ভারতে শবের মিছিল, আমাদের কী অবস্থা?
২৬ এপ্রিল ২০২১ ১৮:১৪
ভারতজুড়ে চলছে শবের মিছিল। সারি সারি চিতা জ্বলছে। চারিদিকে আহাজারি আর মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি। একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করে মরছে মানুষ। কী নির্মম দৃশ্য! দাহ করার জন্য শ্মশানে এক টুকরো জায়গা পাচ্ছে না। দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় চাপ পড়ছে শ্মশান ও কবরস্থানগুলোর ওপর। তার অভিঘাত কি আমাদের এখানে আসতেও পারে? প্রতিবেশী দেশে যখন এ অবস্থা, তখন আমাদের কি অবস্থা? কেননা আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি সব শিকেয় তুলে উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত। ভারতের শবের মিছিলের চিত্রগুলো যখন গণমাধ্যমে দেখি, ভীষণ আঁতকে উঠি। লজ্জিতবোধ করি, অসহায়বোধ করি। শোক-সংহতি জানানো ছাড়া আমাদের সম্ভবত করার কিছু নেই। তবে ওদের এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়াটা জরুরি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩৬টি স্থলবন্দর রয়েছে। আমদানি-রপ্তানিসহ নানা কারণে মানুষ আসা-যাওয়া করছে। ভারতে যে নতুন ধরনের করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, তার ব্যাপ্তি ও তার শক্তি অনেক বেশি। সাময়িক হলেও এসব বন্দর বন্ধ রাখা প্রয়োজন ছিলো আরো আগে। ইতিমধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন ভারতফেরত ১০ করোনা রোগী। এতে করে করোনার ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সংবাদ আমাদের জন্য ভীষণ উদ্বেগের। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের ভেতরে হতাশা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমেই বলেছিলো সংক্রমণের প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দাও। আমরা তাদের কথা শুনিনি। বিমানপথে যেসব যাত্রী বাইরে থেকে এসেছেন, তাদের ঠিকমতো করা হয়নি। আইসোলেশনে রাখা হয়নি। শাহজালাল বিমানবন্দরে কিছু নিয়মকানুন মানা হলেও অন্যগুলো খুবই উদাসীন।
আমরা প্রথম ঢেউ থেকে ভালো করে শিক্ষা নিতে পারি নি। যখনই ক্রাইসিসগুলো বড় আকার ধারণ করে, সে-সময় বলা হয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। অথচ প্রস্তুতির কোনো বালাই থাকে না। করোনার শিক্ষা হচ্ছে মানবিক পৃথিবী কিংবা জনস্বাস্থ্য গুরুত্ব পাবে—এমন আশা করা হয়েছিলো। কিন্তু সেটা হয়নি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা যে শ্রেণি বা ক্ষমতাকেও অসহায় করে তোলে তা কি আমরা বুঝতে পারছি? নাকি কোনো মৃত্যুই আমাদের হৃদয়ে পৌঁছাচ্ছে না? কর্তৃপক্ষ একবছর ধরে বলছেন, আমরা কেন, আমেরিকা-ব্রিটেন-ইতালিওতো পারছে না। পারার জন্য দূরে যেতে হয় না, কাছের ভিয়েতনাম আর কেরালাকে দেখলেই হয়। কথায় কথায় আমরা যে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করি, সেটা জনযুদ্ধ হয়েছিলো কারণ, আমাদের ‘অন্তরে ডাক পাঠানো’ বা ‘জীবন জয়ে’র ডাক উঠেছিলো বলে। সে মুক্তিযুদ্ধ এখন আমাদের শাসনের অস্ত্র হয়েছে বটে, কিন্তু তার রাজনৈতিক মর্মটা শিখিনি। শিখলে এই করোনা আমরা রাজনৈতিক যুক্ততায়-প্রজ্ঞায় মোকাবেলা করতাম, আমলাতান্ত্রিক অফিস আদেশে নয়।
গত বছর করোনা পরীক্ষায় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিদায় নিতে হয়েছে, কিন্তু সিস্টেম তো বদলায়নি। এবার বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলেও অবহেলার অভিযোগ আছে। কোভিড চিকিৎসার জন্য যে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিলো, তা বিমানবন্দরে পরে থাকলো কয়েকমাস। এগুলো আনা হয়েছিলো করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। যন্ত্রপাতি যদি বিমানবন্দরেই পড়ে থাকে, তাহলে লাভ কী হলো। গত ১৩-১৪ মাসে স্বাস্থ্যসেবার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, রোগ শনাক্তকরণ ব্যবস্থা এখনই ভালনারেবল অবস্থায় আছে, এর চাইতে বেশি লোড সে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এমনিতেই আমরা অনেকগুলো ব্লান্ডার করে ফেলেছি, আরো ভুল করলে সিচুয়েশন আরো খারাপ হবে। আর তাছাড়া জনগণকে প্রস্তুত রাখতে পারি নি। সরকার স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলছে। কিন্তু তাতেই দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি কী হতে পারে, কোথায় গেলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি, এসব তাদের বোঝানো উচিত ছিলো। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ছিলো। তারা সেটা পালন করেননি।
মন আসলেই ভীষণ ছন্নছাড়া। তবু এটা বলে সংযত থাকতে পারছি নাÑকরোনাভাইরাসে পরিস্থিতির ব্যাপকতা খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনো এক অজানা-অদৃশ্য মহাবিপর্যয়ের দিকে আমরা হাঁটছি। এটা কি জেনে শুনে বিষপান করার মতো?
একবিংশ শতাব্দীর সকল জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে কোভিড-১৯ যেন মাঠে নেমেছে। তার বড় রণ-কৌশল হচ্ছে মুহূর্তেই চরিত্র বদলে ফেলা। আট হাজারবার চরিত্র বদল করেছে যে অণুজীব, তাকে ঘায়েল করা এতই সহজ? ওর সঙ্গে আমরা কতবার বদলে যেতে পারি, বা কতটা সম্ভব? মানুষ মাস্ক পরতে পারে, সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারে, ব্যবহৃত পণ্য, আসবাব ঘন ঘন জীবাণুমুক্ত করতে পারে, লকডাউন দিয়ে ঘরে সঙ্গ-নিরোধ পালন করতে পারে। কিন্তু তারও একটি সীমা আছে। কতদিন সঙ্গ-নিরোধ বা লকডাউন করে জীবন অচল করে বসে থাকবো? যদি তার চরিত্র এক থাকতো তবে, মানুষ বুঝে নিতো জীবন আচরণে কী বদল আনলে, অণুজীব দেহে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। তার চরিত্রে বড় রকমের এক দুষ্টুমি আছে। ষড়যন্ত্রও আছে বলা যায়। অণুজীব আমাদের স্মৃতি বিভ্রাট ঘটায়। অনেক আগের স্মৃতি যেমন মুছে দেয়।
চরিত্রগত জায়গায় ভারতের যে অবস্থা বাংলাদেশেও ঠিক একই। ওদের ওখানে দিনে দিনে ধর্মীয় গোঁড়ামী খুব জটিল আকার ধারণ করেছে। আমাদের এখানেও। মানুষ যখন তার শক্তি, সামর্থ্য, বুদ্ধি দিয়ে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না বা সে বিষয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভোগে তখনই ধর্মের গুরুত্ব তার কাছে বাড়তে থাকে। ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’ দুই দেশেই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে। তারা ধর্মে বেশি অন্ধভাবে আবদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশের আহলে হাদীস, আহলে সুন্নত থেকে শুরু করে প্রায় সবাই বলছে ‘ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নাই’। আব্বাসী, আব্দুর রাজ্জাক, মুফতি হামজা অন্যতম। করোনা যে একটা রোগ, সেটা মানতে রাজী নয়। অবশ্য এর সাথে রাজনীতিও রয়েছে। ফলে এরা মানুষকে মহামারী নিয়ে অসচেতন করে তুলেছিল। অন্যদিকে ভারত সম্প্রতি ‘কুম্ভমেলা’র আয়োজন করেছে। আর সরকারের বড় বড় নেতারা পানিতে ঝাপাঝাপি করে আসছে। কেউ কেউ বলছে এতে করোনা হবে না, কেউ আবার গরুর মুতে করোনার টিকা পেয়েছে। কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বাবা রামদেবের পতঞ্জলির বানানো করোনা নির্মূলের ভুয়া মেডিসিন ‘করোনিল’ নিয়ে প্রচার করেন। আর তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। কতটা গারল হলে ২০২১ সালে এসে একজন মন্ত্রী এই কাজ করেন।
ধর্ম আর বিজ্ঞান এত ভিন্ন যে, করোনা নিয়ে এদের তুলনা হাস্যকর ও চরম অজ্ঞতাপ্রসূত। যখন বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করবে না, বিজ্ঞানকে মানতে চাইবে না, তখন এধরনের দুর্গতি ডেকে আনে। নিকট-অতীতেও বিজ্ঞানকে অবজ্ঞার পরিণাম দেখেছি। এখনও দেখছি। ধর্ম আর বিজ্ঞানকে বিরোধে রেখেছে সবসময়।
আমাদের দেশে দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সরকারের ‘পলিসি মেকিং’-এ সমস্যা আছে, নিজেই ধন্দে আছে তারা, তাদের সামনে বড় একটা চ্যালেঞ্জ, জীবিকা ও অর্থনীতি, ভর্তুকী দিয়ে কী কতদিন চালাতে পারে, সমতা যে রাখতে পারবে না এটা জানা কথা। এখন কথা হচ্ছে, যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে, এটা সারাবিশ্বের জন্য একই। অথচ আমাদের শিক্ষিতশ্রেণির মধ্যে প্রথম থেকেই একটা উন্নাসিক অবস্থা দেখা গেছে। অধিকাংশ মানুষই তা মানছে না। এরা কিতাবদুরস্ত শিক্ষিত হলেও আদৌতে বিজ্ঞানমস্ক হয়ে উঠতে পারেনি। আর বাকিদের কথা নাইবা বললাম। মসজিদের ইমাম মানে না। মন্দিরের পুরোহিতরা মানে না। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ যারা বলে, তারাও মানে না। সত্যিই করোনা অতিমারি নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে যা চলছে, তাতে ‘বিজ্ঞান কিঞ্চিৎ কম পড়িয়াছে’—আমাদের দেশে যেমন, গোটা ভারতেও তেমন।
দুটো বড় ইস্যু সামনে আসছে। এক বৈজ্ঞানিক সচেতনতা আর দুই অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টন। এই দু’টি বিষয় সুদূরঅতীতের পাবলিক ডিসকোর্সের মধ্যে ক্রমাগত পিছনের সারিতে ছিল। বিজ্ঞান আন্দোলনকে জনপ্রিয় করার জন্য একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী এমন একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন যাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হবে স্বচ্ছ। একদিকে বিজ্ঞান আন্দোলন ক্রমশ শক্তিহীন হয়েছে, আর অন্যদিকে বিজ্ঞানচর্চা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্রে সীমিত থেকেছে। সাধারণের সঙ্গে বিজ্ঞান-চর্চার যে একটি ক্ষেত্র তা ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষও বিভিন্ন কুসংস্কার ও বুজরুকির ফাঁদে পড়ছেন। করোনার মতো সংকট কিংবা ভবিষ্যতে আরও নতুন কোনও মহামারীর মোকাবিলা করতে বিজ্ঞানচেতনা বাড়াবার জন্য দেশকে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। ৫০ বছর আগে সংস্কৃতির যে গাছটি বোনার কথা, সেটি বুনতে হবে এখনই!
ধরিত্রী তুমি সুস্থ হও/তুমি সুস্থ হও
ফিরে এসো তোমার তারুণ্যে—
জাগিয়ে তোলো সাম্যের প্রাণ।
লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি