বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও দেশে পরিবারতন্ত্রের ভবিষ্যত
১৬ মার্চ ২০২১ ২৩:৪৮
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে ১৭ মার্চ ২০২০ সালে জন্মশতবার্ষিকী পূর্ণ হলেও তার মতো মানুষের জন্মশতবার্ষিকীর রেশ সহজে কাটার নয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে অনেকেই তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য সাফল্য এবং সংগ্রামের কথা আলোচনা করবেন বলে আশা করি। এই দিন উপলক্ষে দেশে বিদেশে আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুজনেরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের হতাশ করতে হয়েছে, কেননা আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখিনি। আমার ৫টা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি কবিতাও নেই, এই ব্যাপারটি তাদের বিস্মিত করেছে।
ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত না করলেও হতাশ করে বটে। কিন্তু আমার কাছে এ নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এবং সত্য বলতে কী, তার শত সহস্র কিংবা হাজার মাইলের ধারে-কাছেও দ্বিতীয় কোনো বাঙালির স্থান নেই। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক, তিনি বাংলাদেশি জাতিসত্তার জনক এবং তিনি বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক। তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারার স্বপ্ন আমার সবসময়ই ছিল, কিন্তু সাধ্য কখনই হয়ে উঠেনি। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি কোনো কবিতা লিখতে পারিনি, সামনেও পারব এমন দুঃসাহস করি না এখনও।
তবে আমার সীমিত সামর্থ্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। আজকেও তাই একটি ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে লিখতে চাই; লেখার বিষয়বস্তু পরিবারতন্ত্র, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্রের ভবিষ্যত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর পর থেকে পরবর্তী ২১ বছর জাতি হিসেবে আমাদের মেরুদণ্ডকে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার একটা পাঁয়তারা লক্ষ্য করেছি আমরা। জিয়াউর রহমান, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নানা উচ্চপদে আসীন করে বিদেশের দূতাবাসই শুধু নয়, দেশের ভেতরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসানো হয়। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী বানানো হয়। এইসবই বাংলাদেশীদের মেরুদণ্ডকে আঘাত করার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল।
এই সময়ে আমাদের যা ভুলভাল শেখানো হয়েছে, আমরা তাই শিখেছি, জেনেছি। নিজের বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছিল আমাদের। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পরিকল্পনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দুই বোন। প্রথমত, ঘাতকরা পুরো পরিবারকে কোনোভাবেই একই সময়ে হত্যা করার সুযোগ পায়নি বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পেছনে তাদের কিছু উদ্দেশ্যও ছিল। ভারত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে উদারভাবে সাহায্য করে, যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয় দ্রুততম সময়ে। তাই ভারতের স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের জাতির জনককে হত্যা করা পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সমর্থক মধ্যপ্রাচ্যের কিছু আরব দেশ ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাস করা পাকিস্তানপন্থী সেনাকর্মীদের মূল লক্ষ্য ছিল। এছাড়াও উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী পাকিস্তানপন্থী সেনাসদস্য ও অন্যান্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা যে তুমুলভাবে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তায় আবিষ্ট ছিল, তার প্রমাণ তারা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কখনওই বাংলাদেশের শাসনযন্ত্রে কল্পনা করতে পারেনি।
বাংলাদেশিদের সৌভাগ্য যে, ওই সময়ে বিদেশে থাকার কারণে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী তাদের নিজের দেশে আশ্রয় দেন। আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। ভারত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যেমন আমাদের পাশে ছিল, তেমনই ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার প্রতি তার মাতৃসুলভ স্নেহের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আদতে তার স্বাধীনতা ধরে রাখতে সাহায্য করেন। শত্রুর সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবার, পরবর্তীতে ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার, ২০১৪ সালে তৃতীয়বার এবং ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এই আলাপের সূত্রপাত যে কারণে করলাম সেটি হচ্ছে খুনিরা যে কারণেই হোক বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। এবং তাদের একজন শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে সফল হয়েছে, সারা বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম এখন সবার মুখে মুখে। অথচ জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সময় বাংলাদেশের এমনই তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল যে, এ দেশ নিজের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে পারবে কিনা তাই নিয়ে নানা বৈশ্বিক সংস্থা উৎকণ্ঠিত ছিল।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে, এবং দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে গোপনে গোপনে আবার পাকিস্তান বানানোর তাদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে এই আশঙ্কায় তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ে। তারা বুঝেছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এতই জনপ্রিয় যে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখা সম্ভব নয়। এই কথা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ বিরোধীরা মূলত সেই এরশাদের সময় থেকেই পরিবারতন্ত্রের ধোঁয়া তুলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে।
একইভাবে ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন, তখন তারা শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রে নামে। বাংলাদেশ বিরোধী এই ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞান-গরিমা ও সততায় এতটাই অনড় ও উচ্চে আসীন যে একমাত্র ষড়যন্ত্র ছাড়া তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। এবং তারা এটাও বুঝতে পারে যে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার মাধ্যমেই কেবল স্বাধীন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে পাকিস্তানপন্থী একটি উগ্রবাদী-মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব হবে।
এটি বুঝতে সমস্যা হয় না যে, মূলত বিএনপি-জামাত, অর্থাৎ পাকিস্তানি শাসনতন্ত্রের দাসত্বের ধারণা থেকে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিগুলোই বাংলাদেশকে পঙ্গু করার জন্য আমাদের শাসনব্যবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট তারা প্রাথমিকভাবে নিজেদের সফল মনে করলেও পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুনরাগমন এবং তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সালমা ওয়াজেদ জয়; একইভাবে শেখ রেহানার সন্তান রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের উজ্জ্বল উপস্থিতি, এইসব ঘাতকদের তাদের বাংলাদেশ বিরোধী উদ্যোগ নিয়ে উৎকন্ঠায় ফেলে দেয়।
বলাই বাহুল্য যে, এইসব উগ্রবাদী পাকিস্তানপন্থী শোষকেরা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক জিয়া ও আরাফাত জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনাকে অসংখ্যবার হত্যা চেষ্টা তারেক ও আরাফাত জিয়া সরাসরি মদত দেয়, পরিকল্পনা করে। জিয়া পরিবারের উত্তরাধিকাররা শিক্ষা, সংস্কৃতি, নেতৃত্ব যে কোনো সূচকেই এতটা ব্যর্থ ও নগণ্য যে, তাদের মতো নেতৃত্বের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিরা। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীগণ যখন আবার নেতৃত্বে আসেন তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের যারা বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন–শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ রেহানা, রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক তারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এদের অগ্রসরতা ও আধুনিকতাকে দেখে যারা ভয় পেয়েছে, তারাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের জুজু দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীগণকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চাইছেন।
এটি মনে রাখা দরকার পরিবারতন্ত্র তখনই খারাপ হবে যখন জিয়া পরিবারের মতো খুনি সদস্যরা একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবে। যেটি তারেক ও আরাফাত জিয়া হাড়ে হাড়ে দেখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। অথচ সারা বিশ্বেই পরিবারতন্ত্রের বেশ কিছু ভালো উদাহরণ আছে। আমেরিকায় বুশ পরিবার বা কেনেডি পরিবার একইভাবে কানাডায় ট্রুডো পরিবার উন্নত পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ।
ঠিক একইভাবে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার অন্ধকার যুগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং শেখ রেহানার সমর্থনে বাংলাদেশ যেমন আবার উন্নয়নের হাল খুঁজে পেয়েছে, সেটি বজায় রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীগণের ক্ষমতায় থাকা পরিবারতন্ত্রের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারে। শেখ হাসিনার সাথে সাথে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাই কেবল পারেন বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে।
সুতরাং বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে আমাদের মনে রাখতে হবে—পাকিস্তানপন্থী উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদীরা যাতে পরিবারতন্ত্রের নাম করে বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলাদেশ থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টায় সফল না হয়। আমরা যাতে সদা এই ব্যাপারে সতর্ক থাকি। আজ ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য দোয়া করি। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যাতে অব্যাহত থাকে এই কামনা করি।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো