সর্বভারতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজুলল হক
২৬ এপ্রিল ২০২১ ১৮:০৩
সর্বভারতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের আজ ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনে আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরিশাল শহরের আগরপুর রোডে ফ্লোরা হাউসে লালিতপালিত।
এ কে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এমএ এবং রিপন কলেজ থেকে ১৮৯৭ সালে ল’ পাস করেন। তারপর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা বিভাগ হতে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একাধিক্রমে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। এ সময় তিনি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কৃষক-প্রজার মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯২৪ সালে তিনি শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৩৭ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফজলুল হক সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ফজলুল হকের ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তি, ১৯১৭ সালের প্রেস আইন ও ১৯১৯ সালের রাউলাট আইন সমালোচনা, ১৯১৮ সালের দিল্লির মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সম্মেলন, ১৯২০ সালে মেদিনীপুর কংগ্রেস সম্মেলনে যোগদান ও ভাষণ, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি মেদিনীপুর ও নোয়াখালীতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সর্বোপরি তিনি দেশের আশি ভাগ কৃষককে রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামে টেনে আনেন। তার নেতৃত্বেই কৃষক সমাজ স্বাধীনচেতা হয়েছিল এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। তিনি ইংরেজি রাজত্বের শক্তিশালী স্তম্ভ জমিদার শ্রেণীকে পর্যুদস্ত করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যান।
ফজলুল হক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ও পথিকৃৎ। জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি জনগণের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত করা। ফজলুল হকের ধারণা ছিল, শিক্ষার মাধ্যমে অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করা সম্ভব। শিক্ষা বিস্তার সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে জাতীয়তার শক্ত ভিত তৈরি কর বলে তিনি শক্তিশালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি করেন। মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবোধ, বঞ্চনাবোধ ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের অভাববোধকে দূর করে খাঁটি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারায় হিন্দু প্রাধান্য ক্রিয়াশীল এবং মুসলমানেরা বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার। তিনি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি করে কৃষকদের বিচ্ছিন্নতাবোধ দূর করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন।
মুসলমানেরা কৃষক সমাজ থেকে উঠে আসায় এই নতুন মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। ফজলুল হক এদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার বাঙালিপ্রীতি জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ভৌগলিক ও ভাষাগত চেতনাকে শক্তিশালী করে। তিনি সারা ভারতের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও তার দৃষ্টি ছিল বাংলার দিকে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি সর্বপ্রথম বাঙালি, তারপর আমার অন্য পরিচয়।’ তিনি মুসলমানের উন্নতির জন্য চেষ্টা করলেও তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তিনি বলতেন, আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করি না। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেই আমার কাছে সমান। জীবনের সকল কাজে আমি এই আদর্শে পরিচালিত হয়েছি যে, ‘সর্বাগ্রে আমি বাঙালি, তারপর আমি মুসলমান। সাম্প্রদায়িকতাই বর্তমান ভারতীয় সমাজের গোলযোগের কারণ। সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে জাতীয়তার পথ ধরলে মানবসমাজের কল্যাণ ও মুক্তি আসবে।’
বাঙালি জাতির আদর্শ, তাদের বৈশিষ্ট্য ও চিন্তাধারা, আশা-আকাক্সক্ষা ও জীবনধারা বাস্তব রূপ নিয়েছিল ফজলুল হকের মাঝে। তার সম্পর্কে স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর। আমি কংগ্রেসিদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না। আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা। এই জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানিত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতীয়তা। ফজলুল হক ওই সমন্বয়ের প্রতীক।’
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ফজলুল হক বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ এমন একটা কিছু যা সাম্প্রদায়িকতার অনেক ঊর্ধ্বে। জাতীয়তাবাদ হচ্ছে অন্য যে কোনো চিন্তাধারার চাইতে বেশি মূল্যবান। কাজেই জাতি হচ্ছে একটি প্রশ্ন বা ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত বিরাট শক্তি। এই শক্তির বিভিন্ন অংশ মিলে একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ছোট-বড়, শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একত্রে বসবাসে স্বীকৃত। তারা একে অপরের সুখ-দুঃখ সহায়-সম্পদ সমঅংশীদার হবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে মানবতার সাধারণ স্বার্থে।’ ফজলুল হক বিশ্বাস করতেন, জাতীয়তাবাদ উন্মেষের জন্য বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ জমিদার হিন্দু। তাই মুসলিমগণ সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছে। বাংলার সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা ফজলুল হক রাজনীতিতে যে কয়েকটি ধারা প্রবর্তন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখ করতে হলে প্রথমেই বলতে হয় যে, বাংলার রাজনীতিকে জনগণের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেটা তার আগে কেউ করেননি। তিনি প্রথমবারের মতো কৃষক সমাজকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসেন। তিনি বাংলার রাজনীতিকে নবাবদের বৈঠকখানা থেকে বাংলার গ্রামেগঞ্জে নিয়ে আসেন। এতদিন মুসলমান সম্প্রদায় দেশে বিদেশী ছিলেন। শতাব্দী প্রাচীন এই মানসিকতাকে দূর করে তারা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। রাজনৈতিকভাবে এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ফজলুল হকের মাধ্যমেই হয়েছে।
ফজলুল হক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তিনি বাঙালিদের কেবল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করেই তার সংগ্রাম শেষ করেননি। তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করে বারংবার বললেন, ‘বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার যে স্বপ্ন, তা হলো একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা, যেখানে বাঙালিরা হবে সর্বকর্তৃত্বের অধিকারী, যেখানে বৈদেশিক আইনানুসারে নিয়োজিত মন্ত্রীদের দ্বারা দেশ শাসিত হবে না, বরং সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হবে, যারা জনসাধারণ ও জনমতের কাছে বাধিত থাকবেন, যারা জনগণের প্রভু হিসেবে নয়, বরং সেবক হিসেবে পরিচিত হবেন। আমার বিশ্বাস, ন্যায় ও গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে গঠিত একমাত্র সমবায়তান্ত্রিক রাষ্ট্রই এ দেশের সাম্প্রদায়িক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করবে এবং সেদিন খুব দূরে নয়।’
স্বাধীন বাংলা গড়ার পেছনে রয়েছে এ কে ফজলুল হকের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। তিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ও পথিকৃৎ। তিনি স্বাধীন বাংলার স্বাপ্নিক। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তার উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের পথ ধরে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয়, ১৯৬২, ১৯৬৪ সালের আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে পূর্ববাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় চলতে থাকে। ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের সংগ্রাম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালে।
এ কে ফজলুল হক বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেননি। সে দায়িত্ব অর্পিত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। বস্তুত শেখ মুজিব ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হকের মহান উত্তরসূরি ও তার যোগ্য মানসপুত্র। ফজলুল হক যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুঞ্জয়ী স্মৃতি জাতির জন্য প্রেরণার উৎস হতে পারে। ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, প্রশাসনের ব্যর্থতা, আমলাতন্ত্র, স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতি জাতিকে ঘিরে ফেলেছে। জাতির এ সংকটকালে ফজলুল হকের জীবন আদর্শ থেকে জাতি শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। তিনি এ দেশের রাজনীতির অগ্রপথিক। তার গণতন্ত্র ও জনগণের প্রতি আস্থা, জনগণের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতালোভী একশ্রেণীর আমলা ও সেনাবাহিনীকে হাজার বছর পথ প্রদর্শন করতে পারে। তিনি যে আদর্শের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই জাতি দুর্নীতি ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবে। দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: ইতিহাসবিদ; শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গ্রন্থের প্রণেতা