৭ মার্চের ভাষণ তারুণ্যের উজ্জীবনী শক্তি
৭ মার্চ ২০২১ ১২:৫০
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় দিন ৭ মার্চ। যেদিন রচিত হয়েছিল ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা, অধিকার আদায়ের প্রস্তুতি বার্তা। আমরা যারা স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করেছি। আমরা বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম এই ভাষণটি সরাসরি দেখতে পারিনি, শুনতে পারিনি, রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম না, কিন্তু আজও যখন এই ভাষণ আমাদের কানে ভাসে, আমরা উজ্জীবিত হই। নব উদ্যমে এগিয়ে চলার প্রেরণা পাই।
একজন নেতা কিভাবে একটি জাতিকে, একটি দেশকে একত্রিত করতে পারেন, একই ছাতার নিচে, একই দাবিতে সোচ্চার করতে পারেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দ্বিতীয় নজির নেই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত হতাশা, শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল, অন্যায়, অবিচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষকে যেভাবে আন্দোলিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা নেই। আর সেজন্যই এই ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অনুরণিত করে, প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে, এগিয়ে যাবার শক্তি যোগায়।
ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখ লাখ মানুষের সামনে যখন বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”, এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ঐক্যের মূলমন্ত্র, স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন—তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।
এই ভাষণটি তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে সিদ্ধান্তে অটল থাকার এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শহিদের রক্তের ওপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।…আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।” এই তেজোদৃপ্ত কণ্ঠ নিরস্ত্র বাঙালিকে, তরুণদের সশস্ত্র করেছেন কণ্ঠের জাদু দিয়ে, কীভাবে শত বাধা উপেক্ষা করে মনোবল ধরে থাকতে হয়, তা শিখিয়েছেন প্রজন্মকে।
৭ মার্চের ভাষণ বর্তমান প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখায়, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদী হতে হয়, কিভাবে মাথানত না করে অবিচল থাকতে হয়, কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়। এই ভাষণটি যতবার শোনা হয়, ততবারই নতুন ভাবনা তৈরি হয়, প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি বাক্য এক একটি স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে, নতুন বার্তা দেয়। ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই কালজয়ী ভাষণ, যার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারছে, কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে একটি ভাষণের মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিভাবে শান্ত রেখেছিলেন কোটি মানুষকে, আবার সংগ্রামের প্রস্তুতির বার্তাও দিয়েছেন। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ না দিয়ে, উস্কানি না দিয়ে কিভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। সেই শিক্ষা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কিভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়, ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব”। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক মহাকাব্যিক রচনা এই ঐতিহাসিক ভাষণ।
এই ভাষণের গল্প শুনেছি প্রথম বাবা মায়ের কাছ থেকে, তারপর স্কুলে পড়ার সময় ক্যাসেটে, যতবারই শুনি, কোনো বিরক্তি লাগে না। বরং এই ভাষণটি উজ্জীবিত করে, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আর এই জন্যই এই ভাষণটি আলাদা, একদমই আলাদা। আমাদের এগিয়ে নেওয়ার, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
সফিউল আযম: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষক