Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, বিদায় কিংবদন্তী


২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৫১

আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। এতো চমৎকার একটা নাম তার, কিন্তু এ নামে সম্ভবত প্রায় কেউই তাকে চেনেন না। তিনি আমাদের কাছে পরিচিত, অসম্ভব প্রিয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান নামে। চেষ্টা, ধৈর্য আর নিবেদনে অভিনয়কে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এক অসামান্য কিংবদন্তীর স্থানে। গিয়েছিলেন বলতে হচ্ছে, কারণ বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো আজ সকালে মানুষটা অনেকটা নীরবেই আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। না, কোনো নোংরা গুজব নয়, সত্যিই এবার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

গত বুধবার বিকেলে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকেরা প্রথম দিকে ধারণা করেছিলেন, এ টি এম শামসুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত। পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হয়। ফলাফলে জানা যায় করোনা নেগেটিভ। এ ছাড়া দুই দিনের চিকিৎসায় তার শারীরিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন কারণ তার শরীর দুর্বল, গত কয়েক বছরে অনেকগুলো অপারেশন হয়েছে, এই বয়সে শরীরে এতো ধকল সইবে কি-না। সকল পরীক্ষার রিপোর্টের ফল ভালো পেয়ে কিছুটা নিশ্চিত হয়েই গতকাল শুক্রবার হাসপাতাল থেকে বাসায় নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু আজ (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে কোনো এক সময়ে পরিবারের সদস্যদের অজান্তে নীরবেই মারা যান এই গুণী অভিনেতা। আমাদের বিবর্ণ সময় যেন আরেকটু বিষণ্ণ আর ধূসর হয়ে গেল এ সংবাদে।

বিজ্ঞাপন

শুধু অভিনেতা হিসেবে নন, একজন পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে অসামান্য অবদান রাখা এই কিংবদন্তীর চলচ্চিত্র জীবনের শুরুটা কিন্তু ছিল পরিচালক হিসেবে। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর “বিষকন্যা” চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা’র ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে প্রথম কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেন তিনি। মঞ্চাভিনয় থেকে শুরু করে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে ১৯৬৫ সালের দিকে পদার্পণ ঘটলেও তিনি মূলত আলোচনায় আসেন ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের “নয়নমণি” চলচ্চিত্রে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে।

অজস্র সিনেমায় অভিনয় করেছেন এটিএম , যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘গেরিলা’ ‘বড় বউ’, ‘অবুঝ মন’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘স্লোগান’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘সংগ্রাম’, ‘ভুল যখন ভাঙল’, ‘চোখের জলে’, ‘লাঠিয়াল’, ‘অভাগী’, ‘নয়ণমনি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘পুরস্কার’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘রামের সুমতি’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘দোলনা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘অজান্তে’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘তোমার জন্য পাগল’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘শশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শশুর’, ‘আধিয়ার’, ‘শাস্তি’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ ইত্যাদি। আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, কাজী জহির প্রমুখ পরিচালকের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করলেও পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে ২০০৯ সালে রিয়াজ-শাবনূর জুটিকে নিয়ে তৈরি করেন ‘এবাদত’ চলচ্চিত্রটি।

অভিনয়ের জন্য আজীবন সম্মাননাসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ছয় বার। এর মধ্যে “দায়ী কে(১৯৮৭)” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে, ম্যাডাম ফুলি (১৯৯৯), চুড়িওয়ালা (২০০১) ও মন বসে না পড়ার টেবিলে (২০০৯)চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে এবং চোরাবালি(২০১২) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে পুরস্কৃত হন। এছাড়াও ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে তিনি চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। অভিনয়জীবনের শুরু থেকেই মঞ্চের পাশাপাশি ষাটের দশক থেকেই টিভি নাটকে অংশগ্রহণ ছিল তার। যা অব্যাহত ছিল জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত। বিশেষ করে গত এক দশকে তার অসংখ্য টিভি নাটক জনপ্রিয় ও দর্শকনন্দিত হয়েছে। যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি টিভি ধারাবাহিক হচ্ছে—‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’ প্রভৃতি।

কিন্তু এই নানা কীর্তি বা পুরষ্কারের চেয়েও সবচেয়ে জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণ যে অবদানটা তিনি রেখেছেন আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল ও দর্শকদের মনন গঠনে। ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এটিএম শামসুজ্জামান। তার বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। মা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড় বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন সূত্রাপুর দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে পৈত্রিক বাড়িতে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে।

ষাটের দশক থেকে অভিনয়ে আসার পর প্রায় অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অভিনয়ের প্রতি অসামান্য নিবেদন, পরিশ্রম এবং চলচ্চিত্রশিল্পে অকল্পনীয় প্রচেষ্টায় নানাবিধ উপায়ে অবদান রেখে তিনি যেমন অভিনয়ের এক অনবদ্য ইনস্টিটিউশন হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, ঠিক তেমনি দর্শকের পছন্দ ও রুচির বিকাশেও রেখেছেন চমৎকার ভূমিকা। আর দেশপ্রেমের জায়গায় এটিএম শামসুজ্জামান সবসময়ই ছিলেন নিজের জাতিসত্তা ও জন্ম ইতিহাসের শেকড়ের প্রতি দায়বদ্ধ। গেরিলা চলচ্চিত্রে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পুরনো ঢাকার এক জাঁদরেল স্বাধীনতাকামী ব্যক্তিত্বের চরিত্রে কী দুর্দান্ত অভিনয়টাই না করেছেন তিনি! একাত্তরের সেই ভয়াবহ সময়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের গণহত্যা ও অত্যাচারের বীভৎস সময়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসা পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মেলানো মহল্লার মসজিদের সুবিধাবাদী বেইমান মওলানা যে তীব্র ভাষায় ভৎসর্না ও অপমান করেছিলেন তিনি, সেই অভিনয়টা আজও দর্শকদের মানসপটে উজ্জ্বলতম সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে। এমন আরও অজস্র অভিনয়ে দর্শকের মননে অসামান্য জায়গা নিয়ে আছেন এটিএম।

অথচ এই মানুষটিকে বারবার সোশ্যাল ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় মেরে ফেলেছি আমরা। বেশ কয়েকবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়েছে সর্বস্তরে। বিশেষ করে গত বছর করোনার সময়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন তিনি সূত্রাপুরে নিজের বাসায় ছিলেন। এতা সত্য যে, গত কয়েক বছর ধরেই এটিএম অন্ত্রে জটিলতা, শ্বাসকষ্টসহ বেশ কিছু রোগে ভুগছিলেন। বেশ অনেকদিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল এবং বেশকিছু অপারেশনের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য এমন একজন গুণী মানুষকে বারবার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে অপমান করা ভয়াবহ ধৃষ্টতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা সংঘবদ্ধ চক্র খুব পরিকল্পিতভাবে কিছু দিন পরপরই এই নোংরা ঘটনাটা ঘটিয়েছে। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্যটাও অজানা নয়। আজকে এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন পোস্টে নানা নোংরা মন্তব্যের মাধ্যমে এ মুহূর্তে যারা উল্লাস করছে, অভিশাপ দিচ্ছে, তাদের মন্তব্যের ধরণ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গাটা একবার খোঁজ নিয়ে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়—কেন এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়েছে বারবার। কারা তার মৃত্যুতে খুশি হয়।

এক আক্ষেপ ছিল তার। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন, খুব ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ একটা সিনেমা বানাবেন। বাজেট হিসেব করেছিলেন ২ কোটি টাকার মতো। কিন্তু এই টাকা তাঁর কাছে তার কাছে ছিল না, দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছেন এই আশায়, কোনো একজন প্রযোজক হয়তো তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবেন। তার শেষ ছবির গল্পও ঠিক করে রেখেছিলেন। খুব করে চেয়েছিলেন শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়ার আগেই তার এই গল্পটা রুপালি পর্দায় চিত্রায়িত করে যেতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হলো না। এক জাতীয় দৈনিক থেকে মাঝে একবার তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তার স্ত্রী রুনি জামান এটিএমের চলচ্চিত্রটি বানানোর প্রবল ইচ্ছা কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘তিনি ছবি বানানোর ঘোরেই থাকেন সব সময়।কেউ ছবির কথা জিজ্ঞাসা করলেই তার খারাপ লাগে। ছবিটা বানানো তার স্বপ্ন। এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি প্রতিদিনই বলেন, মনের মতো ছবি বানিয়ে মরবো’।

এটিএম শামসুজ্জামানের সেই শেষ ইচ্ছেটা আর পূরণ হয়নি। তার অভিনয় প্রতিভার প্রায় কিছুই ব্যবহার করতে পারিনি আমরা, তবুও প্রবল নিবেদন আর প্রচেষ্টায় আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প এবং সার্বিক সংস্কৃতি অঙ্গনকে কেবল সমৃদ্ধই করে গেছেন এই গুণী কিংবদন্তী। তাকে হারানোর শূন্যতা কখনই পূরণ হবে না। তবুও প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রিয় মানুষদের চলে যেতে দিতে হয়, অভিমান আর না বলা কষ্টদের বুকে চেপে তারা চলে যান জাগতিক সবকিছু ছেড়ে, আমাদের আরেকটু ফাঁকা করে!

প্রিয় আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আপনি চিরকাল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন, চিরসবুজ থাকবেন আপনার কর্মে-কীর্তিতে!

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর