দেশে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি

উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাসহ পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনে একাধিক পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের স্বতন্ত্র কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে এদেশের পুলিশ সদস্যরা বঞ্চিত হচ্ছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগসহ তাদের পেশাগত দক্ষতা অর্জন থেকে।

সেনাবাহিনীর ন্যায় পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেতে বা পেশা হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে বেছে নিতে কোনো প্রাক-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনও চালু হয়নি। যারা পুলিশের চাকরিতে একবার ঢুকেছেন, তাদের জন্য নিজ বাহিনীর মধ্যে তেমন কোনো উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় একদিকে যেমন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তেমনি তারা নিজেদের উচ্চশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে পারছেন না। যদিও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় সোয়া দুই লাখ অতিক্রম করেছে।

বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি যেমন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, তা শনাক্ত করতে প্রয়োজন পড়ছে তেমনই নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি। কিন্তু পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ বা জ্ঞানার্জনের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না থাকায় তারা হাতে কলমে নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। যদি কোনো প্রশিক্ষণ নিতে হয়, তাহলে যেতে হয় দেশের বাইরে। ফলে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে পিছিয়ে আছে ব্যাপকভাবে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের সাথে। আলাপকালে তিনি বলেন, যারা পেশা হিসেবে পুলিশকে বিছে নিতে চান, তাদের জন্য ক্রিমিনোলজি, সাইবার ক্রাইম ও আইন বিষয়ে বিশেষায়িত পড়ালেখার জন্য পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভীষণ জরুরি। আমি সরকারকে বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানাই।

তিনি আরও বলেন, সাইবার ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করা হলেও বাংলাদেশ পুলিশ এসব আইনের প্রয়োগ ও ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সামান্য ধারনা রাখে, যে কারণে অনেক মামলার প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব হয় বা ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদন দাখিল করার কারণে মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। অপরাধ তত্ত্ব ও ক্রিমিনাল আইনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকলে পুলিশকে এ ধরনের মামলা পরিচালনায় কোনো ধরনের বিপত্তিতে পড়তে হত না।

কথা হয়েছিল সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হকের সাথে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর জন্য একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু পুলিশের জন্য কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আমি পুলিশ প্রধান থাকার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজারবাগ পুলিশ হোডকোয়াটারে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মৌখিক অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

শহিদুল হক আরও বলেন, আমি মনেকরি বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার আওতায় মেডিকেল কলেজ, কারিগরি ও আইন অনুষদ প্রবর্তন করা হলে বাংলাদেশ পুলিশকে একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের দরবারে সহজেই প্রশংসনীয় হবে।
আধুনিক অর্থনীতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পুলিশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা না থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংকট মোকাবেলায় পুলিশকে সমস্যায় পড়তে হয়। এসব নতুন নতুন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলে পুলিশ আরও আধুনিক সেবা নিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় হাজির হতে পারতো বলে মনে করেন শহিদুল হক।

আমার মতে, দেশের অর্থনীতি রক্ষা ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পুলিশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ জানে না অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে তাদের করণীয় কী? অপরাধ দমনের বাইরে জনগণ ও দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করতে কী করা উচিত, পুলিশ সেসব বিষয়েও অনভিজ্ঞ। সেজন্য দরকার উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার উৎকর্ষ। আর এই উৎকর্ষ সাধন সম্ভব, একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে।
আমি ভারতের সরদার বল্লবভাই প্যাটেল পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিয়মিত পাঠদান করে থাকি। তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে যেভাবে উচ্চশিক্ষা প্রদান করে থাকে, তা আমাদেরও অনুসরণ করা উচিত। তা না হলে আমাদের পুলিশ বাহিনী যোগ্যতার মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়বে।

ভারতে আরও একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে এসপির উপরে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে এমন নীতি প্রবর্তন করতে পারে বলে আমি মনে করি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বঙ্গবন্ধু গবেষণা একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ড. আনোয়ারুল করিম সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলে বিভিন্ন পেশার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের একটি জনবহুল দেশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিত্যনৈমিত্তিক নতুন নতুন সংগঠিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা এবং পুলিশকে সত্যিকার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, বর্তমানে সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যদের জন্য বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য পুলিশ স্টাফ কলেজ ছাড়া বাংলাদেশে উচ্চতর পুলিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। সাম্প্রতিক কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে পড়ানো হলেও এ বিষয়ে ব্যাপক উচ্চশিক্ষা লাভের কোনো সুযোগ বাংলাদেশে নেই। তাই অবিলম্বে বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করি।

আনোয়ারুল করিম পুলিশের একটি শক্তিশালী গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উপরও গুরুত্ব দেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সহজতর হবে বলে তিনি ধারণ পোষণ করেন।

দেশে ১৮ কোটি জনগণের নিরাপত্তা প্রদানের বাইরেও পুলিশকে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়, কিন্তু উচ্চশিক্ষা, দক্ষতা ও আধুনিক জ্ঞান না থাকার করণে অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ আশানুরূপ সাফল্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয় না। সে ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।

পেশাগত উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. মো. নাজিবুর রহমান অতিসম্প্রতি বলেন, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বর্তমানে সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যদের প্রাণের দাবি। উচ্চশিক্ষার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক পুলিশ সদস্য সুযোগের অভাবে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে বঙ্গবন্ধু পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে শুধু বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরাই পড়ালেখার সুযোগ পাবে না, বরং দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ এবং ছাত্র-ছাত্রীরাও উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। এতে ভবিষ্যতে পুলিশে দক্ষ জনবল তৈরি নিশ্চিত হবে।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরাম