শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ‘অক্সিজেনের কারখানা’ !
২১ মার্চ ২০১৮ ০৮:২৩
গাছপালা তথা বনভূমি হচ্ছে প্রাকৃতিক ‘অক্সিজেনের কারখানা’। যেখানে উৎপাদিত হয় প্রাণী বাঁচিয়ে রাখার অপরিহার্য উপাদান। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব মানুষ-ই ধ্বংস করে দিচ্ছে বন; বন্ধ করে দিচ্ছে অক্সিজেন উৎপাদন।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি অঞ্চল বা দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। একদিকে বন যেমন মনুষ্য সভ্যতার জন্য জরুরি, অপর দিকে তা বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল। ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের ২৩তম সাধারণ সভায় জাতিসংঘের মহাসচিব ২১ মার্চকে ‘বিশ্ব বন দিবস’ ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২১ মার্চকে ‘বিশ্ব বন দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
২০১৮ সালের বন দিবসের প্রতিপাদ্য— ‘বন ও টেকসই শহর’। বিশ্ব বন দিবসের মূল তাৎপর্য হল পৃথিবীব্যাপী মানুষের মধ্যে বনের সংরক্ষণ, উৎপাদন ও বনের মাঝে বিনোদন সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে— সবুজেঘেরা আমাদের এই বাংলাদেশেও নেই আয়তন অনুযায়ী পর্যাপ্ত বনভূমি। দেশটির মোট ভূমির মাত্র ১৫.৭৯ শতাংশ বনভূমি। পরিতাপের বিষয় পঞ্চাশের দশকেও বাংলাদেশে প্রায় ২৪ শতাংশ বনভূমি ছিল। অথচ শত চেষ্টা করেও মানুষের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বনকে রক্ষা করতে পারছে না বন বিভাগ।
বনভূমি যেমন ব্যক্তিগতভাবে দখল হয় তেমনি দাফতরিকভাবেও দখল হয়। বন অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য (২০১৬) অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সরকারিভাবে ৬৪০০২.৮০ হেক্টর বনভূমি হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর দৈনিক ভোরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী— কক্সবাজার জেলার মাতামুহুরী এবং মহেশখালী এলাকায় ২৩ হাজার একর জায়গা জুড়ে ‘চকরিয়া সুন্দরবনের’ অবস্থান ছিল। সেই এলাকায় আজকে নেই কোনো বনের অস্তিত্ব। বন পরিণত হয়েছে জলাভূমিতে। সেখানে এখন চলছে চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা।
বন রক্ষার জন্য আমাদের দেশে রয়েছে ‘বন আইন ১৯২৭’। সারা পৃথিবীতে ১.৬ বিলিয়ন দরিদ্র মানুষের খাদ্য, তন্তু, পানি ও ঔষধের যোগান হয় বন থেকে। বন তথা বৃক্ষ কার্বন শোষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রভাব কমিয়ে আনে। শহরাঞ্চলে কৌশলগত বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বাতাসের তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনা সম্ভব, এতে করে এয়ারকন্ডিশনের ব্যবহার ৩০% কমে যাবে। একটি শহরের বায়ু হতে ক্ষতিকর দূষক ও সূক্ষ্ম কণাসমূহ অপসারণের মাধ্যমে গাছ চমৎকারভাবে বায়ু ফিল্টার হিসাবে কাজ করে। এমনকি বেশি গাছপালা থাকার কারণে শব্দ দূষণের মাত্রাও কমে যায়।
আমাদের নানাবিধ ব্যবহার এই শক্তির আধারকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। ফোর্স মাইগ্রেশন বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ, সম্প্রতি বাংদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার বনভূমির ওপর বিরাট চাপ এসে পড়েছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে উখিয়া উপজেলার বনভূমির ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে, এতে দেখা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পূর্বে ওই এলাকার বনভূমির পরিমাণ ছিল ৬৫.৪৯% রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির তৈরি করার পর বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ৫৪.৩৯%। এটা শুধু বনাঞ্চলের ওপর চাপ তা নয়, আগামী বর্ষায় ওই এলাকায় ভূমিধ্বসের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হচ্ছে ইটের ভাটায়। নগরায়নের জন্য ইটের বিকল্প নেই, কিন্তু এই ইট তৈরিতে যে পরিমাণ পরিবেশ যে পরিমাণ কার্বন দূষণ বাড়েছে তা শোষণ করবার মতো প্রয়োজনীয় গাছপালাও আমরা শেষ করে ফেলছি। আবার আমরা নগরায়নের বিরুদ্ধে যেতে পারছি না। তাহলে উপায় কী?
ছাদ বাগান (Roof top Gardening) পদ্ধতি কিছুটা হরেও ফিরিয়ে দিতে পারে আমাদের হারানো সবুজ প্রকৃতি। যান্ত্রিক শহরকেও আমরা সবুজ করে তুলতে পারব, কমিয়ে ফেলতে পারব বায়ুতে কার্বন পরিমাণ। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ২০১৭ সালে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ছাদ বাগানের ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে দেখা যায় যে ধানমণ্ডি এলাকার ৩৯.১% বাড়িতে ‘ছাদ বাগান’ রয়েছে। পুরাতন বাড়ির ছাদকে ড্যাম্প প্রুফ করে সেখানে মাটি ফেলে বা টবে গাছ লাগান যায়, নতুন বাড়ি নির্মাণের সময় ছাদের জন্য অতিরিক্ত লোড হিসাব করে বড় পরিসরে ছাদের ওপর বাগান করা সম্ভব।
সহ-লেখক: আব্দুল্লাহ আল নাঈম, মো. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী। লেখকরা স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা ও গবেষণায় সংযুক্ত।