শুনি আমরা। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাজি রাখার প্রয়োজন খুব একটা হয় না, এটা উচ্চারণ করতে পারাটাই অনেক কিছু। কিন্তু কখনো কখনো সত্যিই কিছু মানুষ আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাজি রাখেন এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করে হলেও রক্ষা করে যান রক্ষা করবার প্রতিশ্রুতি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ ডঃ শামসুজ্জোহা ছিলেন ঠিক সেরকম এক অকুতোভয় অবিস্মরণীয় বীর। ৫২ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নিজের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে পাকিস্তানী সেনাদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন তিনি। যার অপরিমেয় আত্মত্যাগ বারুদে হলকা বইয়ে দিয়েছিল উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ছিলেন তিনি।
১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করা জোহা ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯৫০ সালে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া জোহা অনার্স শেষ করে ১৯৫৩ সালে এবং পরের বছর এমএসসি শেষে করে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান অর্ডন্যান্স কারখানায় সহযোগী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল অর্ডন্যান্স কারখানায় যোগ দিলেও পরের বছরেই দেশে ফিরে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে লেকচারার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বৃত্তি নিয়ে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে চলে যান তিনি। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালে ফিরে আবার অধ্যাপন শুরু করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে ও গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেও পাকিস্তানী জান্তা সরকারের শোষণ নিপীড়ন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙ্গালীর প্রতিবাদের সাথে সবসময়ই একাত্ম ছিলেন অধ্যাপক জোহা। ১৯৬৮ সালের ১ মে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ পান। ফলে একে তো শিক্ষার্থীসহ আপামর জনগণের মুক্তি আন্দোলনের অংশ ছিলেন তিনি, অন্যদিকে প্রক্টর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হয়ে তাদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিল। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হতে শুরু করে। বিশেষ করে পাকিস্তানী সামরিক সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় গণআন্দোলন শুরু হয়। এমন এক সময়ে ড. জোহার কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিল তার শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখা। কারণ ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলে তাঁদের হত্যার প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে যে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়, তার জোয়ার শুরু হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও।
১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে ধর্মঘটে ও প্রতিবাদে। শিক্ষার্থীরা ছাত্রনেতা আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু মুক্তির দাবীতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের করলে ওই বিক্ষোভে পুলিশ হামলা চালায়। এতে বহু ছাত্র আহত হয়। অভ্যুত্থানের একজন হিসেবে গণজোয়ারের অংশ হবার প্রচন্ড ইচ্ছে দমিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে ড. জোহা ছাত্রদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন এবং আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন রাতে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেছিলেন, ‘শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।’
এরফলে প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যাক্তি মনে করে, যেহেতু জোহা এক ডাকে শিক্ষার্থীদের এই বিশাল মিছিল ফেরাতে পেরেছেন, এর অর্থ জোহার পক্ষে তাদের রাস্তায় নামানো খুবই সম্ভব। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সেদিন জোহার কথা কাটাকাটিও হয়। তারা এই মিছিলের জন্য জোহাকেই প্রধান উস্কানিদাতা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ফলে পরদিন ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা।
আগেরদিনের হামলা ও শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদে পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি আবারো রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। প্রশাসন ও সেনাবাহিনী সেই বিক্ষোভ দমাতে নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ফলে মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীরা এবং ইপিআর-সেনাবাহিনী-পুলিশ। নিজের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ছুটে আসেন অধ্যাপক জোহা। রীতিমত দুপক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে বোঝাতে শুরু করেন। একদিকে তিনি আপ্রাণ চেষ্টায় শিক্ষার্থীদের বোঝাচ্ছেন যেন তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে, অন্যদিকে সেনা কর্মকর্তাদের বোঝাচ্ছেন যেন তারা ফায়ার ওপেন না করে। বারবার বলছিলেন তাদের, ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে এখান থেকে।’
শিক্ষার্থীদের তিনি অভয় ও আশ্বাস দিচ্ছিলেন এই বলে যে, “আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে”। ডঃ জোহার এই উক্তি যে স্রেফ কথার কথা ছিল না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পরেই। জোহা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেলেছিলেন যেন তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। কিন্তু তখনই কমান্ডে থাকা পাকিস্তানী লেফট্যানেন্ট অর্ডার দেয়, “ওপেন ফায়ার এন্ড কিল দেম”।
অকুতোভয় অধ্যাপক জোহা তার কথা রেখেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। শিক্ষার্থীদের রক্ষা করে বুকটা পেতে দিয়ে সেই গুলি নিয়েছিলেন নিজের বুকে। যেমনটা তিনি বলেছিলেন, তার বুকের উপর দিয়ে গুলি করতে হবে। একজন শিক্ষক নিজের শিক্ষার্থীদের ভরসা দিয়েছিলেন যে গুলি চলবে না, যদি চলেও, তার কোন শিক্ষার্থীর বুকে লাগার আগে তার বুকে লাগবে সে গুলি। তিনি সেই কথা রেখেছেন, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বুক পেতে গুলি নিচ্ছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অভাবনীয় দৃশ্য সম্ভবত খুব বেশি নেই।
সেসময় আহত হন আরও দুজন শিক্ষক ড. মোল্লা ও মুহম্মদ আবদুল খালেক। এক বছর পর বের হওয়া স্মরণিকায় মুহম্মদ আবদুল খালেক লেখেন, ‘ড. মোল্লা ও আমার অবস্থা জানতেই তিনি যখন ছুটে আসছিলেন সেই মুহূর্তে তাকে বেয়নেট চার্জ করা হয়। রক্তে তার জামা ভিজে গেছে, জওয়ানদের হাতে আমি বন্দি।..জওয়ানরা আমাকে হিড়হিড় করে মিলিটারি ভ্যানে তুলে ফেললো। আমি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ডেকে চিৎকার করে বললাম ড. জোহা মারা যাচ্ছেন, তাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।’
পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর নির্দয়তম এই হত্যাকাণ্ডে নিহত অধ্যাপক ডঃ জোহার লাশ যেন নতুন বারুদের যোগান দেয় স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। সারাদেশের পাকিস্তানী সেনাদের এই নির্মমতা এবং ডঃ জোহার এই অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের কথা ছড়িয়ে পড়ে। যার খুব দ্রুতই আইয়ুব শাহীর পতনে রাখে অন্যতম প্রধান ভূমিকা।
সেই ডঃ শামসুজ্জোহার মহাপ্রয়াণ দিবস আজ। ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে এই অসামান্য আত্মত্যাগের, কিন্তু তবুও আজকের দিনেও শিক্ষার্থীদের জন্য, ন্যায়ের জন্য, আদর্শের জন্য ডঃ জোহার এই আত্মত্যাগের ইতিহাস কি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক! আজকের দিনে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা বিলীনপ্রায় , সামান্য ব্যাক্তিস্বার্থে আদর্শ আর নীতির জলাঞ্জলি দেন তারা নিয়মিত, এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে ডঃ শামসুজ্জোহার মতন অকুতোভয় অসমসাহসী বীরের প্রয়োজন খুব করে অনুভব হয়!
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের জন্ম ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই আত্মত্যাগের গল্পটা আমরা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারিনি। সারাদেশের মানুষের জানবার কথা ছিল এই ইতিহাসটা, প্রয়োজন ছিল প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডঃ শামসুজ্জোহার বীরত্বগাথা শিক্ষার্থীদের জানবার চেষ্টা করা। কিন্তু সেরকম উদ্যোগ খুব বেশি চোখে পড়ে না। অথচ আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবারই নৈতিক উন্নয়ন, আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চায় ডঃ জোহা হতে পারেন এক অনন্য অনুপ্রেরণা ও প্রাণশক্তির জায়গা। মৃত্যুদিনে দুঃসাহসিক ডঃ জোহাকে স্মরণ করি অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই/