মোদির বাংলাদেশ সফর— শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা
২২ মার্চ ২০২১ ১৪:৪৫
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পররাষ্ট্র সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে কী? বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি বন্ধুত্ব ও সংযুক্ততার ঐতিহাসিক বন্ধনের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের বর্তমান মেয়াদকালে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক একের পর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। বাংলাদেশ-ভারতের এই সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সভ্যতার ঐতিহ্যগত অংশীদারিত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ফেনী নদীর ওপর স্থাপিত বহুল প্রতীক্ষিত মৈত্রী সেতু গত ৯ মার্চ, ২০২১ তারিখে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে উদ্বোধনের ঘটনা দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যেকার আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের সাম্প্রতিক উদাহরণ।
বাংলাদেশ এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ফেনী নদীর ওপর ‘মৈত্রী সেতু’ তৈরি করা হয়েছে। ১.৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি বাংলাদেশের রামগড় এবং ভারতের সাবরোমকে যুক্ত করেছে। গত ৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত “মৈত্রী সেতু” উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার এক পক্ষেরও কিছু বেশি দিন আগে এই “মৈত্রী সেতু” উদ্বোধন করা হলো। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘ফেনী নদীর ওপর এই সেতু নির্মাণের ফলে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের নিকটতম ভারতীয় নগরী হবে আগরতলা। এর আগে আগরতলার নিকটতম সমুদ্রবন্দর ছিল কলকাতা।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতুর কারণে চট্টগ্রাম থেকে আগরতলার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারেরও কম হয়েছে’। ফেনী নদীর ওপরের মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ আসাম, মিজোরাম এবং মনিপুরের মাধ্যমে এর সংযুক্ততা উন্নত হবে এবং বাংলাদেশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সেতুটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি জীবন-রেখা হয়ে উঠবে। আপনারা জানেন, ভারতে এবং ভারত হতে পণ্য চলাচলের জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে’। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতকে সংযুক্ততা প্রদানের মাধ্যমে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন যুগ সৃষ্টি করছি। আমরা এমন এক অঞ্চলে আছি যা উন্মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই রক্ষণশীল এবং যেখানে আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্ভাবনার চেয়ে অনেক নিচে’। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি রাজনৈতিক সীমানা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শারীরিক বাধা হওয়া উচিত নয়। আমরা আশা করি যে কাঠামো আজ আমরা উদ্বোধন করলাম তা বাংলাদেশের সাথে শুধু ভারতেরই নয়, নেপাল ও ভুটানের বাণিজ্য বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে। বাংলাদেশের অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযুক্ততার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হতে চায়, এবং ভারতের সাথে ক্রমোন্নয়নশীল সীমান্ত পারাপারে পরিবহন ব্যবস্থা আঞ্চলিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তুলবে’।
২০১৯ সালের আগস্টে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ যৌথ নদী কমিশনের সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এই সভায় মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার, এবং ফেনী এই ৭টি নদীর জলবন্টনের ব্যাপারে তারা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২০১৯ সালের ৩-৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিবৃতিতে যৌথ নদী কমিশনের প্রশংসা করা হয়। এতে বলা হয়, ‘উভয় নেতা (মোদি ও হাসিনা) পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ের ঢাকায় অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত ত্রিপুরার সাবরোম শহরের জনগণের পানীয় জল সরবরাহের লক্ষ্যে ফেনী নদী হতে ১.৮২ কিউসেক জল উত্তোলনের কাজ দ্রুত শুরু করার ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন’। ত্রিপুরার দক্ষিণে অবস্থিত সাবরোম শহরের উপকারের জন্য এই সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করা হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী সাবরোম শহরে বর্তমানে জল সরবরাহের অবস্থা অপর্যাপ্ত। এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলে প্রচুর আয়রন। তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা সাবরোম শহরের ৭ হাজার মানুষের উপকারে আসবে। তবে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কিত সমঝোতা না হওয়ার বিষয়টিতে বাংলাদেশের মানুষ উদ্বেগের সাথে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। অনেকে মনে করছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনী ফলাফল কেন্দ্রীয় সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের অনুকূলে হলে বিষয়টির সুরাহা ত্বরান্বিত হতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সাধারণত রাষ্ট্রসমূহের বৈদেশিক নীতির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক উপাদান। এ ধরনের দাবী, যুক্তি এবং প্রমাণের একটি প্রচলিত অপরিশোধিত পরিমাপ হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক সংগঠন’ সম্পর্কে প্রকাশিত প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ, যা কম-বেশি স্পষ্টভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা অভ্যন্তরীণ-রাজনৈতিক উপাদানসমূহকে বৈদেশিক নীতি পছন্দের ব্যাখ্যা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ‘অ্যানুয়াল রিভিউ অব পলিটিক্যাল সায়েন্স’ জার্নালের ১৯৯৮ সালের জুন সংখ্যায় প্রকাশিত ডোমেস্টিক পলিটিক্স, ফরেন পলিসি, এন্ড থিওরিজ অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক জেমস ডি ফিয়ারসন এই ধরনের যুক্তি প্রদর্শন করেন। ফিয়ারসন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৮ সালে এধরনের ১৯৩টি গবেষণা প্রবন্ধের এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি সারসংক্ষেপ নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার পর, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ-রাজনৈতিক উপাদানসমূহকে স্বাধীন বা হস্তক্ষেপকারী চলক হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মবদ্ধ করতে সক্ষম হন। তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক প্রবন্ধ বৈদেশিক নীতি ব্যাখ্যা সম্পর্কিত না হওয়ার প্রেক্ষাপটে যে সংখ্যক প্রবন্ধে এই সম্পর্ক লক্ষ্য করা গিয়েছে তা খুবই উল্লেযোগ্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোতে এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ফিয়ারসন তার এই যুক্তির সপক্ষে বেশ কয়েকটি বইয়ের শিরোনাম উল্লেখ করেছেন। তবে বর্তমান লেখার প্রয়োজনে আমরা ২০১৩ সালের ৪ মার্চ টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি সংবাদ প্রতিবেদনের উদাহরণ তুলে ধরা সঙ্গত মনে করছি। পাঠকদের অনেকেরই মনে থাকবে হয়তো সেসময় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত শ্রী প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফর করছিলেন। সফররত ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনেক আগে থেকেই তৎকালীন বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সাক্ষাতের ঠিক আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা সাক্ষাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, ‘Domestic politics overshadowed the first Indian presidential visit to Bangladesh since the 1970’s as leader of opposition and Bangladesh National Party (BNP) chief Khaleda Zia cancelled her meeting with President Pranab Mukherjee scheduled for Monday citing security concerns. অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের ঔজ্জ্বল্যকে ছায়াচ্ছন্ন করে দিয়েছে, কারণ বিরোধীদলীয় নেতা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রধান খালেদা জিয়া নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত বাতিল করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিএনপি-র দোসর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-ই-ইসলামের কয়েকজন নেতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সেসময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের সময় বেশ আগেই আমরা নির্ধারণ করেছিলাম এবং এটি আমাদের কর্মসূচীতে বেশ কিছুকাল যাবৎ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রেসিডেন্ট বস্তুত বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ভারতের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ বাতিল করাকে ‘অসৌজন্যমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে খালেদা জিয়া দিল্লি সফর করার সময় তৎকালীন ভারতীয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে একটি মহলের তৎপরতা ২০১৩ সালে ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাত বাতিলের ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্ব অংশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সমর্পিত হওয়ার পর থেকেই বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপন প্রভৃতি সবকিছুকে পাকিস্তানিকরণের লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালিদের বৈধ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের চেতনা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন প্রভৃতি ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে) জনসমুদ্রে এবং ২৫ মার্চ গভীর রাতে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানান। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবন, প্রায় তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং প্রায় ৩৯০০ ভারতীয় সেনার নিহত এবং ১০,০০০ ভারতীয় সেনা আহত হন। অনেক ভারতীয় সেনা স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এরপর ৯০,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে স্থান করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একটি সেনাবাহিনীর এমন বিরাটভাবে আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেনি। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং এমনকি কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয় এমন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। ১৯৭১-এর সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছিল। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ১৯৭১ সালের ১ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট জুডিসিয়ারি কমিটিতে দাখিলকৃত এক প্রতিবেদনে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন, ‘মাঠ পর্যায় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিকট প্রেরিত প্রতিবেদন, অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বিবরণ, বিশ্বব্যাংক এবং এধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রতিবেদনসমূহ এবং সাবকমিটির নিকট প্রাপ্ত অতিরিক্ত তথ্য পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তানে) সন্ত্রাসের রাজত্বের গ্রাস হওয়ার দালিলিক প্রমাণ দেয়। সবচেয়ে কঠিন আঘাতের শিকার হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা যাদের জমি ও দোকানপাট অপহৃত হয়েছিল, সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল, এবং কিছু স্থানে হলুদ রঙ দিয়ে ইংরেজি-এইচ [ইংরেজি হিন্দু/H এর আদ্যাক্ষর] অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। এসবগুলোই ইসলামাবাদের সামরিক আইনের অধীনে অফিসিয়ালি অনুমোদন প্রাপ্ত, নির্দেশিত এবং বাস্তবায়িত হয়েছিল’।
গ্যারি বাস-এর বই দ্য ব্লাড টেলিগ্রামে (ভিনটেজ, ২০১৪) ১৯৭১ সালে ঢাকায় কর্মরত আমেরিকার কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড (সেই সময়ের পূর্ব) পাকিস্তানি ‘হিন্দুদের ওপর গণহত্যার নিন্দা করা আন্তর্জাতিক নৈতিক বাধ্যবাধকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ লোককে পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা হত্যা করেছে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভুটান প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিচিত্র পথ অতিক্রম করেছে। সম্পর্কের এই বৈচিত্র্য প্রধানত বন্ধুত্বের আবরণে আচ্ছাদিত থাকলেও তা কখনো কখনো শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছাতেও দেখা গিয়েছে। বস্তুত উভয় দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় কোন রাজনৈতিক দল অধিষ্ঠিত থাকে, তার ওপরই নির্ভর করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটি বন্ধুত্বপূর্ণ হবে না শত্রুতামূলক হবে। বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কের মধ্যে আরও একটি উপাদান স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় তা হচ্ছে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের চেতনা। যখন বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে এর নিন্দা জানানো হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের জামাত-ই-ইসলাম এর প্রতিবাদ জানায়। ২০১৫ সালে ঢাকার ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে ঢাকার পাকিস্তান হাই কমিশনের কনস্যুলার সেকশনের অ্যাটাশে মোহাম্মদ মাজহার খানকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সার্ভিস ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মাজহার খান ঢাকায় ব্যাপক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় জাল মুদ্রা উৎপাদন ও বিতরণ করছিল। গোয়েন্দা রিপোর্টের সূত্র উল্লেখ করে ডেইলি স্টারের এই সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে মাজহার খান তার কিছু সহকর্মীর সহযোগিতায় জাল মুদ্রার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ হিজবুত তাহরির, আনসারউল্লাহ্ বাংলা টিম, এবং জামাত-ই-ইসলামির কাছে বণ্টন করছিল। উল্লেখ্য, জামাত যখন সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিল তখন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বেশ কয়েকজন জামাত নেতাকে বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এভাবে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের ভারত বিরোধিতা বৃদ্ধি পায়, অপরদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থাকলেও বিএনপি-জামাতপন্থী গোষ্ঠী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিবর্তে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার ঘটানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এভাবে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের অফিসিয়াল ভার্সন এবং জনমনের ধারণার মধ্যে সবসময়েই একটা পার্থক্য থাকে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে আসছেন। স্বাভাবিক কারণেই উপরে উল্লিখিত জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থক বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল এই সফরকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সফর সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
ঢাকা সফরকালে আগামী ২৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব ইস্যুতে আলোচনা হবে। গত ১৫ মার্চ ২০২১ সকালে রাজধানীতে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মোদি ঢাকা সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ এখনও আশাবাদী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিন আলোচনা চলছে। আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে পানি এবং বাণিজ্য। দুই দেশের সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বড় ইস্যু হচ্ছে সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ক্রিটিকাল সব বিষয় নিয়ে দুই দেশের নেতারা আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তা মোটামুটি ঠিক হয়েছে। সেগুলো যাতে বলবৎ থাকে, প্রয়োগে যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য হয়তো আমাদের (বাংলাদেশের) প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরতে পারেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সাবেক অ্যাসোসিয়েট এডিটর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একটি কলামে লিখেছিলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে, ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত উদ্বেগের সবকিছু বাংলাদেশ খুব দ্রুত এবং ইতিবাচকভাবে বিবেচনামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করেছে। ভারতের ভূমি আবদ্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন আর তেমনটি নেই। তবে বাংলাদেশের দু’টি সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং সীমান্ত হত্যা এখনও ভারত কর্তৃক বিবেচিত হয়নি’।
শাহেদুল আনাম খান এরপর বলছেন, ‘যে প্রশ্নটি আমরা উত্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি তা হলো, এই ইস্যুগুলো সন্তোষজনকভাবে এবং দ্রুত বিবেচনা করা হবে কী?’ শাহেদুল আনাম খান তার এই নিবন্ধে ভারতের অভ্যন্তরীণ সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ), এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) নিয়ে মন্তব্য করার পাশাপাশি চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ্যে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি পাল্টা যুক্তি থাকার কথা বলেছেন। তবে শাহেদুল আনাম খান সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতার ফলে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য বা এসবের কোনো উল্লেখ করেননি, যা বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগের বিষয়। সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং সংখ্যালঘু কমিশন প্রতিষ্ঠা করা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবী। দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার এসব বিষয়ে যথাযথভাবে ওয়াকিবহাল আছেন। উল্লেখ্য, ভারতে ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য এইসব ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই আছে। সেদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ এবং ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর মাইনরিটিজ’ অনেক আগে থেকেই কাজ করছে। তবে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল বৈঠকে ৩৯ দফা যৌথ বিবৃতি ঘোষণা করা হতে এর কোনো কিছুই তাদের বিরত করতে পারেনি। যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ও আন্তরিকতার সাক্ষ্য বহন করে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযুক্ততার কেন্দ্রস্থল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতুর উদ্বোধন। এই সংযুক্ততা শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যেই নয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ও নেপাল এর মধ্যে সংযুক্ততা বৃদ্ধি করবে। বিশ্বব্যাংক কানেক্টিং টু থ্রাইভ: চ্যালেঞ্জেস এন্ড অপর্চুনিটিজ অব ট্রান্সপোর্ট ইন্টিগরেসন ইন ইস্টার্ন সাউথ এশিয়া শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটর ভেইকল এগ্রিমেন্ট(এমভিএ) বিশ্লেষণ করেছে। এই প্রতিবেদনে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযুক্ততার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সর্বোত্তম প্রাকটিসগুলোর তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পরিবহন সংযুক্ততার ফলে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের শতকরা ১৭ ভাগ এবং ভারতের জাতীয় আয়ের শতকরা ৮ ভাগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সফলতা কামনা করে, যা উভয় দেশের জন্য উন্নয়ন, অগ্রগতি, শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনবে।