Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু


২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:০৪

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনা সবই এসেছে আমাদের সংস্কৃতি থেকে। এই সংস্কৃতির ধারক হলো ভাষা। এক হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান চারটি প্রধান জনগোষ্ঠীর ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান রূপ পেয়েছে। এই ভাষার মাঝেই আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশকে পাকিস্তান হিসেবে একীভূত করার। কিন্তু সংস্কৃতির যে বিরূপ মনোভাব তা সম্পূর্ণই আলাদা। বারো হাজার মাইল দূরবর্তী দু’টি জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা, আহার, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই ছিল ভিন্ন। এই যে দু’টি জাতি, এর মাঝে উর্দুভাষীদের কয়েকটি গ্রুপ মিলে একটি জাতি এবং বাংলাভাষীরা তথা বাঙালিরা একচ্ছত্রভাবে ছিল পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী। এই বাঙালির জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার জন্যই সব আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশ নামক এ ভূখণ্ডে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসকগোষ্ঠী চেষ্টা করেছে পূর্ব পাকিস্তানের সকল সম্পদ দিয়ে পাকিস্তান গড়ে তোলার। এজন্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধের সময় ১৭৩ কোটি টাকা পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পণ্য পাট বিক্রি করে আয় হলেও উপার্জিত একটি টাকাও পূর্ব পাকিস্তানে আসেনি, কেন্দ্রীয় সরকার তা ব্যয় করেছে। এমনকি, কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো দফতরও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। নামকাওয়াস্তে ঢাকায় রাজধানী থাকলেও সবকিছুই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাঙালি জাতি বুঝতে পারে এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

বিজ্ঞাপন

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরও স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীকারের আন্দোলন চলমান ছিল। ভাষা আন্দোলনে যখন চরম অবস্থায় পৌঁছল, গুলিবর্ষণ করা হলো বাংলাভাষাকামী জনগণের ওপর। সালাম, বরকত, রফিক ও জাব্বাররা শহিদ হলেন। রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়েই পূর্ববাংলার আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটানো যায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ নেতা হিসেবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, জেলখানা থেকে ভাষার লড়াইয়ে নির্দেশনাও দিয়েছেন। এরপর বঙ্গবন্ধু ভাষার লড়াইকে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে ধাবিত করলেন। বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি ভাষা আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সঙ্গে গ্রথিত করে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ ছয় দফা ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে নিয়ে যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করলেন যে, তিনিই বাঙালির এবং বাংলার নেতা। আর কেউ বাংলার মুখপাত্র নন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরও সংসদ অধিবেশন বসাতে দিলো না। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা নিয়ে দরকষাকষি করতে চাইল। শেখ মুজিব খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব চান না, বাংলার মানুষের অধিকার চান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল তারই, কিন্তু তিনি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলেন, সত্তরের নির্বাচনে জনগণ ছয় দফার উপর যে ম্যান্ডেট দিয়েছে তার ভিত্তিতেই সংবিধান এবং বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু কখনও স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপস করেননি, বাঙালি জাতিসত্তার জন্য বারবার তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও চেয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, পাকিস্তানের কারাগারে তাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। কোনোকিছুই দমাতে পারেনি বঙ্গবন্ধুকে। বাংলার জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট পাওয়া সত্ত্বেও যখন সংসদ অধিবেশন বসতে দেওয়া হলো না, তখন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। ৩ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ—এই ২৩ দিন বস্তুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই অলিখিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সমগ্র বিশ্বে এটা একটি বিরল এবং বিস্ময়কর ঘটনা। তিনি ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে পাকিস্তানের সরকারকে অস্বীকৃতি জানিয়ে পাল্টা সরকার গঠন করেন। এ আন্দোলনে তিনি প্রমাণ করেন পাকিস্তান বাংলাদেশকে শাসন করার সকল নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ একটি দেশ হিসেবে জন্ম নেওয়া বা এর স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সমগ্র সংগ্রামের মুল নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাতিসত্তায় রূপান্তর করে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার নেতৃত্বের একমাত্র কৃতিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এ কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিও।

লেখক: সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর