শুধু করোনা নয়, যুদ্ধ এবার ডায়রিয়ার বিরুদ্ধেও
২৪ এপ্রিল ২০২১ ০১:০০
‘লাউকাঠি-লোহালিয়া নদী বাঁচলে পটুয়াখালী বাঁচবে’ এই স্লোগান সামনে রেখে জন সচেতনতা গড়তে ২০১৪ সালে পটুয়াখালী শহরে প্রথমবারের মত সেভ ও গ্রিন পটুয়াখালীর উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল ছিল ‘রান ফর রিভার’ শিরোনামে মিনি ম্যারাথন, যেখানে কয়েক হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তবুও বাঁচানো যাচ্ছে না লাউকাঠি-লোহালিয়াসহ দক্ষিণের খাল-নদীগুলোকে। আমরা তখন বলেছিলাম, “নদীমাতৃক দেশে নদী দূষণ করা মানে নিজ মা’কে অপবিত্র করা।” সেই ক্যাম্পেইনের মাত্র ৭ বছর পর মা’কে অপবিত্র করার একটা ক্ষুদ্র ফলাফল পেলাম- ‘ডায়রিয়া’ যা এই করোনাকালে বিপর্যস্ত করে তুলেছে উপকূলীয় জনজীবন। চলমান লকডাউনে উপকূলীয় জেলাসমূহের গণমানুষের কাছে করোনা কোন ব্যাপার না, করোনা গ্রামের মানুষের কাছে একটি শহুরে রোগ যা কেবল বড়লোকদের হয়, ভয় শুধু তাদের ডায়রিয়ায়, যার প্রকোপ এখন গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে।
আইইডিসিআর এর গবেষকরা গতকাল বৃহস্পতিবার খালের পানিতে মলের উপস্থিতি পেয়েছে। যে মলে উপস্থিত ভিব্রো কলোরি ও ইভো কোলি ভাইরাস, যার কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন তারা। জীবনে কোনদিন লাউকাঠি-লোহালিয়া নদীতে লবণাক্ততা দেখে নায় আমাদের প্রজন্ম, অনাবৃষ্টি তথা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সেটাও ঘটেছে এবার।
পটুয়াখালী জেলার সকল ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল- কোথায়ও কোন জায়গা নেই, করিডোরও ফুলফিল ডায়রিয়া রোগীতে। সামাজিক/সাংস্কৃতিক/স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহ তাদের করণীয় নির্ধারণে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তীব্র স্যালাইন সংকট ছিল গত কয়েক সপ্তাহ, আজ থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও চাহিদার তুলনায় জনবল বা স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ রোগী ঘরে বসেও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। কোভিড অতিমারির এই দুঃসময়ে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব সরকারিভাবে মহামারী হিসেবে নোটিশ করা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবতা সত্যি ভয়াবহ যা জাতীয়ভাবে এখনও কেউ টের পাচ্ছি না। কোন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মতামত ও এখন পর্যন্ত চোখে পড়ে নি।
ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় এখনই কিছু জরুরী ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।
১. অবিলম্বে প্রতিটি ইউনিয়নে, উপজেলা ও জেলা সদরে হেলথক্যাম্প তৈরি করতে হবে। স্কুল-কলেজ, কমিউনিটি সেন্টারগুলো বন্ধ থাকায় সেখানে করা যেতে পারে। করোনার ফিল্ড হাসপাতালের মত বিশেষায়িত স্থাপনার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই ভ্যান্টিলেশন, অক্সিজেন বা আইসিইউ’র; শুধু কিছু বেড ও স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করাটাই মুখ্য। ১ জন মাত্র ডাক্তার ও ২/১ জন স্বাস্থ্যকর্মীই একেকটা হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা করতে পারে।
২. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী স্বল্পতাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মী থাকলে ডায়রিয়া রোগীরা নিজ বাসায়ও চিকিৎসা নিতে পারে। তাই দ্রুত জনবল নিয়োগ দরকার। প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন পাবলিক/বেসরকারি মেডিকেলের স্টুডেন্টদের উদ্বুদ্ধ করা যায়, তারা জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা দিবে।
৩. উপকূলীয় এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রচারণা করা দরকার। নিয়মিত বৃষ্টি শুরুর আগ পর্যন্ত সকল গৃহস্থালি কাজে নদী-পুকুরের পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটেশন, গৃহস্থালি বর্জ্যব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন, হেলদি লিভিং বিষয়ক কন্টেন্ট তৈরি করে লিফলেট, ব্যানার, মাইকিং, পোস্টার, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, স্যোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক ক্যাম্পেইন করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ, স্থানীয় সামাজিক/সাংস্কৃতিক/স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের উচিত গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাম্পেইন টিম পাঠানো।
৪. বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, নিরাপদ খাদ্য, নগদ অর্থ সহায়তায় সচেতন সম্পন্ন মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে।
৫. পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ও মেইনটেনেন্সের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ টিউবয়েল অকেজো। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অতি জরুরী ভিত্তিতে কাজে নামতে হবে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে সকল প্রকার দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মধ্য/দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে:
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নদীমাতৃক জীবন ধারায় বর্জ্য/পয়োঃনিষ্কাশনের আধার হিসেবে নদী-খাল বা জলাশয়কেই উপযুক্ত মনে করা হয় আবহমানকাল ধরে। এমনকি মিউনিস্যপ্যালিটির সকল ড্রেনেজ সিস্টেমের ফাইনাল ডেসটিনেশন নদী। নদীমাতৃক সচেতন মানুষও মনে করে জৈববর্জ্য নদীতেই ফেলা উচিত, না হলে মাছেরা খাবে কি? আমজনতার ক্ষেত্রে তো জৈব-অজৈবের বালাই নেই, সকল বর্জ্য নদীতে ফেললেই স্থলজীবন পরিচ্ছন্ন থাকে বলেই মনে করে। সকল প্রকার নৌ পরিবহনের শতভাগ নদীযাত্রিক বর্জ্য নদীতেই ফেলা হয়। বিলাসবহুল লঞ্চ-জাহাজেও কোন ডাস্টবিন নেই, দু’একটিতে থাকলেও ডাস্টবিনের ময়লা নদীতে ফেলা হয়, সলিড বর্জ্য লঞ্চ থেকে কখনও মিউনিসিপালিটি নিয়েছে বলে শুনি নাই। বরিশাল বিভাগীয় শহরসহ কোন জেলা-উপজেলায় একটিও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই, আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা তো অনেক দূরের আলাপ। দক্ষিণাঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে বর্জ্যব্যবস্থাপনার জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্যানিটেশন ইনডেক্সে খুবই ভালো অবস্থায় আছে। সরকার বলছে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশনের আওতায় এসেছে। বাস্তবতা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তানের মত আমরা এখন উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করি না সত্য কিন্তু গ্রামের প্রায় শতভাগ পয়োঃবর্জ্য চলে যায় সরাসরি জলাশয়ে। পৌর এলাকায় সেফটি ট্যাংকের ব্যবহার থাকলেও অনেক পৌরগৃহের পয়ঃনিস্কাশন হয় জলাশয়ে। এনজিও নির্ভরতা নয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ বিষয়ে বাধ্যতামূলক কার্যকর ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে।
এই কয়েক দশক আগেও দক্ষিণের সকল যোগাযোগের প্রায় শতভাগ হতো জলপথে। আমাদের শৈশবে মফস্বল শহর থেকে দাদাবাড়ি/নানাবাড়ি যেতাম নৌ পথে, কোন বিকল্প ছিল না। কিন্তু এখন চাইলেও আর নৌকায় করে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই (বড় নদীতীরবর্তী বাড়ি ছাড়া)। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রধান নদীগুলো ছাড়া সকল ছোট নদী ও খালগুলো বাঁধ দেয়া হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে, ওয়াটার ওয়াপদা ছোট ছোট খালগুলোতে নির্মাণ করেছে স্লুইস গেট যা চালু হওয়ার ২/১ বছরের মাথায়ই অকেজো হয়ে যায়, কোনদিনই সংস্কার করা হয় না। প্রায় সকল জনপদ এখন ওয়াটার ওয়াপদার বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘেরা। ফলে দক্ষিণের প্রায় সকল খাল এখন মৃতপ্রায়। জোয়ার ভাটার গ্রামীণ জীবন হারিয়ে গেছে কয়েক দশক আগেই। ভরা বর্ষা ছাড়া খালের পানি গোসলেরও অনুপযুক্ত।
অধুনা যুক্ত হলো লবনাক্ততা, আগে যা শুধু খুলনা অঞ্চলে ছিল, এবছর থেকে শুরু হলো বরিশাল বিভাগেও। বাগদা চাষের জন্য বাগেরহাট থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত অনেক জীব বৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে, কঠিন হুমকির মুখে সেখানকার সাধারণ কৃষি। এই ভয়াবহতা বরিশাল বিভাগে শুরু হলে জীবন যে কত দুর্বিসহ হবে তা ভাবনায় আনাও সম্ভব নয়, কেননা এখানকার জনজীবন এখনও নদীকেন্দ্রিক। অনেক সাধনার পর বাংলাদেশ আজ উদ্বৃত্ত ফসলের দেশ, এই অভাবনীয় অর্জন কর্পূরের ন্যায় উবে যাবে যদি জলবায়ু পরিবর্তনহেতু লবনাক্ততা শুরু হয় দক্ষিণের কৃষিভূমিতে। তাই জৈববৈচিত্র ফিরিয়ে আনতে সকল খাল-নদীতে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে যার জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী প্রকৃতিবান্ধব পরিকল্পনা। অনেক প্রভাবশালী দুষ্ট লোক চরাঞ্চলে বাগদা চাষের ঘের করছে, আইন করে বাগদা চাষ নিষিদ্ধ করতে হবে।
বাড়ছে করোনা, চলছে লক ডাউন, শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান। বরিশাল বিভাগের কোন জনপদে এবারের ঈদ উৎসবে কোন উৎসাহ থাকবে না আটপৌরে গ্রামীণ জীবনে, প্রতি ঘরে ঘরে ডায়রিয়া রোগী। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করতে ক্লান্ত মানুষ। চরমনাই-শর্ষীণার হুজুরদের ঝাড় ফুঁক আর হাকডাকে করোনা যায় না, ডায়রিয়া যায় না-মানুষ বুঝে গেছে; কিন্তু মানুষ যাবে কই? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সবাই কি করোনাক্রান্ত? এখনও কোন জাতীয় উদ্যোগ শুরু হয় নি। হয়তো হবে। কিন্তু আপনি আমি যারা শহুরে আম জনতা, শিকড় যার দক্ষিণে তাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অভিজ্ঞ, মহামারী মোকাবেলায় নয়। সরকার নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে, কিন্তু আপনার আমারও দায়বদ্ধতা আছে। আপনার যাকাতের অর্থটা এবার নিজর গ্রামের ডায়রিয়া আক্রান্ত ঘরে পৌঁছে দিন, পাশে থাকুন মানুষের এই দুঃসময়ে।
লেখক: কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ