Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি


৯ এপ্রিল ২০২১ ১৯:০৯

সরকারের সঠিক নেতৃত্ব আর দূরদর্শিতায় আমরা প্রথম দফায় করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করতে পেরেছি। দ্বিতীয় ধাপে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতিমধ্যে সরকার ১ সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছেন। সাধারণ মানুষের জন্য খানিকটা চ্যালেঞ্জ হলেও, সার্বিকভাবে সংক্রমণ রোধের এটাই কার্যকর উপায়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি। সংক্রামক রোগ যখন পুরো বিশ্বকে ভোগাচ্ছে, ঘুরেফিরে তখন তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সামনে আসে। ইতিমধ্যেই আমরা অসংক্রামক রোগের কারণ হিসেবে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের সাক্ষী হয়েছি। করোনাভাইরাসের মতো সংক্রামক রোগগুলোর উপসর্গগুলো যে তামাক, তথা ধূমপানের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় তার প্রমাণ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি জানিয়েছে, ধূমপায়ীরা করোনা পরবর্তী জটিলতায় ১৪ শতাংশ বেশি ভোগেন। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণার পর, দেশের তামাকবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলো গতি পেয়েছে। নানা উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে, নানা ফলাফলপ্রসূত কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। তবে দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ সরকার সাংবিধানিকভাবেই দেশের সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। আর সে কারণেই তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের হাত থেকে বাঁচতে ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে এই সরকার আইনটি সংশোধন করে এবং আরও দুই বছর পর; ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংক্রান্ত বিধিমালা পাস করে। তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-তে স্বাক্ষর করে। এখন পর্যন্ত ১৮২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। তামাকবিরোধী কর্মকাণ্ড যেহেতু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে জড়িত, তাই এটিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে করে মূলধারার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে তামাকবিরোধী কার্যক্রমকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব নানা উদ্যোগের ফলাফলও এসেছে। দেশে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ১৮.৫ শতাংশে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লাখ। গ্লোবাল ট্যোবাকো এটলাস (গ্যাটস) ২০১৭ তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতি ৩ জনের একজন তামাকপণ্য গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ধূমপায়ী প্রায় ২ কোটি, জর্দা বা গুল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ। পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৬১ হাজার শিশু। দেশে এই মুহূর্তে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত ৭০ লাখ মানুষ । দেশের প্রধানতম অসংক্রামক রোগসমূহ যেমন ক্যানসার, শ্বাসরোগ, কিডনিরোগ, হৃদরোগ; ইত্যাদির কারণে দেশের মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগ ঘটে থাকে। আর এসব রোগের জন্য মূলত দায়ী তামাক। দেশে প্রতি বছর তামাকের প্রভাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার জন। অর্থনৈতিক খরচও নেহাত কম নয়। জিডিপির ১.৪ শতাংশ চলে যায় তামাকজনিত চিকিৎসা, উৎপাদনশীলতা হারানো; ইত্যাদি কারণে। টাকার অংকে যা ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি।

এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে। পূর্ণ সফলতা পেতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের বিকল্প নেই। এর মূল কারণ হলো, সর্বশেষ আইনটি হয়েছে ২০১৫ সালে। যে কারণে গত কয়েক বছরে নানা অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করতে হলে, আইনটি সংশোধন করতে হবে এফসিটিসি’র ৬টি প্রস্তাবনার আলোকে।

প্রস্তাবনাগুলো হলো—

১. ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
২. তামাকজাত পণ্য বিক্রয়স্থলে দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. খুচরা সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
৫. সি-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি)-এর মতো ক্রমশ বিস্তার লাভ করা পণ্যসমূহের আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৬. সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধিসহ তামাকপণ্য মোড়কজাতকরণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।

প্রস্তাবনাগুলোর প্রায় সবই সরাসরি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র, রেস্টুরেন্ট; ইত্যাদি স্থানে ধূমপান করা যাবে না। আইনের ধারাবাহিকতায়, এসব স্থানে ইতিমধ্যে ১০-৩০ শতাংশ ধূমপান কমানো গেছে। এই উন্নতিতে খুব একটা খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। হাসপাতালের অভ্যন্তরে ধূমপান বন্ধ হলেও, এর আঙ্গিনায় ধূমপান বন্ধ করা যায়নি। এসব স্থানে তামাকপণ্যের বিক্রিও হচ্ছে হরহামেশা। একই অবস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি এলাকায়। এছাড়াও, এখন রেস্টুরেন্টসহ নানান স্থানে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (Designated smoking area) করা হচ্ছে, যা প্রত্যক্ষ ধূমপানকে আরও বেশি উৎসাহিত করছে এবং পরোক্ষ ধূমপান বৃদ্ধি করছে। আমাদের এগুলো বন্ধে কঠোর হতে হবে। সংশোধিত আইনে এ ধরণের সুযোগগুলো বন্ধ করতে হবে।

বিদ্যমান আইনে তামাকপণ্যের প্রচারণা বন্ধের ব্যাপারে উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রদর্শন নয়। এর সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানি ও ব্যবসায়ীরা। আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা জরুরি। ‘তামাকপণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন বিষয়ক কমপ্লায়েন্স সার্ভে ফলাফল প্রকাশ ২০১৬’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সিগারেটে ২০.৮৮ শতাংশ, জর্দায় ৯৬.৪ শতাংশ, গুলের ক্ষেত্রে ৭৫.৮৬ শতাংশ ও বিড়িতে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই শতভাগ আইন মেনে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিশ্বব্যাপী তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পরিস্থিতি বিষয়ক ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের তামাকপণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী থাকে ৫০ শতাংশ— যা ১২৭টি দেশের মধ্যে ৭৭তম, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এটি ৮৫ শতাংশ এবং নেপালে ৯০ শতাংশ। আমাদের দেশেও এর পরিধি শতাংশ করা জরুরি।

আমরা যখন তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলি, তখন ধূমপানের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। আমাদের ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যগুলোর দিকেও মনোযোগী হতে হবে। এগুলো আলোচনায় তুলনামূলক কম গুরুত্ব পাচ্ছে। উপরে উল্লেখ করেছি, দেশে জর্দা-গুল, সাদাপাতা; ইত্যাদি ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ; যারা প্রধানত নারী। আমাদের নারীরা সার্বিকভাবে আগে থেকেই নানান স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে দিয়ে সময় পার করে। তামাকপণ্য তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিদ্যমান আইনের সব ধারা এসব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যবহার কর যায় না বলে এর ব্যবহারকারী এবং উৎপাদক; উভয়পক্ষই পার পেয়ে যাচ্ছে। নারীদের মধ্যে পান জনপ্রিয়। পান খেতে জর্দা লাগে। এই জর্দা পানের মধ্যে দিয়ে খেতে হয়। তাই চাইলেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া এসব বিক্রয় ও উৎপাদনে কোনো প্রকারের নীতিমালা না থাকায় ব্যবহারের অবাধ সুযোগ বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।

আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে কাজ করছি। এই লক্ষ্যমাত্রার ১,২ ও ৩ (দারিদ্রতা মুক্তি, ক্ষুধামুক্তি এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসুরক্ষা) প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনস্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। আর এগুলোর প্রতিটি অর্জন করতে হলে দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আর তামাক নিয়ন্ত্রণ তখনই সম্ভব হবে, যখন বিদ্যমান আইনকে আরও যুগোপযোগী করা হবে এবং তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে আমাদের হাতে আর ২০ বছর সময় আছে। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে এবং কার্যকরভাবে নিতে হবে। তবেই আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে পারব। লাখো মানুষকে অকালমৃত্যু ও রোগ থেকে বাঁচাতে পারব; অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক: সংসদ সদস্য; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ এন্ড ওয়েলবিং
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর