নবান্নের লড়াই; পশ্চিমবঙ্গে শেষ হাসি কে হাসছেন?
১ মার্চ ২০২১ ১১:৫০
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একদিকে এখন অসাম্প্রদায়িক উপমহাদেশের প্রাণপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী চলছে, অপরদিকে তারই জন্মস্থানের সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে যুদ্ধের ডামাডোল ঘাসফুলে-পদ্মফুলে, উপলক্ষ পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। যেখানে প্রায় রাজ্যেই এখন গেরুয়া ঝাণ্ডার জয়জয়কার, সেখানে বাংলা অঞ্চল বিজেপির অধরাই রয়ে গেছে। তাই বিহারের সাফল্যের পরপরই মোদী-শাহদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠাতা শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্য বাংলায় পদ্মফুল ফুটানো। অপরদিকে সারাবিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় থাকা পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনাবসান ঘটিয়ে ২০১১ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনার পরিস্থিতির কারণে ২৭ মার্চ থেকে ৮ ধাপে হতে চলা এবারের নির্বাচনে তাই দিদির “মা, মাটি, মানুষ” আর দিলীপ ঘোষদের “এবার বাংলা, পারলে সামলা” স্লোগান লড়াইয়ে শেষ হাসি কারা হাসবে তা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
তবে গত নির্বাচনগুলোর মতো এবারও জয় পরাজয়ের পার্থক্য নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা থাকবে ধর্মীয় মেরুকরণের এবং বলা যায় এবার আসলে কারা জিতবে সেটা এক প্রকার নির্ভর করছে ধর্ম-রাজনীতির মিথস্ক্রিয়াকে কারা কতটা সফলভাবে মোকাবিলা বা প্রয়োগ করছে। এই বিবেচনায় এখন চালকের আসনে অবস্থান করছে বিজেপি। তারা বাংলায় এখন যে ধর্মের জোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছে তা সারা ভারতেরই এক খণ্ডচিত্র। মমতার ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাজনীতিও বৃহত্তর অর্থে এই মিথস্ক্রিয়ারই অংশ, যেমনটা বাম-কংগ্রেস জোট অবশ্য বলার চেষ্টা করে যে বাংলায় বিজেপিকে জায়গা করে দিয়েছিলেন মমতাই, একসময় তাদের অদৃশ্য শত্রু বানিয়ে মুসলিম ভোট টানতে।
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিম ভোটের অনুপাত প্রায় ৭০-৩০ ভাগ, সংখ্যার হিসেবে ভারতের ২য় সর্বাধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস এই রাজ্যের যে কোনো নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম ভোটব্যাংক সবসময় রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ নজরে থাকে। গত কয়েক নির্বাচনে এককভাবে তৃনমূলের দিকে গেলেও এবার পরিস্থিতি বলছে সেই ভোটে ভাগ বসাবে অন্যরাও। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় আসাদুদ্দিন ওয়াইসির কথা। ভারতের এই মুসলিম নেতা হায়দ্রাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের দাবি-দাওয়া আদায়ে ছুটছেন বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত বিহারের সাফল্যে বাংলাতেও তারা প্রার্থী দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে নতুন এই দল মূলধারার বাঙালি মুসলমানদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও উর্দুভাষী মুসলিম প্রধান অঞ্চলে জনপ্রিয়তা এবং ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর সাথে জোটের সম্ভাবনা তাদের ভালো অবস্থানে রাখতে পারে।
সেইসব ছাপিয়ে তৃনমূলের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর জোটের খবর। সিপিএম এর পলিটব্যুরোর সদস্য মুহাম্মদ সেলিমের মধ্যস্থতায় বামদের সঙ্গে ভাইজানের আইএসএফ এর সমঝোতা হয়ে গেলেও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে কিছুটা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ-মালদহে আসন দাবি করছেন আব্বাস, যেখানে গতবার জিতে এসেছিল কংগ্রেস। এই সমস্যা এখন অবধি ঝুলে আছে সেটা টের পাওয়া গেল কলকাতায়, ২৮ ফেব্রুয়ারি যৌথ ব্রিগেডে রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্যের পরে। তবে শেষমেশ বাম-কংগ্রেস-আব্বাসের এই তৃতীয় শক্তি কতটুকু চমক দেখাতে পারবে, না আখেরে বিজেপির জন্য শাপে বর হবে তাও ভাববার অবকাশ রাখে।
তৃতীয় পক্ষের আলোচনা ছাপিয়ে এবারের নির্বাচন তাই স্রেফ নির্বাচন নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু, ফলে অনেক আগে থেকেই শুরু তাদের মমতা হটানোর পরিকল্পনা। তার অংশই বলা যায় দল বদলকে, যা কিনা ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে এক প্রকার মিশেই গেছে। এক সময় কংগ্রেস বামফ্রন্ট ভেঙে দল ভারী করেছিলেন মমতা, ঠিক এই সময়ে বিজেপি এটাকে তাদের কৌশলে রূপান্তর করেছে। উপরের স্তর থেকে নিচের স্তর, তৃনমূলের অনেক নেতা-কর্মীই দল বেধে ভিড়ছেন গেরুয়া শিবিরে। শুরুটা অবশ্য অনেক আগেই-২০১৭ সালে তৃনমূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুকুল রায়কে দিয়ে, আর সেই পথ একে একে অনুসরণ করেছেন শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও। শুভেন্দুকে রুখতে মমতা নিজেই নন্দীগ্রামে তার বিরুদ্ধে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারলেও তৃনমূল অভাববোধ করবে একজন মুকুল রায়ের। একেবারে শুরু থেকেই নিজে গড়ে তুলেছেন এই সংগঠনটিকে। তার বিদায়ের জন্য অনেকে পরিবারতন্ত্রকেও দায়ী করেন।
সে যাইহোক, মুসলিম ভোটব্যাংকে বিভাজন থেকে দল ভাঙন, বিজেপি বাদ দেয়নি টালিগঞ্জকেও। তারকাদের প্রায়ই একসময় ছিলেন মমতার সমর্থনে, এবার সেখানেও ভাগ বসিয়েছে বিজেপি। রুদ্রনীল ঘোষ যিনি কিনা একসময় তৃনমূল ঘেঁষা ছিলেন এখন যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে।
তৃনমূলের এত অস্বস্তিকর পরিস্থিতির পরও স্বস্তির খবর হচ্ছে গত নির্বাচনগুলোর ফলাফল। ২০১৬ সালে ২৯৪ আসনে তৃনমূল পায় ২১১, কংগ্রেস ৪৪, বামফ্রন্ট ৩২ অন্যদিকে বিজেপি মাত্র ৩টি। তবে বিজেপির জন্য অনুপ্রেরণা হলো ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য। সেখানে তারা ৪২-এ ১৮ সিট জয় পেয়েছে, যা আগের বার ছিল ২টি। তবে এই নির্বাচন সামনে রেখে এবিপি আনন্দ-সি ভোটার পরিচালিত জনমত সমীক্ষা বলছে, ক্ষমতায় আসতে প্রয়োজনীয় ১৪৮ আসনের অধিকই পেয়ে যাবেন মমতা, বিজেপি ১০০ এর কাছাকাছি থাকবে। সবকিছু ছাপিয়ে হিন্দুত্ববাদ আর দল ভাঙিয়ে বিজেপি ভালো অবস্থানে চলে আসলেও তাদের এখনও রাজ্যে অভাব আছে একজন ফ্রন্ট ম্যানের, যাকে সামনে রেখে তারা লড়বে সেদিক থেকে দিদির জনপ্রিয়তা এখনও গগনচুম্বী।
বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনা করলে এই নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে এর আগেও কেন্দ্রের সায় থাকার পরও মমতার বিরোধিতায় সব ভেস্তে যায়, সে হিসেবে কেন্দ্র ও রাজ্যে একই সরকার থাকলে দরকষাকষিতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে আশা করা যায়। আবার বিজেপি ক্ষমতায় আসলে এনআরসি সিএএ এর মতো বিষয়গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে নিশ্চিত। অনেকে যদিও একে স্রেফ পলিটিকাল রেটরিক বলে উড়িয়ে দেন, তথাপি সীমান্ত দিয়ে মানুষের ঢল না নামলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বিনষ্ট করবে নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত কী হবে তা সামনের নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করে দেবে বলা যায়।
লেখক ; শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়