Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মৌলবাদ সংকটের সমাধান ইসলামেই আছে


৪ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৩৯

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস মহামারির পর সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত ধর্মকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার একদম কেন্দ্রে রয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এই সংকট নিয়ে দেশের প্রাজ্ঞজনদের বিভিন্ন বক্তব্য, লেখা ইত্যাদি দেখছি নিয়মিত। গতকাল সারাবাংলায় প্রকাশিত বন্ধু সুমন জাহিদের একটি লেখাকে বেশ গুছানো এবং নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার মতো মনে হয়েছে। তবে এই পরিকল্পনা নিয়ে কিছু প্রশ্নও এসেছে মনে। সেই প্রশ্নগুলো এবং আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা নিয়ে আজকের লেখা। সুমনের যে পয়েন্টগুলো নিয়ে আমার প্রশ্ন এবং মতামত আছে, তা সবার আগে অবতারণা করার চেষ্টা করছি। সুমন জাহিদ রাষ্ট্র, সরকার ও সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের করণীয় হিসেবে যেসব বলেছেন তা উল্লেখ করে আমার মতামত জানাবো। পরে হেফাজতে ইসলাম ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমার মতামত পেশ করব।

সরকারের করণীয়

সুমন জাহিদের পরামর্শ
হরতালের নামে নাশকতাকারী সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ তাদেরকে উপযুক্তভাবে কাউন্সেলিং করতে হবে। যে সকল মসজিদ থেকে মাইকে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, স্যোসাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে যারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। হুকুমের আসামী ও উস্কানিদাতা হিসেবে বাবুনগরী, মামুনুল হকসহ শীর্ষ হেফাজত নেতাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।

আমার মতামত
হরতাল একটা গণতান্ত্রিক অধিকার। যে কোনো হরতালেই সম্পদ ধ্বংস হয়। হরতাল মানেই নাশকতা এমন সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় কি? এভাবে গণতন্ত্র চর্চাকে সংকুচিত করলে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয় প্রতিবাদকারীদের। সে ক্ষেত্রেই বরং নাশকতা বেশি হয়। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না পেলেই মানুষ নাশকতার পথ বেছে নেয়। হরতাল ডাকলেই তাকে ক্রিমিনালাইজ করার সংস্কৃতির এ চর্চা কি আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনছে? এই সংস্কৃতি এরশাদের আমল থেকে প্রচলিত। সব সরকারই হরতালকে নাশকতার সাথে তুলনা করেছে। এই অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও আছে। মাইকে বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো ঘটনাতো গোপনে ঘটে না। এ ব্যাপারে স্থানীয় থানা কেন কখনও আগাম ব্যবস্থা নিতে পারেনি তা খুঁজে দেখা জরুরি। তবে এই অভিযোগে হেফাজতের নেতাদের গ্রেফতার করা হলে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, জনগণের মধ্যে এমন বিশ্বাস থাকবে এমন বিশ্বাসযোগ্যতা কি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আছে? এই আস্থা না ফিরিয়ে এমন ব্যবস্থা হেফাজতের প্রতি সহানুভূতি কি আরও বাড়াবে না?

সুমন জাহিদের পরামর্শ
হেফাজতের প্রয়াত প্রধান আল্লামা শফির মৃত্যু বিচারবিভাগীয় পুণঃতদন্তপূর্বক যথোপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সৃষ্ট অরাজকতা জাতির সামনে স্পষ্ট করতে হবে।

আমার মতামত
এখন এই ধরনের তদন্ত শুরু করলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।

সুমন জাহিদের পরামর্শ
করোনাকালে ঘরেবাইরে, মসজিদে সকল প্রকার ওয়াজ মাহফিল, জিকির, ইসলামী জলসাসহ সব প্রকার বয়ান ও অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করতে হবে।

আমার মতামত
করোনাকালে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান চালু রেখে ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা কতটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? সরকারকে স্ববিরোধীতার অভিযোগ করা হলে এর জবাব কী? যদি এমন অভিযোগ করা হয় যে, সরকার ইসলাম বিরোধী, তাকে মোকাবেলা করার যথেষ্ট মোর‍্যাল ক্যাপিটাল কি থাকবে?

রাষ্ট্রের করণীয়

সুমন জাহিদের পরামর্শ
সকল মসজিদে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

আমার মতামত
আমি নিয়মিত মসজিদে যাওয়া মানুষ।।মসজিদে রাজনীতি হয়, এটা একটা তৈরি করা মিথ। এর কোনো প্রমাণ আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। বরং এ ধরনের ন্যারেটিভ রাষ্ট্র আর মসজিদকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিবে।

সুমন জাহিদের পরামর্শ
নিষ্কণ্টক জমিতে ইসলামী ফাউন্ডেশনের পূর্বানুমতি ব্যতীত কোনো মসজিদ নির্মাণ করা যাবে না। বিরোধপূর্ণ জায়গা, অর্পিত সম্পত্তি বা জোর করে বেআইনিভাবে দখলকৃত জমিতে নির্মিত সকল মসজিদ, মাদরাসা উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিটি মসজিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব যথাযোগ্য অডিট ফার্ম কর্তৃক নিরীক্ষা করাতে হবে। মসজিদ কমিটিতে গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। কোনোভাবেই যুদ্ধাপরাধী, জামাত-শিবির, দুর্নীতিবাজ, কালোটাকার মালিক, ঘুষখোর-সুদখোর, সমাজবিরোধী কেউ মসজিদ কমিটিতে থাকতে পারবে না।

আমার মতামত
যাদের মসজিদ কমিটিতে রাখা যাবে না বলা হচ্ছে, তারা সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে রেখে মসজিদ থেকে সরানো যাবে কী করে? ইসলামি ফাউন্ডেশনের মুসলিমদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় অথোরিটির গ্রহণযোগ্যতা নেই বা থাকলেও অত্যন্ত নগণ্য । ইসলামের জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তিদের ইসলামি ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে নিয়োগ করার ঘটনা ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে এমন চাপিয়ে দেওয়া অথোরিটি কতটা কার্যকর হবে?

সুমন জাহিদের পরামর্শ
সকল প্রকার মাদ্রাসার সোর্স অব ফান্ড জানাতে হবে। দুর্নীতি বা ঘুষের টাকায় কোনো মসজিদ-মাদরাসা নির্মিত হতে পারবে না। মাদরাসাগুলো নিয়মিত অডিট করতে হবে। শিক্ষা ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের যৌথ অনুমতি ব্যতীত কোনো প্রকরের মাদরাসা নির্মাণ বা পরিচালনা করা যাবে না। যেগুলো আছে সেগুলোকেও নিয়মের আওতায় আনতে হবে।

আমার মতামত
একই প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না? বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এতিমখানা আছে কিনা জানা নেই। এই মাদরাসাগুলোর একটা বড় অংশ এতিমখানা। এই ধরনের উদ্যোগে হয়রানির ভয়ে মানুষ দান করা বন্ধ করে দিলে এই এতিমদের দায়িত্ব কে নেবে? দেশের রাজনীতিতে কালোটাকার দৌরাত্ম্য বজায় রেখে মাদরাসায় কালোটাকা খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা সফল হবে কি?

সুমন জাহিদের পরামর্শ
সকল মাদ্রাসা রাজনীতিমুক্ত হতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মাদ্রাসার শিশুদের রাজপথে আনা যাবে না। বলৎকার রোধে নতুন আইনসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমার মতামত
একই প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কলেজের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না?

সুমন জাহিদের পরামর্শ
সকল মসজিদ ও মাদরাসার প্রতিটি কক্ষ ২৪ ঘণ্টা সার্ভেলেন্সের মধ্যে আনার জন্য পর্যাপ্ত সিসিটিভি স্থাপন করতে হবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়ভাবে মুরুব্বিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।

আমার মতামত
একই প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কলেজের ক্ষেত্রে কেন প্রযোজ্য হবে না? এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি? এ ধরনের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার অপব্যবহার বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে হয়ে আসছে। এটা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাবহার হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

সুমন জাহিদের পরামর্শ
উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে স্থানীয়দের বাইরে নতুন নতুন ইমাম-মোয়াজ্জেম নিয়োগ হচ্ছে যারা এলাকায় পরিচিত নয়। মসজিদ ও মাদরাসায় নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব ক্লিয়ারেন্সসহ সঠিক নিয়োগপদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া সকল প্রকার মাদরাসা থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের অবজারভেশনে রাখতে হবে।

আমার মতামত
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এভাবে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার কি রাষ্ট্রের আছে? এই ধরনের প্র্যাকটিস একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কিভাবে গ্রহণযোগ্য হয়? মাদরাসায় পড়লেই তাকে নজরদারীতে রাখতে হবে এমন ব্যবস্থা ন্যায়বিচার আর সমঅধিকারের পরিপন্থী। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে এভাবে ক্রিমিনালাইজ করতে পারে না। সংবিধানের রক্ষাকবচগুলো এসব মাথায় রেখেই রাখা হয়েছে।

সুমন জাহিদের পরামর্শ
বাংলাদেশের প্রায় সকল গ্রাম ও মফস্বল শহরে নতুন ট্রেন্ড চালু হয়েছে ঘরোয়া মহিলা মাহফিল। এ ধরনের মাহফিল করার ক্ষেত্রে সিসিটিভি স্থাপনপূর্বক স্থানীয় থানার অনুমতি সাপেক্ষে আয়োজন করার নিয়ম করতে হবে।

আমার মতামত
রাজনৈতিক সভাকেও এভাবে সার্ভেলেন্সের আওতায় আনা কেন অযৌক্তিক হবে? এভাবে একটা পুলিশ রাষ্ট্র কায়েম কি হবে না? ইতিহাস বলে—এর ফল কখনও ভালো হয়নি।

সুমন জাহিদের পুরো লেখাতে আমার মনে হয়েছে হেফাজতের কার্যক্রমকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি হিসাবেই দেখা হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এমন সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যা সমাধানে কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

সমস্যার স্বরূপ চিহ্নিত না করে এর সমাধানের চেষ্টা করা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের প্রথমেই কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

হেফাজতের উত্থানের পেছনের কারণ কী?
বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর শক্তি যত ক্ষয় হয়েছে, হেফাজতে ইসলামী ততো শক্তিশালী হয়েছে। এর দু’টি কারণ হতে পারে। হয় জামাতের সদস্যরা হেফাজতে আশ্রয় নিয়েছে, অথবা মানুষ ইসলামী জজবার জামাতের বিকল্প হিসেবে হেফাজতের উপর ভরসা করতে শুরু করেছে। অথবা দু’টোই। হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সকল মত ও পথের ইসলামী সংগঠনগুলোর প্ল্যাটফর্ম হতে পেরেছে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ২৫০০০ হাজারের উপর মাদরাসার লক্ষাধিক ছাত্রের বিশাল, অনুগত, মোটিভেটেড এবং একীভূত আদর্শের কর্মীবাহিনী এই প্ল্যাটফর্মের পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিতে বিএনপির ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া, জামাতের অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট স্পেসটুকু খুব সহজেই হেফাজতের হাতে চলে এসেছে। এদেশে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের কারণেই হোক বা রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা বা দুর্নীতির কারণেই হোক— ধর্মের শুদ্ধাচারের উপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। অথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে ধর্মীয় জ্ঞানে মানুষের এক্সেস বেড়েছে। এতে ধর্মচর্চা বেড়েছে বহুগুণ। এ সবই হেফাজতের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে।

হেফাজতে ইসলাম কি ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করে?
না করে না। হেফাজতে ইসলাম মূলত কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্ব করে। যেহেতু এদেশের বেশিরভাগ মসজিদের ইমাম সাহেবরা কওমি মাদরাসা থেকে পাস করেছেন, তাই আমাদের সমাজে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। ইসলাম এবং ইসলামিস্ট রাজনীতি একেবারেই এক নয়। ইসলামিস্ট রাজনীতির কনসেপ্ট খুব পুরানো নয়। সাইদ কুতুবের হাতে সূচিত হওয়া এই ধারা আবু আলা মওদুদীর হাতে এই উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করেছে। তারপরেও এই ধারা কখনোই মূল ধারা ছিল না। দেওবন্দের উলামারা ঐতিহ্যগতভাবে সরাসরি রাজনীতি থেকে দূরেই থেকেছেন। হেফাজতের এই রাজনীতিকরন স্পষ্টত প্যারাডাইম শিফট। এতে জামাতের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা হচ্ছে, এই রাজনীতিকে কাউন্টার করতে গিয়ে সেই ২০১০ সাল থেকেই হেফাজতকে রাজনৈতিকভাবেই দেখা হয়েছে। তাতে হেফাজতের মূল পরিচয়, তথা কওমি মাদরাসার যে পরিচয় তা গৌণ হয়ে পড়েছে। এটা করতে গিয়ে ইসলাম আর হেফাজতে ইসলাম এক হয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। এর ফল হয়েছে বিপজ্জনক। মানুষ হেফাজতের রাজনীতিকে ধর্ম ভাবতে শুরু করেছে। এর দায় সরকারের । আমি মনে করি হেফাজতের এই ইসলাম হয়ে যাওয়ার দায় সরকারের কৌশলীরা অস্বীকার করতে পারবেন না।

হেফাজতকে কেন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে?
হেফাজত মানে ইসলাম নয়। বরং হেফাজত দিন দিন মুসলিমদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে এটা স্বস্তিকর অনুভূতি নয়। হেফাজতের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ফ্রান্স, এর পর ভাস্কর্য, তারপর নরেন্দ্র মোদির আগমন নিয়ে রাজপথে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জানান দিয়েছে। এই তিনটি ঘটনায় ইসলামকে ব্যাবহার করা হলেও মুসলিমদের কী উপকার হয়েছে পরিষ্কার নয়। বরং এই হঠকারী কাজকে ফ্রান্স এবং ভারতে ইসলামের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়েছে। ভাস্কর্য নিয়ে তীব্র আপত্তি করা হেফাজত মাজার পূজা নিয়ে নিশ্চুপ। রাষ্ট্রের মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান যখন কাউকে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ করেন তখন তার নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। মুসলিমদের জন্য এমন শিষ্টাচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রসুলাল্লাহ (সা.) এর জীবনের অনেক ঘটনা আছে যা আমাদের জন্য উদাহরণ। এই শিষ্টাচারকে ইসলামের নামে লঙ্ঘন করা হয়েছে। তেমনিভাবে সম্পদ ধ্বংস, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্ম ইসলামের নামে করা হয়েছে। এটা ইসলামের নামের রাজনীতি, ইসলাম নয়। এর মাধ্যমে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিশর ইত্যাদি হতে পারে, রসুলের মদিনা বা উমরের ইসলামি জাহান হবে না। হবার কথাও নয়। এভাবে দেশে অসহিষ্ণু , শ্বাসরুদ্ধকর একটা হিংসার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ইসলামকে ব্যাবহার করার এই প্রচেষ্টা কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না।

তাহলে কী করণীয়?
সমস্যাটার প্রকাশ রাজনৈতিক হলেও এর গোঁড়া ধর্মে নিহিত। তাই এর সমাধানও ওখানেই। তবে এর কোনো দ্রুত সমাধান নেই। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

প্রথমত: সকল ঘরানার আলেমদের নিয়ে শূরা কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে। এই কাউন্সিল ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীকে ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিবে।

দ্বিতীয়ত: আলিয়া মাদ্রাসা এবং কওমি মাদরাসাকে ভবিষ্যতে একীভূত করে একটি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আগাতে হবে। ইংরেজ আমলে আলিয়া মাদরাসা “অমুসলিম” নিয়ন্ত্রিত ছিল। তাতেই “খারিজি” মাদরাসার জন্ম। সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। দুই মাদরাসার প্রাজ্ঞ আলেমদের নিয়ে একটি কমিটি করে এই রূপান্তরের পথ তৈরি করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত: সব স্কুল অফ জুরিস্প্রুডেন্স (শুধু হানাফি নয়) এর ফকিহদের নিয়ে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ফতোয়া বোর্ড গঠন করতে হবে। এই বিষয়ে আল আজহার বা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

চতুর্থত: এপিজমেন্টের রাজনীতি বন্ধ করে অন্যায়কে আইডিওলজি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। ইসলামের বিপরীতে সূফিবাদ বা “বাঙালিয়ানাকে” ব্যবহার করার কৌশল আত্মঘাতী। এই দেশে হাজার বছরের ইসলামী সংস্কৃতির যে মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে তাই আমাদের পরিচয়। একে অস্বীকার করে এলিয়েনেশনের পথে গিয়ে উনিফাইড সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। এই ইনক্লুশনের পথে হাঁটতে হবে।

পঞ্চমত: ছাত্রলীগকে মাদরাসার ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পথ পরিহার করতে হবে। দরবারি আলেম নয় সর্বজন গ্রহণযোগ্য আলেমদের মেইনস্ট্রিমে আনতে হবে।

ষষ্ঠত: ময়দানি ওয়াজের সংস্কৃতি বন্ধ করে মসজিদকেন্দ্রিক ধর্মশিক্ষা চালু করতে হবে। রাসুলাল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীদের জীবন থেকে শিক্ষা দেওয়ার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসলামকে গুটিকয়েক ওয়াজির হাতে বন্দী না রেখে মসজিদভিত্তিক জীবন দর্শনের শিক্ষা চালু করতে হবে।

সপ্তম: ক্রিমিনাল কার্যক্রমকে ক্রিমিনাল কার্যক্রম হিসেবে ট্রিট করতে হবে, রাজনীতি হিসেবে নয়। এই ক্ষেত্রে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা তৈরি করতে হবে।

অন্য ধর্মকে সম্মান করা, একটা প্লুরাল সমাজে বাস করা, সততা, ন্যায়বিচারেরভিত্তিতে মানবিক সমাজ গঠন করার শিক্ষা ইসলামেই আছে। সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কওমি মাদরাসার হাতে না রেখে সরকার নিজের কাঁধে নিতে হবে।

মূল কথা হেফাজত সংকটের সমাধান ইসলামেই আছে এবং এর মাধ্যমেই এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব। হেফাজতকে রাজনীতি দিয়ে নয় ইসলাম দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। তবেই ইসলাম এবং দেশের হেফাজত হবে বলে মনে করি।


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আইভরি কোস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪০

সম্পর্কিত খবর