Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাপানের কাছে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়


১৩ মার্চ ২০২১ ১৭:৫৫

জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগী সংস্থা জাইকার পরিচিতি
জাপানে প্রতিষ্ঠিত জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সি) নামক আন্তর্জাতিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করে যাচ্ছে। এই সংস্থাটির একটি নিজস্ব নীতি ও ধারা রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশের তুলনায় ভিন্ন। আবার সম্প্রতি চীনের প্রতিষ্ঠিত নির্মাণ ও ঋণ কৌশলভিত্তিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকেও ভিন্নতর। জাইকা কার্যক্রম শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে জাপানের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। সারাদেশের ভৌত অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের অর্থনীতিও সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তি জাপান দখল করে। মিত্রশক্তি জাপানের সমাজ, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও রাজনীতির উপর চেপে বসে। শুরু হয় পরাধীন জাপানের ইতিহাস। কিন্তু জাপানের ভিতরে এমন শক্তি লুকিয়ে রয়েছে যে, মিত্রশক্তি চেষ্টা করেও এটিকে উপনিবেশে পরিণত করতে পারেনি। পরাধীন অবস্থায়ই এক দশক অতিক্রম করতে না করতেই পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে জাপান এশিয়ার শীর্ষ দেশে পরিণত হয়। জাপানের অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। এই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি জাপানিরা এখন অন্য দেশে প্রবাহিত করতে সচেষ্ট। তাদের এই চেষ্টার ফসল হলো জাইকা। জাইকা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল জাপানের প্রতিবেশী অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা। এই সংস্থা সর্বপ্রথম ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী তাদের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করে চলেছে।

উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাইকার প্রয়াস
জাইকা বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বৃহৎ-বি উদ্যোগ (বিগ-বি ইনিশিয়েটিভ)-এর অংশ হিসেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ নানা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরাসরি সহায়তা করছে।

সম্প্রতি জাইকা তার আর্থসামাজিক সহায়তা ঋণ গ্রহীতা দেশের গবেষকদের সঙ্গে জাপানের আর্থসামাজিক কৌশল সম্পর্কে আলোচনার জন্য জাইকা চেয়ার সেমিনার (জাইকা চেয়ার সেমিনার) প্রতিষ্ঠা করে। এই সেমিনারের উদ্দীপক ধারণা হিসেবে জাপানের আধুনিকায়নে সাত অধ্যায় (সেভেন চ্যাপ্টারস অব জাপানিজ মডার্নাইজেশন) নামক ভিডিও প্রকাশ করেছে। সাতটি অধ্যায় হলো নিম্নরূপ:

•অধ্যায় ১: মেইজি বিপ্লব: পূর্ণোদ্যমে আধুনিকায়নের শুরু
•অধ্যায় ২: জাপানে দলীয় রাজনীতির উত্থান এবং পতন
•অধ্যায় ৩: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপান
•অধ্যায় ৪: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাপানি ব্যবস্থাপনা
•অধ্যায় ৫: জাপানের আধুনিকায়কালে শিক্ষার বিকাশ
•অধ্যায় ৬: ‘এশিয়া ও জাপান’ থেকে ‘এশিয়াতে জাপানে’ ধারণাগত বিবর্তন
•অধ্যায় ৭: আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জাপানিদের নিজস্ব পন্থা

এই ভিডিওর শিরোনাম থেকে অনুমানযোগ্য যে, এটি জাপানের আধুনিকায়ন সম্পর্কিত সন্দর্ভ। তবে এই ভিডিওটিতে মূলত জাপানের শিল্পায়ন ও তার পেছনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চালিকা শক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। এই ভিডিও’র সাত অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ও পঞ্চম অধ্যায় যথাক্রমে জাইকার সভাপতি ও সহ-সভাপতি কর্তৃক রচিত ও বিবৃত হয়েছে। কাজেই এই ভিডিওতে মূলত জাপানের উন্নয়ন সম্পর্কিত জাইকার নিজস্ব চিন্তা-ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছে। জাইকার সভাপতি শিনইচি কিতাওকা কর্তৃক বিবৃত এই সন্দর্ভের মুখবন্ধে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে জাপান এসব দেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপানের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল্যায়ন ও বাংলাদেশের পক্ষে জাপানের সেই উন্নয়ন অভিজ্ঞতার উপযোগিতা সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হবে। এই ভিডিওতে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত মেইজি বিপ্লবকে জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রারম্ভকাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আরও বিবৃত করা হয় যে, একটি রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে মেইজি সম্রাট ক্ষমতা নিলে গণতন্ত্র ফিরে আসে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়। তাছাড়া গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে দেশব্যাপী সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। শান্তি-স্থিতিশীলতার মধ্যে জাপান পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে প্রযুক্তি আহরণ করে, নিজেদের দেশের ভৌত-অবকাঠামো ও শিল্পায়ন শুরু করে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাপানের রয়েছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার শক্তি এসেছে জাপানের সহযোগিতামূলক সামাজিক শক্তি থেকে। এই ব্যবস্থাপনা হলো শতশত বছর ধরে প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর ভিত্তির ওপর স্থাপিত ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনাতে মালিক-শ্রমিকের মানবিক সম্পর্ক অটুট থাকে। আর শ্রমিকরাও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিকানা লাভ করে। জাপানের এই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদনের মান ও পরিমাণে নিয়ন্ত্রণের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।

জাপানে সংঘটিত মেইজি বিপ্লব ও আধুনিকায়নের সূত্রপাত
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে এমন কিছু বিষয় এই সংক্ষেপিত ভিডিওতে তুলে ধরা হয়নি, যা এখানে বিবৃত করা হলো। মেইজি বিপ্লবের আগে জাপানে ছিল তকুগাওয়া শাসনামল (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাচীনকালে সব রাজনৈতিক শক্তিই গঠিত ও পুনর্গঠিত হয়েছে কোনো না কোনো ধর্মকে কেন্দ্র করে। তেমনিভাবে তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে। তকুগাওয়া শাসনামল প্রতিষ্ঠাকালে তার প্রতিপক্ষ ছিল ওদা নবুনাগার নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক শক্তি। ওদা নবুনাগার রাজনৈতিক ধর্ম ছিল ইউরোপীয়দের আনিত খৃষ্টধর্ম। বলা যায়, তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তি গঠিত ও বিকশিত হয়েছিল খৃষ্টধর্মের ভিতকে সমূলে উৎপাটনের মাধ্যমে এবং বৌদ্ধ ধর্মকে নিয়ামক ধরে। তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তি এদো (বর্তমান টোকিও) শহরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বলয় বিস্তৃত করেছিল। তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে, খ্রিস্ট ধর্মের প্রবেশ ও বিস্তৃতি রোধে কোরিয়া ও চীন ছাড়া বিদেশের সঙ্গে সবধরনের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর মাধ্যমে জাপান আড়াই শতাব্দীব্যাপী বদ্ধনীতি শুরু করে। এই দীর্ঘ আড়াই শতাব্দীকাল জাপান ইউরোপীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আহরণে একটি মাত্র ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। সেটি হলো- নেদারল্যান্ড। নেদারল্যান্ডের সহায়তায় জাপান ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে থাকে। তখন তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট হয়। এই শক্তি দেশব্যাপী বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বিচ্ছিন্ন নৃগোষ্ঠীগুলোকে বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে এক বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আত্তীকরণে সচেষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়ায় জাপানের অগ্রগতি চলতে থাকে। কিন্তু নেদারল্যান্ড এবং জাপানের জলপথ অতিক্রমকারী অন্যান্য বিদেশিদের কাছ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে সংগঠিত গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক বিপ্লব সম্পর্কে অভিহিত হতে থাকে। সে সময় জাপানে ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষের মতো নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে থাকে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উদ্ভূত সামাজিক অস্থিরতা জাপানের সামাজিক ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। সে সুযোগে প্রথাগত খেতাব সর্বস্ব সম্রাট মেইজির নেতৃত্বে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশগুলোর সামন্ত রাজারা রাজনৈতিক-সামরিক বিপ্লবের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। শুরু হয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও খণ্ডযুদ্ধ। এই দ্বন্দ্বে মেইজি সম্রাটের নেতৃত্বে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি বিপ্লবী আদর্শে বলীয়ান হয়ে, রাজধানী শহর এদোতে অবস্থিত তকুগাওয়া রাজনৈতিক শক্তিকে উৎখাত করে। এর মধ্য দিয়ে মেইজি সম্রাটকে ক্ষমতায় বসায়।

এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তকুগাওয়া সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এই পট পরিবর্তনকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুগপৎভাবে সামাজিক ও ধমীয় পরিবর্তনও সংঘটিত হতে থাকে। ফলে সামন্ততন্ত্র ভেঙ্গে এর ভিত্তির উপর আধা-আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া বংশগত সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তে মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সামাজিক স্তরবিন্যাস সৃষ্টি হয়। বংশগত সামুরাই কেন্দ্রিক অভিজাত প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। সামুরাই বাহুল্য সশস্ত্রবাহিনী বিলুপ্ত করা হয়। বৌদ্ধ প্যাগোডাসহ বৌদ্ধ ধর্মের সমস্ত ভৌত ও কোমল অবকাঠামো গুড়িয়ে দেওয়া হয়। হাজার হাজার বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিগ্রহের শিকার হতে থাকে। এ সমস্ত ধ্বংসস্তূপের উপর শিনতো ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করে এই ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে রাজতন্ত্র গঠনের প্রয়াস নেওয়া হয়। দক্ষতা ও মেধাভিত্তিক আমলাতান্ত্রিক ধারার নতুন সাম্রাজ্যবাদী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। মেইজি সম্রাট এ সময় আড়াই শতাব্দীব্যাপী অব্যাহত থাকা বদ্ধনীতি বাতিল করে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়।

জাপানের আর্থসামাজিক শক্তি ঐতিহাসিক বিকাশ
মেইজি বিপ্লবের ফলে জাপান নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্তরবিন্যাসে বিন্যস্ত হয় এবং আপাত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। জাপানের সমাজে রাজনৈতিক সংহতি বৃদ্ধি পায় এবং এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় মেইজি সরকার ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আহরণে উদ্যোগী হয়। তখন জাপান দেশব্যাপী বোধগম্য একটি প্রমিত ভাষা সৃষ্টির কাজে মনযোগী হয় এবং এই ভাষাকে ব্যবহার করে মেইজি রাজতন্ত্র একটি সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করে। পরে তারা ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে প্রযুক্তি সংগ্রহ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানান ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় এবং এর ভিত্তিতে ক্ষুদ্র কল-কারখানা গড়ে ওঠে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের ফলে জাপান ফুকোকু কিয়োহেই (ঐশ্বর্যময় দেশ, শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী) নীতির আওতায় যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরিতে মনোযোগ দেয়। মেইজি বিপ্লবের তিন দশকের মধ্যে জাপান বড় ধরনের যুদ্ধ সক্ষমতা অর্জন করে এবং বিশ্বের সে সময়কার পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এই ধারাবাহিকতায় জাপান ১৮৯৫, ১৯১০ ও ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীনে উপনিবেশ স্থাপনে সফল হয়। এই সফলতায় জাপানের মনোবল বেড়ে যায় এবং অধিকতর যুদ্ধ সক্ষমতা অর্জনে মনযোগী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত পার্ল হারবার আক্রমণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধাভিযান শুরু করে। সে সময় সমস্ত এশিয়া মহাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো না কোনো ইউরোপীয় শক্তির করায়ত্ত ছিল। জাপান সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইউরোপীয় দেশগুলার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে জাপানের ছিল জয় জয়কার। জাপানের যুদ্ধ জয়ের এই ধারা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির কাছে জার্মানি পরাজিত ও আত্মসমর্পণ করলে মিত্রশক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া জাপানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধাভিযানে মনযোগী হয়। সে সময় হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। যা জাপানের সমরবিদদের ভাবিয়ে তুলে। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একের পর এক হার ও রাশিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতির খবরে জাপানের মনোবল ভেঙে যায় এবং জাপান মিত্রশক্তির কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের ফলে জাপানের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নস্বাদ মিটে যায়। কিন্তু এই ব্যাপক যুদ্ধ সক্ষমতার মাধ্যমে জাপান তার প্রযুক্তিগত ও সামাজিক সম্পদের উৎকর্ষতা সম্পর্কে দুনিয়াকে জানান দেয়।

জাপান মেইজি বিপ্লবের পর থেকে আপাত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অফুরন্ত সামাজিক সম্পদ অর্জন করে, যা সামাজিক সম্পদ হিসেবে সমাজে নিহিত থাকে। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর, এই অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাপান পণ্য ও সেবা উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। তখন গুণ ও মানের কারণে বিশ্বজুড়ে জাপানি পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়। ফলে জাপানের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, যে কারণে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির এক দশকের মধ্যেই জাপান শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। তারপর থেকে জাপানের অগ্রগতি আর থেমে না থেকে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উক্ত আলোচনায় মেইজি বিপ্লবোত্তর কাল থেকে কালক্রমে সংঘটিত জাপানের রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। উক্ত আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আড়াই শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান বদ্ধ জাপান মেইজি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদী জাপানে পরিণত হয়। জাপানের এই সাম্রাজ্যবাদী জাপান হয়ে উঠার পিছনে অনেকগুলো সামাজিক শক্তি কাজ করেছে। এই সামাজিক শক্তিগুলো জাপান সমাজের ভিতর থেকে নানা রাজনৈতিক, সামরিক, জ্ঞানীয় সামাজিক ও ধর্মীয় বিবর্তনের মাধ্যমে লাভ করেছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও এই সামাজিক শক্তিগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তি হিসেবে জাপানের সমাজে মিশে আছে। কাজেই কোনো দেশ ও সমাজের শিল্প উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।

বাঙলার সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তন
[এখানে, বাঙলা=বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের কিয়দংশ] উন্নয়ন একটি ব্যাপক ধারণা। কিন্তু জাইকা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বুঝিয়ে থাকে; আবার অনেকে শুধুমাত্র ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে বুঝে থাকেন। জাইকা মূলত ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু জাপান কোনো দেশ বা সমাজকে নিজ থেকে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে সহায়তা করে না। যদিও জাপানের সমাজের ভেতরে নিজেদের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের অফুরন্ত শক্তি নিহিত রয়েছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের সমাজের ভিতরে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের তেমন কোনো শক্তি নেই। এই শক্তিহীনতা বাংলাদেশের অন্য দেশের উপর পরনির্ভরশীলতা এনে দিয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশকে অন্য দেশের পরিকল্পনা ও প্রাযুক্তিক সহয়তা নিয়ে ভৌত অবকাঠামো গড়তে হচ্ছে। অর্থাৎ, অর্থ-সম্পদ হলো দেশের, কিন্তু পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি হচ্ছে বিদেশের—এই নীতিতে বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোগুলো গড়ে উঠছে। এই অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অর্থে জাপানের সহায়তার নির্মিত ভৌত কাঠামো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যদিও প্রকৃত উন্নয়ন হলো একটি সমাজের সার্বিক উন্নয়ন। এই সার্বিক উন্নয়ন বলতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়ন। অর্থনীতির ভাষায় এই উন্নয়নকে আর্থসামাজিক উন্নয়ন বলে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু সার্বিকভাবে উন্নয়ন হলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক  উন্নয়ন।

ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভকাল থেকে জাপানে সংঘটিত রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারায় প্রতিবারই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারায় বিদেশি রাজনৈতিক আধিপত্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ধারা শুধু ব্যাহতই হয়েছে। অবশেষে অনেক কিছু হারিয়ে পূর্বতন বাঙলার অংশ বিশেষ বাংলাদেশ হিসেবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভে করে।

বাঙলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে ৮ম শতাব্দীতে পাল শাসকগণ প্রথম পর্যায়ে বৌদ্ধ ধর্মকে ও পরবর্তী পর্যায়ে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করে জঙ্গলাকীর্ণ ও জলাকীর্ণ অঞ্চলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নৃগোষ্ঠীসমূহকে একটি বৃহৎ সমাজব্যবস্থায় আনয়নের প্রয়াস নেয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় নৃগোষ্ঠীসমূহের আর্যায়ন শুরু হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকাকালে বাঙলা তুর্কী-আফগান মুসলমান শাসনাধীনে নিপতিত হয়। সে সময় আর্যায়ন ব্যাহত হয়। কিন্তু ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে বাঙলা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন দেশে ছিল রাজতন্ত্র ও বাঙলার নাম ছিল বাঙলা সালতানাত। রাজধানী ছিল গৌড়ে। বাঙলা সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হলে ভক্তিবাদী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়। আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি আয়োজনের মাধ্যমে সূফী ইসলাম ধর্ম ও বৈষ্ণব হিন্দু প্রচার ও প্রসারের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে একটি বৃহত্তর সমাজে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল আগ্রাসনে বাঙলা সালতানাত বিলুপ্ত হয়। বাঙলার রাজনৈতিক শক্তি কেন্দ্র গৌড় থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। মোগল অধিকারে বাঙলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক ভীত নড়বড়ে হয়ে যায়। দু’শত বছর ধরে মোগল শাসন চলাকালে বাঙলার তেমন কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়ন ঘটেনি। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্য তার কেন্দ্রে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। মোগল শাসনামলের শেষদিকে মোগলদের পক্ষে বাঙলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল নিজামত প্রাপ্ত নওয়াবগণ। সে সময় পর্তুগিজ, দিনেমার, ফরাসি ও ইংরেজ ইত্যাদি শক্তি বাঙলায় হানা দিতে থাকে। অন্যদিকে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত যথাক্রমে মারাঠা ক্ষাত্রশক্তি ও মগ-পর্তুগিজ মিলিত সমর শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়। মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে কোনো সামরিক সাহায্য নেই, আবার বাঙলার তখনকার স্থানীয় রাজধানী মুর্শিদাবাদেও তেমন কোনো সামরিক শক্তি গড়ে উঠেনি। এই সুযোগে ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তি বাঙলার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে।

বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শক্তির থাবা ও অর্থনীতির চালিকা শক্তির বিপরীত ঘূর্ণন
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বেনিয়া শক্তি বাঙলা দখলের পর, এ দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক অবকাঠামো ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। তারা এ দেশকে শাসন ও শোষণ করতে ইউরোপীয় ধারায় সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলশ্রুতিতে দেশে একটি পোষ্য সামন্ত প্রথার তল্পিবাহক অভিজাত গোষ্ঠী সৃজনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই অভিজাত গোষ্ঠীর কাজ ছিল দেশের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করে, সেই শোষিত অর্থ ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া। কাজেই দু’শ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ধরে শাসন ও শোষণের ফলে বাঙলার নিজস্ব সামাজিক শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়।
এ সময়ে ব্রিটিশদের পোষ্য সামন্ততন্ত্রের দেশীয় সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে যে অভিজাত গোষ্ঠী গড়ে উঠে, তারা তাদের আবাসস্থল হিসেবে কলকাতা শহরকে বেছে নেয়। ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুললে, কলকাতা কেন্দ্রিক উক্ত অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়। তাই তাদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনাবোধ জন্ম নেয়। কিন্তু যাদের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ জন্ম নেয়, তাদের মধ্যে আবার হিন্দু-মুসলমান বিভেদ বোধটি গড়ে উঠে। কাজেই তখন হিন্দু-মুসলমান বিভেদের কারণে বাঙলা ভাগ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অবশেষে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাঙলা ভাগ হয়।

বাঙলা ভাগের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ অংশটি পূর্ব-পাকিস্তান নামে মুসলমান জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট আবাস ভূমি পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা বাঙলার আলোকিত অংশটি পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হিসেবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এমনিতেই দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনে বাঙলার সামাজিক শক্তিসমূহ ছিল ম্রিয়মাণ, তার উপর বাঙলা ভাগের ফলে পূর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ)-এর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে পড়ে। পূর্ব-পাকিস্তানে তখন ব্রিটিশ শাসক ও শোষক গোষ্ঠীও নেই, আবার ব্রিটিশদের পোষ্য স্থানীয় অভিজাত শ্রেণীর (যারা হিন্দু) সবাই কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়েছে। তখন এক ধরণের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সামাজিক স্তরবিন্যাসেও দেখা যায় বিপর্যয়। এই উপরের স্তরে স্থান করে নিতে ব্রিটিশ ভারত থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাগত আর্য মুসলমানগণ অভিজাত শ্রেণীর অংশ হতে উঠেপড়ে লাগে। সে সময় এ দেশীয় স্থানীয় শিক্ষিত কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণীও সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপরের স্তরে স্থান করে নিতে প্রয়াসী হয়। তখন বাধে নতুন দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বে পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। তখন তারা বাংলা ভাষাকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে ধার্য করে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এই স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের রেল ও সড়ক যোগাযোগসহ সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। শিল্প-কারখানা ও সামাজিক স্থাপনার সবকিছু লুট হয়ে যায়। সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপরে অবস্থান ছিল পাকিস্তানি ও এদেশীয় পাকিস্তানপন্থী অভিজাতদের দখলে। কিন্তু পাকিস্তানের ভাঙনের ফলে এই শ্রেণীটি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা ও উন্নয়ন সহায়ক সামাজিক শক্তি সৃজনে প্রতিবন্ধকতা
জাইকার ভিডিওতে উন্নয়নের জন্য সার্বজনীন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো সার্বজনীন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলা মাধ্যম, কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, ইংরেজি ভার্সন ও ইংলিশ মিডিয়াম ইত্যাদি পাঁচ ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা অথবা সরকার অনুমোদনে প্রবর্তিত  শিক্ষাব্যবস্থা জাতির মধ্যে সংহতি ও ঐক্য সৃষ্টির পরিবর্তে ও ভাঙন সৃষ্টি করছে। আবার দেশব্যাপী বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞান পরীক্ষাগার ও খেলার মাঠ থাকার কথা থাকলেও, অধিকাংশ বিদ্যালয় ও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাগার ও খেলার মাঠ নেই। এই সীমাবদ্ধতার জন্য হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, ফাঁকিজুঁকি দিয়ে পরীক্ষা পাসের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই জ্ঞানীয় ও প্রাযুক্তিক কার্যক্রমে ফাঁকিজুঁকির কারণে, দেশে বিজ্ঞান চর্চার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে না। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের সূচক হিসেবে গবেষণা সন্দর্ভের মান ও সংখ্যাকে বিবেচনায় নেওয়া হলেও, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এ সব সূচককে পাত্তা দেওয়া হয় না। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা হচ্ছে কি-না তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের পূর্বশর্ত হলো গবেষণা। শিক্ষাব্যবস্থায় এ ধরণের বিপর্যয়ের ফলশ্রুতিতে দেশের অবকাঠামো তৈরিতে বিদেশি বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে জাপানে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিক্ষা কার্যক্রমের অঙ্গীভূত, যে কারণে জাপানে সামাজিকীকরণ ও সামাজিক আত্তীকরণ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই এসব খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, আবার যেখানে অবকাঠামো রয়েছে সেখানেও এগুলো অনুষ্ঠিত হয় না। ফলশ্রুতিতে উদীয়মান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে উঠে না। উপরন্তু প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক গঠন সম্পন্ন হয় না।

জাপানের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের যা শিক্ষণীয়
পূর্বতন বাঙলা সালতানাত ভেঙেচুরে ১৯৭১ সালে এ দেশ বাংলাদেশ হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের নিয়ামকসমূহের অনুপস্থিতি থাকায় বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালেই রাষ্ট্র হিসাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রাষ্ট্র হিসাবে সংগঠিত হতে দেশের ভেতর থেকে যে সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক শক্তি সঞ্চিত হওয়া প্রয়োজন, তা এখনও সৃজ্যমান। কাজেই জাইকার তৈরিকৃত আধুনিকায়নের সপ্ত অধ্যায় ভিডিওতে মেইজি বিপ্লব থেকে শুরু করে চলমান জাপানের যে বিকাশের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে উন্নয়নের পক্ষে সে রকম রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক বিকাশ ঘটেনি। বরং ব্রিটিশ শাসন-শোষণের কবলে পড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উপাদানসমূহের বিয়োজন ঘটেছে। তা সত্ত্বেও আশার কথা এই যে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে অর্থনীতির গতি ফিরেছে। তবে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। তাদের পাঠানো অর্থে অনেক ভৌত অবকাঠামো গড়ে উঠছে, কিন্তু সেসব অবকাঠামো থেকে ঈপ্সিত পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হচ্ছে না। তাই দেশের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সামাজিক শক্তি দেশের ভিতর থেকে সৃষ্টি হচ্ছে না। কাজেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে জাপানের আদলে নিচের কার্যক্রমগুলো শুরু করা প্রয়োজন।

১. জাপানে জাতীয় দিবসগুলো জাতীয় চেতনা কর্ষণে সহায়ক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। জাতীয় দিবসসমূহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পালন করা হলে, দেশে জাতীয় চেতনাবোধ ও জাতীয় সংহতি গড়ে উঠে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় দিবসগুলোতে মানুষ অলস জীবনযাপন করে। অন্যদিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিবসগুলোতে মানুষ ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করে, এর ফলে জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় চেতনা অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। এ ধরণের ধর্মীয়-সংস্কৃতি অতিশুদ্ধতার চিন্তা-চেতনা জন্ম দিচ্ছে, যা ধর্ম রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক চিন্তাশক্তি বিকাশে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হলে, দেশবাসীদের জাতীয় চেতনা বিকশিত হবে। কাজেই জাতীয় দিবসসমূহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা বাঞ্ছনীয়।

২. জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক জ্ঞানীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে মেইজি বিপ্লবের পর মেইজি রাজতন্ত্র মাতৃভাষায় সার্বজনীন একক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। কারণ মেইজি বিপ্লবের মূল চেতনা ছিল, একক ভাষায় সার্বজনীন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। সেজন্য সরকারি প্রচেষ্টায় তখন জাপানি প্রমিত ভাষার সৃষ্টি করা হয়। এই প্রমিত ভাষা সৃষ্টি হলে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের জনগণ জ্ঞানীয় কার্যক্রমে সমভাবে যুক্ত সক্ষম হয়। ফলশ্রুতিতে এই জ্ঞানীয় কার্যক্রম দেশের উন্নয়নে যুক্ত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম না করে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শিক্ষানীতিতে ইংরেজি ভাষাকে বাংলার সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই শিক্ষানীতির নিরিখে ইংলিশ ভার্সন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলা শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাছাড়া মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা-ইংরেজি দ্বি-স্বাক্ষরতা বিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এই ভাষা চিন্তায় দ্বিবিধ বিক্ষপ্তির কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দক্ষতা জন্মাচ্ছে না, আবার উচ্চমানের জ্ঞানীয় কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় বাংলা ভাষায় দক্ষতা জন্মাচ্ছে না। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবর্তিত বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় অদক্ষতা ও অর্থনৈতিক অসামর্থ্যের কারণে, জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ শিক্ষা ও জ্ঞানীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে ইংরেজি ব্যবহারের ফলে জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশ জ্ঞানীয় কার্যক্রমে অবদান রাখতে পারছে না। কাজেই বাংলাদেশে ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এই উদ্যোগ সফল হবে যদি দ্বি-স্বাক্ষরতা বিশিষ্ট ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে, প্রথমে মাতৃভাষা ও পরবর্তীতে বিদেশি ভাষা-এই নীতি অনুসরণে ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়। আবার ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য যেহেতু ভাষাগত দক্ষতা অর্জন। সেজন্য ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক নিয়োগে ও শিক্ষার্থী ভর্তি ও উপরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণতে দক্ষতা ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।

৩. জাপানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সাংবাৎসারিকভাবে অনুষ্ঠিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রয়েছে। যে কারণে জাপানিদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে উঠে। এই সাংগঠনিক শক্তি জাপানের সামাজিক সম্পদ হিসেবে আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় প্রযোজিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে উক্ত ধরনের কর্মকাণ্ড তেমন একটা অনুষ্ঠিত হয় না বলে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সাংগঠনিক ক্ষমতা উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই সাংগঠনিক শক্তির ঘাটতির কুপ্রভাব দেশের আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনায় প্রতিফলিত হয়ে থাকে। বেসরকারি আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজস্ব মানব সম্পদ নিয়োগ ও উন্নয়ন নীতিমালার কারণে সমস্যাগুলো উৎরাতে পারে। কিন্তু সরকারি আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে এই অব্যবস্থাপনা ব্যাপক আর্থিক ও সময়ের ক্ষতি ও অপচয় বয়ে আনে। বাংলাদেশে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের মতো সেচ প্রকল্প অথবা বাংলাদেশ বিমানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অথবা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের অনুপাতে পণ্য বা সেবা উৎপাদন করতে পারছে না। স্বাস্থ্যখাতের অবস্থাও অনুরূপ। স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনার কারণে দেশে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদন হচ্ছে না। আবার স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ দুর্নীতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসক, প্রশাসন ও ঠিকাদারদের পকেটে চলে যাচ্ছে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রের পাশেই ডাক্তারদের মালিকানায় গড়ে উঠেছে পাতি হাসপাতাল। কাজেই দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিচালনায় বরাদ্দকৃত অর্থের অপচয় ও বিদেশে চিকিৎসা বাবদ ব্যয়িত অর্থের অপচয়-এই দু’ভাবে দেশের অর্থ বিনষ্ট হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা সুস্থ জাতি গঠনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক সামাজিক শক্তি সৃজনে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। সেজন্য ঈপ্সিত এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সৃজনে সহায়ক কোমল অবকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।

৪. জাপানে মেইজি বিপ্লবত্তোরকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ইনস্টিটিউট ও একাডেমিসমূহ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালনা হয়ে আসছে। সেখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী গবেষকগণ গবেষণায় রত থাকেন। ফলশ্রুতিতে জাপানের প্রত্যেক খাতের পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রয়োজনীয় চিন্তকবর্গ গড়ে উঠছে। এই চিন্তকবর্গ সবধরনের জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ যেসব জাতীয় ইনস্টিটিউট ও একাডেমিসমূহ রয়েছে, সেগুলো প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পরিচালনা করেন। সেখানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যতীত, তেমন কোনো গবেষণা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয় না। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসা স্নাতকদের মেধা জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক জ্ঞানীয় কার্যক্রমের ধারায় যুক্ত হতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে জাতীয় মহাপরিকল্পনা তৈরিতে সহায়ক চিন্তকবর্গ তৈরি হচ্ছে না। কাজেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ইনস্টিটিউট ও একাডেমিসমূহ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক গবেষণা কর্মকাণ্ড যেন অনুষ্ঠিত হয়, সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠানে কোমল অবকাঠামো ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের মেধাবী কর্মকর্তাদের গবেষণাকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের জন্য অতিরিক্ত গবেষণা ভাতা সুবিধাযুক্ত ১/২ বছর মেয়াদী শতশত গবেষক পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।

৫. জাপানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসনিক পদে সাধারণত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় ইনস্টিটিউট ও একাডেমিসমূহে গবেষণায় পারদর্শিতা দেখানো জ্ঞানদীপ্ত ও কর্মঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের এসব প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসনিক পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনায় কোনো মেধা ও কর্মকুশলতার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ইনস্টিটিউট ও একাডেমিসমূহ জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক গবেষণা কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠানের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জ্ঞানদীপ্ত ও কর্মকুশলীদের প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে, দেশব্যাপী বিস্তৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। ফলশ্রুতিতে অর্থ ও সময়ের অপব্যয় ও অপচয় হ্রাস পাবে। কাজেই জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসনিক পদে উক্ত জ্ঞানদীপ্ত ও কর্মকুশলী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

উপসংহার
নিবন্ধের শুরুতেই যেমনটা আলোকপাত করা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, প্রাযুক্তিক ও ভাষিক উন্নয়ন ব্যতীত সম্ভব নয়। কিন্তু জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়নের সঙ্গে যুগপৎভাবে। অপরপক্ষে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক বিকাশ ঘটেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা অথবা রাজনৈতিক শক্তির পাশ্চাত্যমূখীনতার কারণে বাংলাদেশে এসব সার্বিক উন্নয়নে সহায়ক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে না। কাজেই দেশে এখন বিদেশে শ্রম বিক্রয়ের মাধ্যমে আনিত অর্থ আছে, কিন্তু রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক পশ্চাৎপদতার কারণে সেই সব অর্থ সুষ্ঠু অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ হচ্ছে না, বরং অপচয় হচ্ছে।

এমতাবস্থায় একটি কথা স্পষ্ট যে, জাইকার উন্নয়ন বিষয়ক পরামর্শের মাধ্যমে এ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক সামাজিক শক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং জাইকার এই পরামর্শে জাইকারই লাভ হচ্ছে, কারণ জাইকার অর্থনৈতিক পরামর্শের মাধ্যমে তার দাতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। জাইকার এই গ্রহণযোগ্যতার ফলে, বাংলাদেশ এখন জাইকার কাছ থেকে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও ঋণ গ্রহণ করছে। এই কার্যক্রমে দাতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়ে, জাইকা এখন জাপানের হয়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে মুনাফা অর্জন করছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ জাইকাসহ বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদির মতো দাতা সংস্থার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নিজস্ব কোনো সামাজিক শক্তি নেই। কাজেই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করতে হলে, জাপানের আদলে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানীয়, ভাষিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখক: পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়
ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর