Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারতের ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে প্রচলিত গুজব ও উত্তর


২৬ এপ্রিল ২০২১ ২১:০৩

বর্তমানে বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি নিয়ে সবাই অবগত আছে। পুরো বিশ্বের সবাই এই মহামারি সম্পর্কে জানে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সবাই আতঙ্কিত। স্বাভাবিকভাবেই অনেক আলোচনা আমাদের দেশেও হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের দেশে ভারতের বর্তমান অবস্থার জন্য সেখানে পাওয়া যাওয়া ভ্যারিয়েন্টই দায়ী এমনটা বলা হচ্ছে। আতঙ্কিত হচ্ছেন অনেকেই এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে। তবে বাস্তবতা হলো স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যে কোনোভাবেই মানুষের মাঝে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। তাও বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ও গবেষণার উপরে নির্ভর করে কিছু তথ্য সবাইকে জানানো প্রয়োজন ভারতের ভ্যারিয়েন্ট বিষয়ে। এক্ষেত্রে কিছুটা গুজবও ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্নভাবে। আর সেগুলো দূর করার চেষ্টাই করবো এই লেখাতে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমত যে প্রশ্ন বা গুজবটি উঠছে তা হলো ভারতে ডাবল ও ট্রিপল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট এর কারণেই এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। আসলেই কি তা?

বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের করোনা ভাইরাস। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সহ কিছু অঞ্চলে ডাবল মিউটেন্ট (B.1.617), ট্রিপল মিউটেন্ট (B.1.617+ S:V382L) এবং B.1.618 (বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট) বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এর সাথে পুরো ভারতে ইনফেকশন ও মৃত্যুর সংখ্যা সমানুপাতিক নয় (ছবি ১, কমলা রঙ এ b.1.617/ডাবল মিউটেন্ট এবং নীল রঙ এ ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দেখানো হয়েছে)।

এই ডাবল বা ট্রিপল মিউটেন্টে একাধিক ইউমিউন এস্কেপ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাকি দেয়া মিউটেশন থাকলেও এই মিউটেশনগুলো নতুন না, এগুলো ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, আফ্রিকা, ব্রাজিল, ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যারিয়েন্টেও এক বা একাধিক দেখা গেছে।

এছাড়াও এই মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটির ইনফেকটিভিটি বা ডিজিজ সিভিয়ারিটি বা মৃত্যু হার বাড়ে কিনা এমন কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে সম্ভাবনা থাকতে পারে।

ইনডাইরেক্ট এভিডেন্স থেকে ডাবল ভ্যারিয়েন্ট এর একটি মিউটেশন শেয়ার করে এমন ভ্যারিয়েন্টে ইনফেক্টিভিটি ২০% বেশি বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য বা ইউকে ভ্যারিয়েন্টে ইনফেক্টিভিটি ৭০ শতাংশ বেশি, ডিজিজ সিভিয়ারিটিও বেশি, ভারতে এই ভ্যারিয়েন্টটাই এখনো প্রিভ্যালেন্ট। এসব কারণে ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টকে এখনো ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন না বলে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট বলা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত যে প্রশ্ন বা গুজবটি উঠছে তা হলো ভারতে ডাবল ও ট্রিপল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট এর কারণেই সেখানে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে।
আসলেই কী তা?

বিজ্ঞাপন

বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে খুব কম সময়ের মাঝে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুবরণ করছে— এ ধরণের কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত নেই। ক্লিনিক্যাল সেটআপে রোগী সিম্পটম অনসেটের কতক্ষণ পর খারাপ হলো বা মারা গেলো এবং এর সাথে ঐ নমুনায় পাওয়া ভ্যারিয়েন্টের সম্পর্ক বের করার জন্য যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ও গবেষণা প্রয়োজন সেটি এখনো হয়নি।

হাসপাতালে যেসকল চিকিৎসক কাজ করছেন তারা হাসপাতালের অংশটি দেখেন, সেখানে খারাপ রোগীরাই আসে ফলে তাদের কাছে চিত্রটি বেশি খারাপ মনে হতে পারে কিন্তু জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন কমিউনিটতে ইনফেকশন অনেক বেশি এবং এদের অধিকাংশই মৃদু লক্ষণে ভুগছেন।

প্রশ্ন হতে পারে তাহলে হঠাৎ করে আমরা ভারতে এত এত মৃত্যু দেখছি কেন?

এর উত্তর হলো সংক্রমণ বা ইনফেকশন অনেক বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর চাপ তৈরি হয়েছে, এর জন্য ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রস্তুত ছিলো না বলেই সব রোগীকে সময়মত চিকিৎসা প্রদান করা যাচ্ছেনা, তাই মৃত্যুও বেড়ে যাচ্ছে।

নতুন ভ্যারিয়েন্ট দায়ী হতে পারে তবে সেটি বলার মত এখনো কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

তৃতীয়ত যে প্রশ্ন বা গুজবটি দেখা যাচ্ছে তাতে বলা হচ্ছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট বা ট্রিপল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট ডাবল মিউটেন্ট এর চেয়েও বেশি ভয়াবহ।
আসলেই কি তা?

বাস্তবতা হচ্ছে এক্ষেত্রেও কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট ট্রিপল মিউটেন্ট নয়, এটি ভুলভাবে বলা হচ্ছে। এর সাথে সংক্রমণ সক্ষমতা বা রোগের তীব্রতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না তবে এটি পশ্চিমবঙ্গে বাড়ছে। এই ভ্যারিয়েন্টে থাকা মিউটেশনগুলোও আলাদাভাবে ইউকে, সাউথ আফ্রিকা ও অন্য কিছু ভ্যারিয়েন্টে দেখা গেছে।

চতুর্থ যে প্রশ্ন বা গুজবটি দেখা যাচ্ছে তাতে বলা হচ্ছে ভারতের এই নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করে না। বাস্তবতা হচ্ছে, সম্প্রতি ভারত একটি গবেষণায় দেখিয়েছে ভারতের নিজস্ব ভ্যাকসিন কোভ্যাক্সিন B.1.617 এর বিরুদ্ধে কার্যকরী এবং সম্প্রতি অন্য আরেকটি গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রস্তুতকৃত কোভিশিল্ড (যেটি বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে) ও এই ভ্যারিয়েন্টটির ক্ষেত্রে কার্যকরী। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে ইন্ডিয়াতে এই দুটি ভ্যাকসিন দেয়ার পরেও কেস এত বাড়ছে কেন। উত্তর হচ্ছে ইন্ডিয়ায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রাজ্য মহারাষ্ট্রে মাত্র ১০% মানুষ ভ্যাকসিন পেয়েছে। ফলে এটি কোনভাবেই কেস সংখ্যায় প্রভাব ফেলার মত যথেষ্ট না।

সুতরাং সব মিলিয়ে আমরা যেটুকু এখনো জানি বা ধারনা করতে পারি তা হলো, ভারতে সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যুও তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। এই মৃত্যু ও সংক্রমণ এর পেছনে নতুন ভ্যারিয়েন্ট কতখানি দায়ী সেটি আমরা এখনো জানিনা তবে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ ও রোগের তীব্রতা বাড়ানোর জন্য দায়ী এটি বলা যায়।

ইমিউন এস্কেপ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাকি দেবার সক্ষমতার দিক থেকে বিভিন্ন ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট তথ্যের ভিত্তিতে ধারনা করা হচ্ছে সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টেরই এই ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি এবং ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টের টা মাঝামাঝি পর্যায়ের।

আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন কম কাজ করলেও ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে এটি সম্ভবত কাজ করে বলে প্রাথমিক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে আক্রান্ত হবার পর তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি অন্য সব ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কাজ করে (ক্রস প্রটেকশন দেয়) বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশের জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সম্প্রতি আমাদের দেশে সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টটাই বেশি দ্রুত ছড়াচ্ছে, ইউকে ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও।

তাই যদি এদেশে ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্ট চলেও আসে, হয়তো আমরা কিছু প্রটেকশন পেতে পারি।
কিন্তু এই প্রটেকশন পাবার আশায় যারা আক্রান্ত হবেন এবং এদের মাঝে যারা মারা যাবেন সেই ক্ষতি পূরণ হবার নয়। তাই ভ্যারিয়েন্ট যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্য বিধি মানার কোন বিকল্প নেই।

ভারত কুম্ভমেলার গণজমায়েতের খেসারত দিচ্ছে হাজার হাজার মৃত্যু দিয়ে, আমাদেরও যেন যেন ঈদ শপিং কিংবা ঈদ জামাত কিংবা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের অনাবশ্যক গণজমায়েত এর মাধ্যমে মৃত্যু বেড়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখাই মূল কর্তব্য। একই সঙ্গে আমাদের আরও অনেক বেশি জিনোম সিকোয়েন্স করতে হবে যেন আমরা এই যুদ্ধে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে পারি।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://timesofindia.indiatimes.com/…/82203498.cms…
২) https://www.cell.com/action/showPdf…
৩) https://threadreaderapp.com/thread/1385580666629234688.html
৪) https://www.freepressjournal.in/…/10-of-the-total…
৫) https://covariants.org/per-country
৬) https://www.nationalgeographic.com/…/how-indias-second…

লেখক: চিকিৎসা জীবপ্রযুক্তিবিদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর