Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহামারির অক্সিজেন বনাম গাছবিমুখ উন্নয়ন


২২ এপ্রিল ২০২১ ১৩:৩০

পাভেল পার্থ

করোনা মহামারিতে অক্সিজেনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে দুনিয়া। অক্সিজেনের অভাবে যন্ত্রণাকাতর কত প্রাণ। সিলিন্ডারের অক্সিজেনে রোগীর প্রাণ বাঁচে। অক্সিজেনের দামও মেলা। কিন্তু প্রকৃতিতে এই অক্সিজেন আমাদের জোগায় সামুদ্রিক শৈবাল, জলজ গুল্ম আর গাছেরা। প্রতি মিনিটে পূর্ণবয়ষ্ক কোনো মানুষ প্রায় ৮ লিটার বাতাস নেয়, দিনে প্রায় ১১ হাজার লিটার বাতাস দরকার মানুষের। একটি বড় গাছ প্রায় ৪ জন মানুষের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। খাদ্য কী পানি ছাড়া কিছুদিন বাঁচা যায়, কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া তিন মিনিটের বেশি সম্ভব না। বিনামূল্যে অক্সিজেনের এই জোগানদার গাছের প্রতি কোনো বিশেষ গুরুত্ব বা উপলব্ধি কী তৈরি হয়েছে আমাদের এই করোনাকালে? আমরা কতজন নিজের অক্সিজেনের জন্য প্রয়োজনীয় গাছ বুনেছি বা কোনো গাছ রক্ষায় সোচ্চার হয়েছি? সচরাচর আমরা যে ধরণের বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়নপ্রকল্প দেখি তার প্রথম কোপ পড়ে সেখানকার গাছের ওপর। যেন গাছ সব বিনাশ করে কলকারখানা আর বৃহৎ অবকাঠামোই বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের। জোগাবে অক্সিজেন!

বিজ্ঞাপন

করোনাকালে ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস গেছে, ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস, ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস, ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস, ২২ মে প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপিত হলো। কিন্তু বৃক্ষের প্রতি কতোটা মমতার আঙুল মেলতে পেরেছি আমরা? চলতি বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘আসুন পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করি’। কীভাবে শুরু হবে এই ‘পুনরুদ্ধার’ কর্মসূচি? গাছের প্রতি ভালোবাসা তৈরির ভেতর দিয়েই এক দুরূহযাত্রা আমরা শুরু করতে পারি। ঢাকায় বলধা, রমনা, সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যোন আর কিছু সড়কপথে এখনো টিকে আছে কিছু প্রবীণ গাছ। কিন্তু তাও কাটা পড়ছে নানামুখী উন্নয়নের করাতে। করোনাকালে রেঁস্তোরা বানাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেশ কিছু গাছ কাটা হয়েছে। তার মানে আমাদের রেঁস্তোরা দরকার, গাছ নয়। ২০২০ সনের ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের এক প্রবীণ চাম্বল গাছ কাটার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কী নিদারুণ। শ্রমিকেরা জখমপ্রাপ্ত বিশাল গাছটির নিচে করাত চালাচ্ছেন, গাছের কান্ড বেয়ে নামছে অবিরল রক্তস্রোত। জানা গেল একটি ‘শৌচাগারের’ জন্য খুন হয়েছিল সেই প্রবীণ চাম্বল। এভাব চলতে থাকলে ঢাকায় আর কোনো গাছ থাকবে তো? তাহলে ঢাকার নতুন প্রজন্ম কোথায় পাবে বিনামূল্যের অক্সিজেন? আমরা কি অক্সিজেন সিলিন্ডারের কারখানা বসাবো? এটি কী বাস্তবসম্মত হতে পারে? সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের গাছ কাটা এখনো থামেনি, যখন লকডাউনে ভেতর অক্সিজেনের জন্য মরিয়া আছে ঢাকা।

বিজ্ঞাপন

২.

দুনিয়ার মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতর প্রায় ২৫ ভাগই বৃক্ষ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্কক উদ্ভিদ সণাক্তকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৯৫২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। গাছবিহীন এক মুহুর্তও আমরা কল্পনা করতে পারিনা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, প্রথা, বাণিজ্য, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, উৎসব, পার্বণ, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়, প্রশান্তি যাপিতজীবনের সব কিছুই গাছকে ঘিরে, গাছ নিয়ে। এমনকি এ জনপদের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতার সাথেও গাছ জড়িত আছে ওতপ্রোতভাবে। গাছ নিয়ে, গাছ ঘিরে রাজনৈতিক দরবার ও সংগ্রামেরও কমতি নেই। ব্রিটিশ জুলুমের বিরুদ্ধে সংগঠিত নীলবিদ্রোহ জড়িয়ে আছে নীল গাছের স্মৃতি নিয়ে। তেভাগা, নানকা, টংকসহ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনসমূহ মূলত ধান গাছকে ঘিরেই। উন্নয়ন বলপ্রয়োগ আর বিনাশী তাণ্ডব থেকে এ দেশের নিম্নবর্গ গাছেদের জান বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার । রাজার নির্দেশ অমান্য করে খর্জুর গাছ বাঁচাতে শহীদ হয়েছেন অমৃতা দেবী, সংগঠিত করেছেন ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলন। ১৯৯২-১৯৯৩ সনে রাষ্ট্রের আগ্রাসী প্রজাতির বাগানের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক শালবন বাঁচাতে অজিত রিছিল নেত্রকোণার দূর্গাপুরে সংগঠিত করেন মেনকীফান্দা আন্দোলন। গাছ নিয়ে, গাছ ঘিরে দেশের নিন্মবর্গের জীবন আখ্যান বিকশিত হলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বৃক্ষবৈচিত্র্যবিমুখ। তথাকথিত উন্নয়ন, গবেষণা আর কর্পোরেট বাজারের জিম্মায় দেশের বৃক্ষপ্রাণের সংসার অনেক আগেই তুলে দেয়া হয়েছে। কাঠের মাপ হয় ঘনফুটে। বনবিভাগের কাছে তাই ঘনফুটের মাপে ওজনে ভারি ও মজবুত বৃক্ষেরই কদর বেশি। তৃণ লতাগুল্ম কী ছত্রাক বা শ্যাওলার প্রতি রাষ্ট্র বা দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্সি কেউই ন্যায়পরায়ণতার এক বিঘত নজিরও দেখাতে পারেনি। তারপরও আছে, লড়াই করেই টিকে আছে দেশের অগণিত বৃক্ষ প্রাণ। সমতল থেকে পাহাড়, চর থেকে অরণ্য, গড় থেকে বরেন্দ্র, দ্বীপ থেকে জলাভূমি।

৩.

গাছ গ্রাম-বাংলার সকল সমাজে, সকল ধর্মে ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রিয় আরাধনার বিষয়। সুন্দরবন অঞ্চলে বাগদীদের ভেতর প্রচলিত ‘নাপিতের ছেলে-রাজার ছেলে ও রাজকন্যা’ কাহিনিতে দেখা যায় বিষফল নামের এক গাছের ফল ফিরিয়ে দেয় মৃতের জীবন। গন্ধম ফলের কাহিনি দেশের মুসলিম সমাজ ছাড়িয়ে অপরাপর সমাজেও এক গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানে পরিণত হয়েছে। আদিবাসী মান্দিপুরাণ মতে, দেবতা বাগবা-বরম্বির তলপেট থেকে জন্ম নিয়েছে গাছ। সাঁওতাল কাহিনিমতে, দুনিয়ার প্রথম মানুষ পিলচু হরম ও পিলচু বুড়ির সাথে পয়লা সখ্যতা হয় আদিবৃক্ষপ্রাণের। ত্রিপুরা আদিবাসীদের জন্মকাহিনির সাথে জড়িয়ে আছে ছাতিয়ান গাছ, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মানতে ঘরের কাছে এ গাছ লাগানো হয়। অনেক জাতির গোত্রপ্রতীক গাছ, যা তারা কখনো কাটে না। সাঁওতালদের হেমব্রম গোত্রের প্রতীক সুপারী গাছ ও মারান্ডীদের দুর্বা। আদি ধর্মপালনকারী জেন্টিল খাসি ও জৈন্তিয়াদের সুরং গোত্র রম্বুই গাছ কখনো কাটে না, এটি তাদের সামাজিক নিষেধাজ্ঞা। হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে নবরত্নের অন্যতম রূপ কল্পবৃক্ষ, বৃক্ষ পূজিত হয় সর্বব্যাপি সত্তা হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্মেও বোধিবৃক্ষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক অনন্য ব্যঞ্জনা। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, “আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি উদগত করি” (সুরা কাফ, আয়াত : ৭ ও ৯)। অনর্থক বৃক্ষনিধন ও বনউজাড়কে ইসলামে গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় রাসুলে করিম (সা.) সৈন্যদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন যাতে কেউ কোনো গাছপালা ও শস্যখেত ধ্বংস না করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, “যে বরই গাছ কেটেছে তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন” (আবু দাউদ)। আদিবাসী মান্দিদের ভেতর স্বপ্নে গাছকাটা দেখাও অশুভ লক্ষণ।

৪.

এককালে দেশের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল মিষ্টিপানির জলাবন। কাগজ তৈরির মন্ড কারখানায় যার মরণ হয়েছে। বর্তমানে টিকে আছে কেবলমাত্র রাতারগুল আর লক্ষীবাওর জলাবনের কংকাল। হাওরাঞ্চলে করচ, বরুণ, হিজল, তমাল, কদম, শ্যাওড়া, বট, পাকুড়, অশ্বত্থ গাছগুলি পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে কালের ধারাবাহিকতায় হাওর-ভাটির সংস্কৃতি হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এসব গাছকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে হাওরাঞ্চলের স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও জীবনযাপনের বিস্তার। এসব গাছই হাওরবাসীর জীবনে কখনো রূপসী গাছ, হোমাই ঠাকুর, সোমেশ্বরী, কৃষ্ণ গাছ, বুড়ির গাছ, পাগল গাছ কি কালাচাঁদ ঠাকুর নামে পরিচিতি পেয়েছে। হাওর-ভাটির সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে মুসলিম সম্প্রদায় এবং হাজং-কোচ-মান্দি-বর্মণ আদিবাসীদের কাছে এসব পবিত্র বৃক্ষ ও স্থানের সম্পর্ক গভীর ও চিরন্তন। নিত্যদিনের পূজাপার্বণ থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সম্পর্কিত কৃত্যসমূহ পালিত হয় এসব গাছতলাকে ঘিরে। হাওর জনগণ যে কোনো বালামুসিবত থেকে রেহাই পেতে আশ্রয় নেয় এসব গাছের কাছে। মানত থেকে শুরু করে বাৎসরিক পার্বণ কি মেলা অনেক কিছুই আয়োজিত হয় এসব পবিত্র বৃক্ষস্থানে। মূলত চৈত্রমাসে এসব গাছতলাকে ঘিরে হাওরাঞ্চলের নানানস্থানে জমে ওঠে মেলা ও বাৎসরিক কৃত্য। ভৌগলিকভাবে এক ছোট আয়তনের দেশ হয়েও বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য এবং রকমভিন্ন প্রতিবেশ ও জটিল বাস্তুসংস্থানে ভরপুর এক অনন্য পরিসর। কিন্তু দিনে দিনে দেশের এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও পরিসর নিশ্চিহ্ন হয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করছে। এখনো সব বাঁধা সামলে আদিবাসী ও বাঙালিসহ দেশের নিম্নবর্গের মানুষজনই নিজস্ব বিশ্বাস ও লোকায়ত চর্চার ভেতর দিয়ে সংরক্ষণ করে চলেছেন অগণিত বৃক্ষ, প্রাণী, বনভূমি ও জলাভূমি। প্রতিবেশ বিজ্ঞানে এসব প্রাণ ও পরিসর ‘পবিত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত। বরেন্দ্র জনপদের ওঁরাও গ্রামের এক বৈশিষ্ট্যময় চিহ্ন হল কারাম বৃক্ষ। পবিত্র এই গাছকে কারাম পরবের ভেতর দিয়েই ওঁরাও নারী-পুরুষেরা বংশ থেকে বংশে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুন্দরবনের মুন্ডা আদিবাসীরা সুন্দরবনের সুন্দরী বৃক্ষকে পবিত্র বৃক্ষের মর্যাদা দিয়ে সোহরাই পরবে এই গাছের পাতা ব্যবহার করেন। বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসী, বেল, ফণীমনসা, দূর্বা ঘাস পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে পূজিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে খেজুর ও বড়ই গাছের এক লোকায়ত পবিত্র মাত্রা আছে। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ দেশের পবিত্র বৃক্ষ ও স্থল সংরক্ষণের আইনি ঘোষণা দিলেও রাষ্ট্র দেশের নানাপ্রান্তের পবিত্র বৃক্ষ ও স্থল সংরক্ষণে এখনো সক্রিয় হয়নি।

৫.

১৯৬৮ সনে মার্কিন জনস্বাস্থ্য পরিষেবা কর্তৃক আয়োজিত মানব প্রতিবেশ বিষয়ক সিম্পোজিয়ামে ধরিত্রী দিবসের কাজ শুরু হয়। ১৯৬৯ সনে সান ফ্রান্সিকোতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাক কর্ণেল ধরিত্রীর প্রতি সম্মান ও শান্তির লক্ষ্যে একটি দিবসের প্রস্তাব করেন। যার রেশ ধরে ১৯৭০ সনের ২১ মার্চ প্রথম ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। পরবর্তীতে মার্চের চাইতে এপ্রিল মাসকেই দিবসটির জন্য বেছে নেয়া হয় শিক্ষাছুটি ও ঋতুগত কারণে। সংরক্ষণবিদ জন ম্যুরের জন্মবার্ষিকীতে ২২ এপ্রিল পালিত হয় এ দিবস। ২০০৯ সনে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২২ এপ্রিল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃদুনিয়া’ দিবস চূড়ান্ত হয়। ১৯৯০ সনে ১৪১টি দেশ ধরিত্রী দিবস পালন করে এবং যার ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সনে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে আয়োজিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন। ২০০০ সনে ধরিত্রী দিবসের আয়োজন আরো বিস্তৃত হয় এবং বাস্তব পরিসর থেকে ভার্চুয়াল জগতেও ছড়িয়ে যায়। ঐ সময়ে যুক্ত হয় ১৮৩টি দেশ। জাতিসংঘের প্রায় ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র দিবসটি পালন করছে। ২০২১ সনের ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের প্রতিপ্রাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘আসুন পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করি’।

৬.

ধরিত্রী পুনরুদ্ধারের সবচে সহজ ও প্রাথমিক শর্তের কাজ হলো গাছের মর্ম বোঝা। গাছের পাশে দাঁড়ানো, গাছ আগলে দাঁড়ানো। বাংলাদেশ দেশের নিহত আহত ও মুমূর্ষ বৃক্ষপ্রাণের আহাজারি কবে আর শুনবে? এই করোনা মহামারীতে যদি প্রাণ-প্রকৃতির মর্ম বোঝার মতো উপলব্ধি ও মন আমাদের তৈরি না হয়- আর কবে হবে? লোকদেখানো পরিবেশ-দরদ হিসেবে কিছু জনপ্রিয় শ্লোগান আছে। ‘বেশি করে গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু গাছ লাগাতে গিয়েই বাংলাদেশের মাটি ও বাস্তুসংস্থানের আরেক সর্বনাশ ডেকে আনা হয়েছে। বহুপাক্ষিক ও বহুজাতিক ব্যাংক ও দাতাসংস্থার পরামর্শে দেশের স্থানীয় বৃক্ষবৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে একাশিয়া, সেগুন, ম্যাঞ্জিয়াম, ইউক্যালিপটাস, ইপিল ইপিলের মতো নানা আগ্রাসি গাছের আমদানি করা হয়েছে। দেশিয় ফলবৈচিত্র্যকে গায়েব করে নানা হাইব্রিড ফলের গাছে ভরিয়ে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ। এসব গাছ বাঁচাতে চলছে বহুজাতিকের রাসায়নিক বাণিজ্য। দেশের প্রাকৃতিক বনভূমি ও বাস্তুসংস্থান থেকে লাগাতার ঔষধি উদ্ভিদের বাণিজ্যিক ছিনতাই ও পাচার হয়েছে। এখনও চলছে। তথাকথিত সামাজিক বনায়নের নামে মানুষকে বৃক্ষবিমুখ করে গাছকে ‘পণ্যে’ পরিণত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশই দুনিয়ায় প্রথম ঘোষণা করেছে ‘গাছেরও প্রাণ আছে’। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কালাছড়া বনবীটের কাছে ৫নং কালাছড়া ইউনিয়নের ৫ একর জায়গার একটি গ্রাম পূজার থান আছে। এই থান আদিবাসী গৌড় ও ত্রিপুরা জাতি সংরক্ষণ করছেন। এখানে প্রবীণ বট, অশ্বত্থ গাছ আছে। এই সংরক্ষিত পবিত্রস্থলে মথুরা পাখি ও মুখপোড়া হনুমানসহ নানা প্রাণী বসবাস করে। এমনি আরেক পবিত্রস্থল শেরপুরের ঝিনাইগাতির রাংটিয়ার রাখালপূজার স্থল। বিশাল বট-পাকুড়ের কোল সংসার পেতেছে অগণিত পাখপাখালি। ঝিনাইদহের মল্লিকপুরের বৃহৎ বট বা ঠাকুরগাঁওয়ের বিশাল আম গাছ বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের প্রবীণ তেঁতুল গাছ এসব কোনোটিই কিন্তু রাষ্ট্রের বনবিভাগ বা কোনো সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ আইন ও বাজেট করে সুরক্ষা করেনি। এসব প্রবীণ বৃক্ষপ্রাণ নিন্মবর্গের সমাজ-সভ্যতার অংশ, সাথী।

রাষ্ট্রকেও এই দর্শন বুকে ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্র কেবল মানুষের নয়, গাছেরও। গাছেদের সুরক্ষাবলয় তৈরি রাষ্ট্রের মৌলিক দায় ও দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের মোড়কে কার্বন-বাণিজ্যের ছুতোকে সামনে টেনে ‘অধিক গাছ লাগানোর’ নিত্য নতুন মারদাঙ্গা করে কী লাভ? আমাদের যেসব গাছ আছে তাদের অবস্থা সম্পর্কে একটিবার জানাবোঝা জরুরি, নজর দেয়া জরুরি। শুধু শুধু গাছ লাগানোই অনিবার্য কর্মপন্থা নয়, প্রাকৃতিকভাবে গাছেদের বংশবিস্তার ও বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা দেয়াটা জরুরি। কারণ গাছ বিনা মাতৃদুনিয়া টিকবে না। সংসার, সমাজ ও সভ্যতা বিলীন হবে। বাংলাদেশের সকলপ্রান্তের গাছবৈচিত্র্য বিষয়ে রাষ্ট্রিক জনদলিল তৈরি জরুরি। দেশের লতাগুল্ম থেকে শুরু করে সকল গাছের প্রতি সমমর্যাদা ও স্বীকৃতির সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে শুরু করতেই হবে। আর এখান থেকেই জলবায়ু বিপর্যস্ত মাতৃদুনিয়ায় টিকে থাকবার শেকড়-কাণ্ড-পত্র-পুষ্প বিকশিত হবে। বায়ুদূষণের বারবার ঢাকা হয়ে ওঠছে বিশ্বের এক বিপদজনক শহর, আর এই শহরেই যদি উন্নয়নের নামে নানাভাবে গাছেদের শেষ করা হয় তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কি? কী নিয়ে দাঁড়াবে এই ঐতিহাসিক শহর? এই শহরের নাগরিক? তাই করোনাকালের ধরিত্রী দিবসে ‘পৃথিবী পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে’ আসুন সবাই অন্ততপক্ষে নিজের অক্সিজেনের জন্য বছরে কয়েকটি দেশি গাছ লাগাই, কিংবা দেশের নানাপ্রান্তে কোনো প্রবীণ গাছদের সুরক্ষায় সোচ্চার হই। গাছ বাঁচলেই, বাঁচবে মানুষ। সকলধরণের গাছবৈচিত্র্য সুরক্ষা করে কিভাবে কোনো উন্নয়নপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় তা বের করতে হবে উন্নয়নবিদদের, নগর পরিকল্পনাকারীকে। উন্নয়নচিন্তায় গাছবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি জোরালো হওয়া জরুরি। তাহলেই রমনা কী সোহরাওয়ার্দী কিংবা লাউয়াছড়া কী সুন্দরবন দেশের সবপ্রান্তেই গাছেরা হবে নিরাপদ। আর গাছ নিরাপদ হলেই আমাদের অক্সিজেনের মজুত হবে আরো সুরক্ষিত।

সারাবাংলা/এসবিডিই

গাছবিমুখউন্নয়ন টপ নিউজ পাভেল পার্থ বিশ্ব ধরিত্রী দিবস মহামারী

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

চট্টগ্রামে খালে ভাসছিল অর্ধগলিত লাশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৩

বিএসইসি‘র চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৫১

সম্পর্কিত খবর