Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অফলাইনে অনলাইন অস্থিরতা


৫ মার্চ ২০২১ ১৪:২৯

ঘটছে কী? আর প্রচার-প্রকাশ হচ্ছে কী? মূলধারার সংবাদপত্রে এক তথ্য। টিভি- রেডিওতে আরেক। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্য আরও তথ্যের ছড়াছড়ি। কারোটাই ফেলনা নয়। বাজার আছে সবারই। সাম্প্রতিক সব ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়েই গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের এক অসুস্থ লড়াই। যার যার ইচ্ছামতো তথ্য ছড়ানো-রটানোর প্রতিযোগিতা। কেবল দলীয়-সামাজিক-ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রীয় বিষয়ও বাদ যাচ্ছে না। মুখরোচক করে সাদাকে কালো, কালোকে সাদা বানিয়ে ফেলার ক্যারিশমা। মানুষ আক্রান্ত-বিভ্রান্ত। সবই দেখছে-শুনছে। সিদ্ধান্তে আসতে কষ্ট হচ্ছে। তবে একেবারেই কিছু বুঝছে না—এমনও নয়। গতিময় এই দৌড়ে পাঠক-দর্শক-শ্রোতারা শরীক হয়ে পড়ছে নিজেও।

জাতীয় প্রেসক্লাবে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘর্ষ বা কাশিমপুর কারাগারে বন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কী-না করছে? কী তথ্য না দিচ্ছে? জেলে তাকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে এমন কোনো দাবি বা অভিযোগ পরিবারও করেনি। কিন্তু ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যমগুলো তা প্রমাণের তেমন বাকি রাখেনি। আর প্রেসক্লাবের ঘটনাকে কেউ কেউ পুলিশের সমাবেশে ছাত্রদলের হামলার ঘটনায় নিয়ে গেছে। মাধ্যম হিসেবে এটা অবশ্যই তাদের সাফল্য। এর আগে কুমিল্লায় তনু, ঢাকায় বিশ্বজিত-অভিজিত, সিলেটে খাদিজা, বরগুনায় নয়ন বন্ডসহ নানা ঘটনা তারাই আগে জানিয়েছে। গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার তথ্যও প্রচার হয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। পরে মূলধারার গণমাধ্যম কথিত এসব ফেসবুক সাংবাদিকতার তথ্য-ফুটেজ হাওলাত করেছে। মানুষের চাহিদার যোগান প্রশ্নে উত্তীর্ণ হওয়ায় ফেসবুক সাংবাদিকতা রোখার আপাতত পথ নেই। প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের বিপরীতে ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীদের বড় সুবিধা এখানে হকার বিল-ডিস বিলের মতো অর্থবিনিয়োগ নেই।

সিটিজেন জার্নালিজম, অনলাইন জার্নালিজম, মাল্টিমিডিয়া প্লাটফর্ম ইত্যাদি নামে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোথাও বাধায় পড়ছে না তারা। কিছুদিন আগেও অনলাইন জার্নালিজম বলতে মনে করা হতো নিউজ পোর্টালগুলোকে। এখন সব একাকার। তার ওপর ইউটিউব এক্সক্লুসিভ ক্লিপ এমন কি ডেইলি ইভেন্টও দিচ্ছে। মানুষ এখন তথ্য জেনেই তৃপ্ত নয়। তথ্য দিতেও চায়। তথ্য দেওয়া-নেওয়ার এ দৌড়ে তাদের কাছে সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক কদর-সমাদর। যা মূলধারার গণমাধ্যমের নাকানিচুবানি নিশ্চিত করছে। মূলধারার গণমাধ্যমকে একটা আপদে ফেলেছে সামাজিক মাধ্যম। আপদটা বিপদের দিকে ছুটছে। কেউ কেউ সব দোষ ফেসবুক সাংবাদিকতার ওপর চাপিয়ে খালাস পেতে চান। কিন্তু মূলে যাচ্ছেন না। উৎরানোর পথ খুঁজছেন না।

প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার কখনও ছিল না—এমন সুসময় দুনিয়াতে কখনোই আসেনি। একেক সময় সেটা একেক ফরমেটে হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবকিছুকে প্রোপাগান্ডা-অপপ্রচার বলে পার পাওয়ার অবস্থা নেই। এটা যোগাযোগ মাধ্যমের একটা ভিন্ন মাত্রা। কোনো নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃপক্ষীয় দায় না থাকায় অবাধ স্বাধীনতায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কোথাও তাদের জবাবদিহি নেই। গণমাধ্যম সেখানে বড় অসহায়। তার দায় আছে। দায়িত্ব আছে। রাষ্ট্রের এবং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করতে হয়। এতো ঘাম ঝরানোর পর হেনস্তাও হয়। তা আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতেও। সাংবাদিকতার এই বৈশ্বিক তোড়ের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপদ্রব। এর জেরে মানুষ এখন কেবল পাঠক থাকতে চায় না। দর্শক-শ্রোতার মধ্যেও সীমিত থাকতে চায় না। তারা নিজেরাও নিউজম্যান হতে চায়। সম্পৃক্ত হতে চায় সংবাদের সঙ্গে। খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও রেডিওর সীমানা ছাড়িয়ে ঝুঁকছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাও নগদে-লাইভে। তাৎক্ষণিক ফিডব্যাক নেয়-দেয়। অভিমত দেওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকেও মিডিয়া পারসোনালিটি ভাবতে পারছে মানুষ। ফিলিংসটাই অন্য রকম।

পরিস্থিতির অনিবার্যতায় পৃথিবীর অনেক দেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে আরও আগেই। বাংলাদেশ নিয়েছে দেরীতে। সমস্যাটা হয়েছে অন্যখানে। গণমাধ্যমের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমকে প্যাঁচিয়ে সাংবাদিকতাকে জট বাধিয়ে দেয়ায়। সাংবাদিকতা-অসাংবাদিকতাকে গুলিয়ে একটা জট পাকানো হয়েছে। সেটা প্রচার-প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হরণ নামে। যদিও সাংবাদিকতা আদতে মোটেই স্বাধীন পেশা নয়। কখনোই তা স্বাধীন ছিলও না। বরং পরাধীনতা ও নানা বিধিব্যবস্থার মধ্যেই দেশে-দেশে সাংবাদকিতার সূচনা ও বিস্তার। বাংলাদেশেও গণমাধ্যম নিয়ে অন্তত ৩০টির মতো আইন রয়েছে। বিধিবিধান যোগ করলে সংখ্যাটি পঞ্চাশের ঘরে। এর প্রায় সবগুলোই নিয়ন্ত্রণমূলক। তা সেই হাতে লেখা সংবাদপত্র থেকে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ঝকঝকে মুদ্রিত চাররঙা পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন মিলিয়ে সবখানেই। কখনোই ক্ষমতাসীনরা সমালোচনা সইতে অভ্যস্ত নয়। কী স্বৈরাচারী, গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত-অনির্বাচিত সবাই। মাত্রায় কম-বেশি মাত্র। তথ্যে ভীষণ ভয় তাদের। কেবল সাংবাদিকতা নয়, গল্প-কবিতা, ছড়ায় কিছু বিপক্ষ মনে হলেও। এটা যতো না দোষের তার চেয়ে বেশি বৈশিষ্ট্যগত। সরল বিবেচনায় প্রশ্ন করা যায়, সমালোচনা করলে কি সরকার পড়ে যায়? না পড়ে না। কিন্তু সরকারগুলো পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভোগে। সমালোচনাকেও রাষ্ট্রদ্রোহিতা ভাবে। সরকারবিরোধী আর রাষ্ট্রবিরোধী একাকার করে ফেলে। আধুনিকতার সুবাদে মানুষের এখন আর তথ্যের জন্য সংবাদপত্র বা টিভি-রেডিওর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। হাতে হাতেই সংবাদ ও তথ্যের ডিপো। লাখ-লাখ একাউন্ট ফেসবুকে। যার যা ইচ্ছা লিখছে। সত্য-মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। তাতে কী হয় বা হবে সরকারের? এখন পর্যন্ত সেই ধরনের কোনো শঙ্কাও নেই। আবার সরকারের পক্ষে প্রচারও কম নয়। এতেও সরকার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যাচ্ছে না। এর বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কোনো যন্ত্র বা ব্যবস্থাই নেই সরকারের হাতে। আর এটাই বাস্তবতা।

গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে ভিন্ন বিষয় সেই বুঝবোধ আসতেও সময় লেগেছে। বছর কয়েক আগেও সংবাদমাধ্যম বলতে মনে করা হতো সংবাদপত্রকে। আর মানুষ বা ক্রেতার নাম পাঠক। পরে টিভি-রেডিও যোগ হওয়ায় তাদের আরেক পরিচয় দাঁড়ায় দর্শক-শ্রোতা। এখন সব পরিচয়কে একসঙ্গে করে বলা হয় অডিয়েন্স। এর বাংলা যুতসই শব্দ-প্রতিশব্দ এখনো আবিষ্কার হয়নি। আবার কার্যকারিতায় রকমফের কম। ফেসবুকের মতো মাধ্যম দ্রুত কাউকে হিরো করে ছাড়ছে। আবার তাকে জিরোও করে দিচ্ছে। তফাৎ কেবল সময়ের। এই অসাংবাদিকতা নিয়ে একদিকে যারপরনাই নিন্দা-সমালোচনা। আরেকদিকে গ্রহণযোগ্যতা-জনপ্রিয়তা। তাদের খবরাখবরগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাইবাছাই করা কি-না, সম্পাদিত কি-না- এসব ভাবার সময় নেই মানুষের। আবার রাজনৈতিক মহলেরও এতে যার যার মতো ভূমিকা। যে যখন লাভবান তার কাছে তখন ফেসবুক ভীষণ ভালো। এর সংবাদও সত্য। আর ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিকৃষ্ট-জঘন্য। যাচ্ছেতাই মন্দ। তা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে শক্ত অবস্থান। রীতিমতো সার্কাস।

এখন যার হাতেই একটা স্মার্টফোন আছে, সে তার মতামত প্রকাশ করছে। তার মতামত একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। নাগরিক পর্যায়ে তথ্য আদান–প্রদান ও মতপ্রকাশের এমন স্বাধীনতা ও তার এত ব্যাপকতা যোগাযোগের ইতিহাসে কখনোই ছিল না। ডিজিটাইজেশনের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা এখন বেশি করে ঝুঁকছে ডিজিটাল প্রকাশ মাধ্যমের দিকে। সারা বিশ্বেই এটা ঘটছে। এতে মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের বিজনেস মডেল সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশে অবস্থা আরও করুণ। করোনার পিক আওয়ারে বন্ধ হওয়া পত্রিকাগুলোর বেশিরভাগ এখনও চালু হয়নি। অনলাইন ভার্সন দিয়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। টেলিভিশনগুলোও অনলাইন ইউনিট খুলছে। অবধারিতভাবে এখন সাংবাদিকতার ধরনেও পবির্তন আসছে। পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও যে কোনো মাধ্যমের রিপোর্টারকে কেবল তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী হলেই চলছে না। কারিগরি দক্ষতাসহ আরও অনেক কিছু জানতে হচ্ছে। ঢাউস সাইজের ক্যামেরা-ট্রাইপডসহ অনেক সরঞ্জাম নিয়ে এখন নিউজ কাভারেজে যেতে হয় না টিভি রিপোর্টারদের। পত্রিকা সাংবাদিকদেরও সন্ধ্যায় নিউজ পাঠানো বা সশরীরে অফিসে যাওয়ার চিন্তায় দিনভর অপেক্ষার সুযোগ নেই। প্রযুক্তি তথা অনলাইন সাংবাদিকতা তাদেরকে এ অবস্থায় আসতে বাধ্য করেছে। মূলধারার সাংবাদিক বলে তারা উৎরচ্ছেন। অবশ্যই আরও উৎরবেন। নইলে কথিত এবং অপেশাদার মোবাইল সাংবাদিকতা তাদেরকে আরও নিপাতনে সিদ্ধ করবে। করতেই থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর