সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে
৩১ মার্চ ২০২১ ১৮:৪৯
দিনটি ছিল শুক্রবার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সারাদেশে পালিত হচ্ছিল সুবর্ণজয়ন্তী। সবাই যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যস্ত তখন রাজশাহীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭টি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। পত্রিকায় দেখলাম একটি পরিবারে কেবল এক বৃদ্ধ বেঁচে আছেন। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিসহ সকলেই ওই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। রাজশাহীর দুর্ঘটনা ছাড়াও সারাদেশে একইদিনে আরও ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। অর্থাৎ একদিনেই ২৭ জনকে সড়কে প্রাণ হারাতে হয়েছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষকে প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ত থাকতে হয়। ছুটতে হয় নানা জায়গায়। কখনও শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে, আবার কখনও বা বসবাসরত স্থানের নানা পথ ধরে এদিক-ওদিক মানুষকে ছুটতেই হয়। আর তখন পথকেই সঙ্গী করে নিতে হয়। কিন্তু পথ মানুষকে কতটুকু সঙ্গী করতে পেরেছে? প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই পথে বলি হচ্ছে। যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। এই যন্ত্রদানবের ভয়াল থাবায় হাজারও মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত।
মৃত্যু একটি অনিবার্য বিষয়। এটি সৃষ্টির অমোঘ ও অখণ্ডনীয় বিধান। প্রত্যেক জীবকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। জীবনের একটি পর্যায়ে ইহজাগতিক সকল মায়া মমতা বিসর্জন দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। কিন্তু আমাদের মৃত্যু কোন পন্থায় হচ্ছে সেটাই চিন্তার বিষয়। মানুষের মৃত্যু দুইভাবে হতে পারে। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু এবং অপরটি অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু সকলের কাম্য। অপরদিকে অপঘাতে মৃত্যু কারো কাম্য নয়। স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে রোগাক্রান্ত হয়ে অথবা বার্ধক্যজনিত মৃত্যুকে বোঝায়। যা প্রকৃতিগতভাবে ঘটে থাকে। কিন্তু অপমৃত্যু বলতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে যাওয়া মৃত্যুকে বোঝায়। অর্থাৎ কোনো রোগে আক্রান্ত না হয়ে বা অপরিণত বয়সে আগেই মারা যাওয়াকে বুঝায়, যেটার জন্য এক বা একাধিক পার্থিব কারণ থাকে। যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে এমন মৃত্যু থেকে বাঁচা বা মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
দুর্ভাগ্যবশত সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কোনোদিন নেই যে দেশের কোনো না কোনো জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে না বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করছে না। মৃত্যুর পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এভাবে হাজারও পরিবারে নেমে আসছে দুঃখ কষ্টের কালো ছায়া। আবার অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে হয়ে যায় নিঃস্ব। সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মা হচ্ছে সন্তান হারা স্ত্রী হচ্ছে স্বামী হারা আর সন্তান হচ্ছে পিতৃহারা। এভাবে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় পরিবার পরিজন হারানোর দুঃসহ বেদনা। আর পরিবার পরিজন হারানোর যে নিদারুণ যন্ত্রণা তা হয়তো ভুক্তভোগী মানুষগুলোই অনুধাবন করতে পারে।
আমরা যদি কয়েক বছরের পরিসংখ্যানগুলো দেখি তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারব। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। আর আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত এবং আহত হন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। অতপর ২০১৭ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। যা দিনে ২০ জন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপের বরাত দিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন পঙ্গুত্ব বরণ করে।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়কে প্রায়ই দেখা যায় ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর গাড়ি দেদারসে চলছে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে সড়কে দুর্ঘটনার প্রায় নব্বই শতাংশ ঘটে বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকিং প্রতিযোগিতার কারণে। এছাড়া চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক মানসিক অসুস্থতা উল্লেখযোগ্য। প্রায়ই দেখা যায় লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও হেল্পাররা গাড়ি চালান। এতে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় একজন চালক সারাদিন ধরে বিরতিহীনভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন যেমন রিকশা, ভ্যান, নছিমনজাতীয় গাড়ি চলাচলের কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সাম্প্রতিককালে, মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর জন্যও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা লাগামহীন হয়ে পড়েছে ।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য পথচারীরাও অনেকাংশে দায়ী। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়কে দুর্ঘটনার প্রায় ৫২ শতাংশ হচ্ছে পথচারী সংক্রান্ত। অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য পথচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, উদাসীনতা ও অসচেতনতা দায়ী। জেব্রাক্রসিং, আন্ডারপাস এবং ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে বা মোবাইল চাপতে চাপতে রাস্তা পার হতে আমরা একটু দ্বিধাবোধ করি না। যেখানে সেখানে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দিয়ে আমরা রাস্তা পার হই। চালকরা গাড়ি না থামালে আমরা পথচারীরা তাদের গালিগালাজ এমনকি মারধোর পর্যন্তও করি। শুধু তাই নয়, কোনো স্টপেজের তোয়াক্কা নয়, যত্রতত্র গাড়ি থেকে উঠানামা করে থাকি।
বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে এটি এখন একটি জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নবর্ণিত প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
দেশের প্রতিটা মানুষের ভিতরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সচেতন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা আইন করে রোধ করা যাবে না ।
• সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করার জন্য গাড়ির মালিক, চালক এবং হেল্পারসহ সকলকে সড়ক পরিবহনে বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন মেনে চলতে হবে।
• ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।
• বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং পরিহার করে গাড়ি চালানোর নির্ধারিত সর্বোচ্চ গতিসীমা মেনে চলতে হবে।
•অনির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং বন্ধ এবং মহাসড়কে অবৈধ তিন চাকার গাড়ির অনুপ্রবেশ রোধ করতে হবে।
• চালকদের লাইসেন্স প্রদানের আগে পরীক্ষার মাধ্যমে চালকদের দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করে হবে। এছাড়া লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে।
• গাড়ি রাস্তায় বের করার আগে যান্ত্রিক ত্রুটি আছে কিনা যাচাই করা এবং নিয়মমাফিক মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করে যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি বিচ্যুতি আছে কিনা তা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
• ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত করে পথচারীদের চলাচলের উপযোগী করতে হবে পথচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও উদাসীনতা পরিহার করে সর্তক ভাবে চলাফেরা করতে হবে।
• গাড়িতে উঠানামা করার সময় যাত্রীদের সর্তক থাকতে হবে এবং নির্দিষ্ট স্টপেজ ব্যবহার করত হবে। অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন বন্ধ করতে হবে।
• মহাসড়কের পাশে হাটবাজার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে এবং রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে।
• উল্টো পথে গাড়ি চালানোর মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
• গাড়ি চালক ও আমাদের সবার মনে রাখতে হবে—সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
সর্বোপরি সরকারকে সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।কেননা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আইন আছে কিন্তু সেই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। সড়কে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে চাইলে বিদ্যমান আইনের শতভাগ প্রয়োগ নিশ্চিত করতেই হবে।
লেখক: কলামিস্ট