দেশপ্রেমের মনোবল হোক স্বাধীনতার স্মৃতিপট
২৪ মার্চ ২০২১ ১৬:০৪
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস রয়েছে। হয়ত আমরা অনেকেই এই দিবসগুলো জানি না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। প্রত্যেকটা দিবসের পটভূমি রয়েছে। রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ প্রেরণা। স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চাই না। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পথ মসৃণ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ অগ্নিঝরা ও বেদনাসিক্ত। স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয় এই মার্চেই। এই মাসেই বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। উত্তাল একাত্তরে পুরো মার্চ মাসজুড়ে বাঙালির চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন।
দীর্ঘদিন ধরে এদেশের শোষিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তাানি স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এ অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩ মার্চ। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার হীন, কূটষড়যন্ত্র হিসেবে অধিবেশন বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রোধে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অধিকারহীন মানুষ ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। অফিস-আদালত থেকে সব মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এই ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ করেন। স্লোগান ওঠে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
১৯৭১-এর ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দান আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এ সময় পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তার ঘোষণার পর বীর বাঙালি সেই যে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফেরেনি।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। ইতিহাস বলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকেই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। আর এর পেছনের ইতিহাসটা আরও লম্বা। ১৭৫৭ সাল— যেদিন স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দোলা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কিছু আত্মীয়মহলের চক্রান্ত ও অসযোগীতায় নবাব পরাজিত হন এবং তাকে হত্যা করা হয়। সেই থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে। চলে কোম্পানি আর ব্রিটিশদের শাসন। ব্যবসা করার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে আসলেও বাংলার জমি সোনার চেয়েও খাঁটি যা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ব্রিটিশরা। পায়তারা করে দেশকে শাসন করার। এভাবে চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন। তাইতো বলা হয় প্রায় দুইশ বছর স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত ছিল। প্রায় দুইশ বছর ব্রিটিশদের অত্যাচারে ভারতীয় উপমহাদেশ শোষিত হয়েছে সেই অর্থে বলা—সূর্য অস্তমিত ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। তার আগে বঙ্গভঙ্গসহ বিভিন্ন কৌশলে ব্রিটিশরা শাসনমেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সেকালে বর্তমান বাংলাদেশ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। তখনও আজকের বাংলাদেশ শোষিত। খেলাটা একই ছিল শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছিল। যার প্রথম প্রমাণ মেলে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা সফল হয়নি। ভাষার জন্য রাজপথে মিছিল করে জীবন দিয়ে বাঙালি জাতি পৃথিবীতে প্রথম বুঝিয়ে দিয়েছে তারা আন্দোলন করতে পারে। তারা ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে। সেদিন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহিদদের রক্ত বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সেদিনের সেই ইতিহাস নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রেরণ যুগিয়েছিল। সাহস যুগিয়েছিল পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রামের। যার প্রতিদানস্বরূপ ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা যার প্রথম দফাই ছিল স্বায়ত্তশাসনের, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ওই পাকিস্তানিরা শুরু করে ক্ষমতা দেওয়ার নামে টালবাহানা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, রাতে আলোচনার কথা বলে আকস্মিকভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। সেদিন রাতেই চলে আপারেশন সার্চলাইট। হত্যা করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের এদিনে বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস, ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা। সেইরাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংসতা চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। কিন্তু তারা সফল হয় নাই। বাঙালির অদম্য মনোবলের কাছে তারা পরাজিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি বিজয় অর্জন করে।
২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে প্রেরণা যুগিয়েছিল। মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনেছিল। সেদিন যদি এই ঘোষণা না আসত তাহলে হয়তবা আমাদের বিজয়ের দিন বিলম্বিত হতো। জাতি হতো দিশেহারা। ২৬ মার্চের ঘোষণা জাতিকে একটি পথ দেখিয়েছিল। সকলে একটি লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে চলে। ২৬ মার্চ আমাদের সেই লক্ষ্যটা নির্ধারণ করে দেয়। যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়েছে, অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে সম্ভ্রম। আহত ও পঙ্গু হতে হয়েছে এদেশের অগণিত মানুষকে। লাখো মানুষের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আমার মনে হয় বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস একটি স্বাধীনতা প্রত্যাশী দেশকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। শুধু দেশ নয় একটি ব্যক্তি মনেও যোগাবে সাহসের বাতি। স্বাধীনতার সেই সূর্য উজ্জীবিত হোক। স্বাধীনতার দ্যুতি আলো ছড়াক সকল প্রাণে। জেগে উঠুক বাংলা, স্লোগান বলি—জয় বাংলা।
একজন নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা সতর্ক থাকা। মা-বাবার প্রীতির সঙ্গে দেশপ্রেমও যে অপরিহার্য আমরা হয়ত অনেক সময় ভুলে যায়। কিন্তু আমাদের সেই সকল বীর বাঙালি যদি দেশের কথা না ভেবে পরিবারের কথা ভাবতেন তাহলে আমরা কি স্বাধীন দেশ পেতাম? আমরা কি মাতৃভাষা বাংলাভাষা পেতাম? স্বাধীনতার চেতনা দেশপ্রেমের প্রেরণা। সকলকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। দেশপ্রেমের মনোবল হোক স্বাধীনতার স্মৃতিপট।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট