করোনার উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও আমাদের অর্ধলকডাউন
৮ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৪৭
বিশ্বব্যাপী করোনার তাণ্ডব এখনো চলমান। দেখতে দেখতে দ্বিতীয় বছর হয়ে গেল, অথচ করোনার তাণ্ডব যেন শেষই হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়ে করোনা এগিয়ে চলেছে নতুন শক্তি নিয়ে। সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত (৭ এপ্রিল ২০২১) করোনায় আক্রান্ত হয়েছে সর্বমোট ১৩,৩৩,৬৮,৪০৭ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে মোট ২৮,৯১,৮০৬ জন। বাংলাদেশে করোনার ভয়াল ছোবলে মোট আক্রান্ত ৬,৫৯,২৭৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে মোট ৯,৪৪৭ জনের।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ২০২১ সালে এসে ধরণ পাল্টেছে। করোনার মিউটেশন হয়েছে অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তন হয়েছে। মূলত ভাইরাসের চরিত্রই হলো সময়ের সাথে সাথ পরিবর্তিত হওয়া। সাধারণত ভাইরাস হোস্টের দেহে টিকে থাকার জন্য এই পরিবর্তন করে থাকে। এটা ভাইরাসের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট (নতুন স্ট্রেইন) যুক্তারাজ্য, আফ্রিকা, ব্রাজিল, ভারতে শনাক্তের পর বাংলাদেশেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে করোনার যুক্তারাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এর আক্রমণের ধরন, বিস্তারের প্রকৃতি, উপসর্গ অনেকটা ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন— করোনার নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট আরও বেশি বিপদজনক হতে পারে। এটি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। এক এক জনের দেহে এক এক রকম উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। সময়ের সাথে করোনা তার আজব আজব চরিত্র প্রকাশ করছে। করোনাকে নির্মূল করার জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। তবে অতি স্বল্প সময়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বিভিন্ন দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীরা বিরাট চমক দেখিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে এর সফল প্রয়োগও শুরু হয়েছে। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমদিকেই করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অনেকেই ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে।
করোনার নতুন স্ট্রেইন বিশেষজ্ঞদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। কারণ করোনার নতুন স্ট্রেইনের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। এক এক দেশের নতুন স্ট্রেইন এক এক রকম। কোন স্ট্রেইন কী আচরণ করে তা আগাম বলা যাচ্ছে না। নতুন স্ট্রেইনগুলোর ভ্যাকসিন প্রতিরোধী হওয়ার আশঙ্কা একদম উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আজব চরিত্রের এই করোনার তাণ্ডব কবে শেষ হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সবাই সেই অপেক্ষাতেই আছে।
করোনা মহামারি থেকে বাচতে মোক্ষম ও শেষ অস্ত্র হিসেবে বাংলাদেশে আবারও লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এপ্রিল ২০২১ সালের ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত, ৭ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। সর্বপ্রথম ২০২০ সালের মার্চের শেষের দিকে লকডাউনের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশ। তখনকার লকডাউনের দিনগুলো ছিল সত্যি অন্যরকম ও বিচিত্র। যদিও সরকার লকডাউন নাম নেয়নি, সাধারণ ছুটির নামে মূলত লকডাউনই দিয়েছিল সরকার। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। অকারণে বাইরে বের হওয়া মানা ছিল। পাড়া মহল্লায় অলি গলিতে ছিল বাশেঁর বেড়া যাতে অবাধে কেউ চলাফেরা করতে না পারে। লকডাউন পালনে প্রশাসন ছিল খুবই কঠোর। দীর্ঘদিনের লকডাউনে গোটা দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় মানুষ বাধ্য হয়েছিল ঘরে থাকতে। নিস্তব্ধ ছিল জনপদ। সাধারণ মানুষ কাজ কর্ম ফেলে ঘরে শুয়ে বসে থেকে অধৈর্য হয়ে গিয়েছিল। ২০২১-এ এসে আবার সেই লকডাউন। তবে এখনকার লকডাউন গতবছরের লকডাউন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেও তা সাধারণ ছুটির চেয়ে নির্বিষ। কেউ কিচ্ছু মানছে না বরং লকডাউনের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামছে, আন্দোলন করছে, ভাঙচুর করছে। রাস্তাঘাটে মানুষ ও গাড়ির ব্যাপক সমাগম। মানুষ করোনাকে এখন আগের মতো আর ভয় পাচ্ছে না। মাস্ক পরায় রয়েছে অনীহা। সামাজিক দূরত্ব মোটেও মানা হচ্ছে না। যদিও সংক্রমণ আগের চেয়ে অনেক বেশি। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে হু হু করে। সরকার চাইলেও মানুষের অনিচ্ছার কারণে কঠোর হতে পারছে না। সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে লকডাউন এখন অর্ধলকডাউনে পরিণত হয়েছে যা উপকারের চেয়ে ক্ষতি করছে বেশি। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। আমরা নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনা থেকে বাচার সুযোগ খুব কম।