করোনা, রোজা এবং লাগামছাড়া পণ্যমূল্য
১৫ এপ্রিল ২০২১ ১৪:২২
গত এক বছরে সাধারণ মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। লাখো মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। যে অভাবের তাড়নায় শহর ছেড়েছেন মানুষ, সেই অভাব পিছু ছাড়েনি। বরং নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে গেছেন। আর আগে থেকে গ্রামে বাস করা মানুষেরাও একই অবস্থায় পড়েছেন। কোভিড-১৯ এক নির্মম বাস্তবতার নাম–মানুষ, মৃত্যু, অভাব এবং একই সঙ্গে জীবনের নাম।
এই চূড়ান্ত নির্মমতার মাঝে আবার এসে গেল পবিত্র রমজান মাস। প্রতিবছর রোজা এলেই বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। এবারও রোজাকে কেন্দ্র করে বেড়েছে পণ্যের দাম। বিশ্ববাজারেই পণ্যের দাম চড়া। চাল, ডাল, চিনি, গম, গুঁড়ো দুধ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেই বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ, তেলের ৩৭ শতাংশ। তারপর রোজার রীতি অনুযায়ী আবার যদি আরেক দফা দাম বাড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য সেটা হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
করোনারভাইরাসের কারণে বেকার হয়েছেন বহু মানুষ। আর চাকরি যাদের আছেও, তাদের আয়-রোজগার কমেছে। জরিপ বলছে, মহামারিতে মানুষের গড় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। ফলে বর্তমান দাম যদি স্থিতিশীলও থাকে, তারপরও সাধারণ মানুষের চলা দায় হয়ে যাবে। এর মধ্যে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না।
অথচ সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় উপলক্ষ বা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে, উৎসব ঘিরে মূল্যছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়, মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। অনেকে বছরভর এ সময়টার অপেক্ষাতেই থাকেন। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখেন তারা। ছাড় আর সেলের এই রীতি দুনিয়াজোড়া, ব্যতিক্রম মনে হয় শুধু বাংলাদেশ। এখানে উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়ে!
প্রশ্ন, রোজা এলেই কেন আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে? রোজায় পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, দুধ, তেল, আটা, মুড়ি, খেজুর, আলু, বেগুন, শসা, লেবু ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা যে বাড়ে তা তো আগে থেকেই জানা। এসব পণ্য কী পরিমাণ লাগবে, তা-ও আমাদের জানা। তাহলে কী কী দরকার, কখন দরকার আর কতটুকু দরকার–গুরুত্বপূর্ণ তিনটি তথ্যই আমাদের জানা, তারপরও কেন পণ্যের আকাল পড়ে, দাম বাড়ে?
আগেভাগেই কেন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না। নির্দিষ্ট একটি পণ্য দেশে কতটুকু আছে, কিংবা কতটুকু উৎপাদিত হয়েছে, তার হিসাব তো কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে। বাড়তি কতটুকু আমদানি করতে হবে, তা-ও নিশ্চয় তাদের জানা। এসব পণ্য কোন দেশ থেকে সুলভে আনা যাবে, তা তো আগেভাগেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জানা থাকা উচিত। সব মিলিয়ে রোজার জন্য মানসম্মত একটা বাজারব্যবস্থা তো অনেক আগেই গড়ে ওঠার কথা। প্রতিবছরই তাহলে কেন এ অনিয়ম? সরকার অবশ্য বলছে, সুলভে সাধারণ মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে এবার সরকারি বিক্রয় সংস্থা টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ৫০০ ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি হবে, পাশাপাশি ই-কমার্সেও পাওয়া যাবে। আর আমদানি মূল্যের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের ফারাক যাতে বেশি না হয়, তাও তদারক করা হবে। কিন্তু এসবই তো বিশেষ ব্যবস্থা, স্বাভাবিক কোনো পন্থা নয়।
দেশের সাধারণ মানুষেরা এমন একটি বাজারের সহজ স্বাভাবিক বাজারের প্রত্যাশা করতেই পারি, যে বাজারে কালোবাজারিদের তৎপরতা থাকবে না, ধর্মের নামে অধর্ম হবে না। মানুষ শান্তিতে অন্তত নিজের ধর্ম পালনে মনোনিবেশ করতে পারবেন।
কিন্তু না, দুষ্টচক্রের হাতে বাজারের লাগামটা থাকায় সাধারণ মানুষের বাজারের থলেটা শুধু ছোটই হচ্ছে।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক