Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশে লকডাউন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে পারছে কি?


২৭ এপ্রিল ২০২১ ০২:৫৬

করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায়?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ করতে লকডাউন কার্যকর ব্যবস্থা কিনা তা জানার জন্য প্রথমে আমাদের খুব সংক্ষেপে হলেও জানা দরকার এই করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায়। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে যতটুকু জানতে পেরেছেন তাতে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস মূলত দুটি উপায়ে ছড়াচ্ছে।

প্রথমত- ড্রপলেটের মাধ্যমে
অর্থাৎ একজন মানুষ হাঁচি, কাশি দিলে বা উচ্চস্বরে কথা বললে তার মুখ বা নাক দিয়ে যে প্রায় অদৃশ্য জলকণা বের হয় তাকে ভর করে করোনাভাইরাস অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে থাকে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয়ত- এরোসলের মাধ্যমে
যদি কেউ হাঁচি কাশি না দেয় অথবা উচ্চস্বরে কথা নাও বলে, তবুও শুধুমাত্র শ্বাস প্রশ্বাসে নির্গত বাতাসের মাধ্যমেও করোনাভাইরাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরবর্তী ওই জায়গায় যদি কেউ নিঃশ্বাস নেন, তখন করোনাভাইরাস তার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এটাকে বলে এরোসল ট্রান্সমিশন। বিজ্ঞানীরা বলছেন বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস একই জায়গায় প্রায় ৩ থেকে ৯ ঘণ্টা থাকতে পারে। এরোসলের মাধ্যমে করোনা খোলা জায়গার চাইতে বদ্ধ জায়গায় বেশি ছড়াতে পারে। তবে এই গবেষণা নিয়ে বিতর্ক আছে, এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে লকডাউন কার্যকরী হচ্ছে না
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লকডাউন কতটা কার্যকর এই প্রশ্নটি এখন বেশ আলোচিত। নানা ধাপে লকডাউন দিয়ে আমরা কি আদৌ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পেরেছি?

ক) মানুষ যদি তার পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের মানুষের সাথে সবসময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে পারে, তাহলে ড্রপলেট বা এরোসল কোন ট্রান্সমিশনের মাধ্যমেই একজনের কাছ থেকে করোনাভাইরাস অন্যজনের কাছে পৌঁছানোর কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ তো আসলে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা কাজে পরিবারের সদস্যদের বাইরেও অন্যান্য মানুষের কাছাকাছি আসছে।

বিজ্ঞাপন

খ) আবার অনেকসময় প্রয়োজন ছাড়াও পরিবারের বাইরের সদস্যদের সাথে মিশছে এবং এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। লকডাউনের মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না, তবে মানুষের এই অবাধ মেলামেশা আটকানো গেলে সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশে যে লকডাউন হচ্ছে তার দিকে তাকাই তাহলে একাধিক কারণে এর কার্যকরীতা খুবই কম বলে আমি মনে করি। প্রথমত, এই লকডাউনের মাধ্যমে মানুষকে অভীষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে যথেষ্টভাবে প্রণোদিত করা যাচ্ছে না। এর কারণ কী হতে পারে?

১) যোগ্য লোকের সংশ্লিষ্টতার অভাব: মানুষ জানে যে তাকে নির্দেশ মানতে হবে, কিন্তু কেন মানতে হবে সে বিষয়ে তার সম্যক ধারণা নেই। প্রায় দেড় বছর পার হওয়ার পরও সাধারণ মানুষকে করোনার ভয়াবহতা এবং অপ্রয়োজনীয় সমাবেশ আড্ডা থেকে দূরে রাখতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা বলা যায়। এবং এই ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে সরকারি নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে সামাজিক ও আচরণগত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সংশ্লিষ্টতার অভাব। অর্থাৎ যারা জানেন কিভাবে আচরণকে বিশ্লেষণ করে মানুষকে সচেতন করা যায়, সরকার সেইসব বিশেষজ্ঞদের তাদের নানা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করছেন না।

২) জীবিকা জীবনের চাইতেও বড়: আরেকটি কারণ হতে পারে যে মানুষ জানে করোনাভাইরাস ভয়ংকর, কিন্তু তার দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার তাগিদ তার কাছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পরিবারের সদস্য ও নিজের জন্য প্রতিদিনের খাবার, সামনের দিনগুলো চলার পাথেয় ও সঞ্চয় এই বিষয়গুলো নিয়ে যদি মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাহলে লকডাউন দিলেও সেটা মানুষ মানবে না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে কোভিড-১৯ একটি মহামারি। পৃথিবীর সকল দেশ এতে আক্রান্ত হয়েছে। এখন প্রতিটি দেশ তার ভৌগলিক সীমারেখার ভেতর যত নিয়ম কানুন কার্যকর করুক না কেন, যদি বিদেশ থেকে মানুষের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তবে এইসব কোনো ব্যবস্থাই কার্যকর হবে না। আমরা কথায় কথায় করোনাভাইরাসের সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট বা ইন্ডিয়া ভ্যারিয়েন্টের কথা বলছি, কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট গত দেড় বছর ধরেই প্রায় নিয়মিত বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেছে। যেসব দেশ অধিক সংক্রমণের দেশ থেকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করতে পেরেছে তারা করোনা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো সাফল্য দেখিয়েছে, যেমন অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ কিন্তু দীর্ঘদিন এটি করতে পারেনি। অধিক সংক্রমণের দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয়ান দেশগুলোর ফ্লাইট নিয়মিতই আমাদের দেশে এসেছে। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে লকডাউন কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

বর্তমানে ভারত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের শিকার। বাংলাদেশের প্রায় পুরো সীমান্তই ভারতের সাথে। বৈধ অবৈধ নানা উপায়ে এই সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই মানুষ আসা যাওয়া করছেন। এটি ঠেকাতে না পারলে কোনো লকডাউনই আসলে কার্যকর হবে না।

তৃতীয়ত, অনেকেই আশা করছেন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি হলে তখন ঝুঁকি কমে যাবে অথবা লকডাউন হয়ত হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে সহায়তা করবে। দুঃখজনক হলেও সত্য— হার্ড ইমিউনিটির ধারণা সাধারণ মানুষ তো বটেই, স্বাস্থ্য খাতের মানুষের কাছেও খুব একটা পরিষ্কার নয়। খুবই সীমিত এবং নির্দিষ্ট একটি এলাকার জনগোষ্ঠী যদি কোনো রোগে সংক্রমিত হয়, তখনই শুধুমাত্র ৮০ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হলে বা ভ্যাকসিন নিলে বাকিদের আর এই রোগের ঝুঁকি থাকে না, অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয়। কিন্তু যে ভাইরাস পৃথিবীর সব দেশে সংক্রমিত হয়েছে, সেটির ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হবে না। কারণ নানা জায়গা থেকে মানুষের চলাচল অব্যাহত থাকবে। এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষ এই ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাবে।

এছাড়াও আমাদের মনে রাখা দরকার পৃথিবীর নানা দেশ গত এক বছরে নানাভাবে লকডাউন কার্যকর করে সংক্রমণ কিছুটা কমাতে পারলেও পরবর্তীতে লকডাউন তোলার পরেই সংক্রমণ আবার বেড়ে গিয়েছে। আমাদের দেশের সরকারের সেই অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই যে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখবে। সুতরাং বাংলাদেশে লকডাউনের খুব একটা কার্যকরীতা আমি দেখতে পাচ্ছি না।

তাহলে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমানোর উপায় কী?
করোনা সংক্রমণের উপায় আসলে অনেকগুলো। আমি মূল চারটি উপায়ের কথা বলি—

১) ব্যক্তিগত উদ্যোগ: একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায়। কারণ, নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব অর্থাৎ ন্যূনতম ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখলে ড্রপ্লেট (জলকণা) বা এরোসল (বায়ুবাহিত)– দুই উপায়ের সংক্রমণই ঠেকানো যায় বেশ সফলভাবে। অর্থাৎ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এছাড়াও ভালো মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যতক্ষণ সম্ভব পরে থাকতে হবে এবং সঠিকভাবে পরতে হবে।

২) গণ-ভ্যাকসিনেশন: দেশের সব মানুষকে দ্রুত ভ্যাকসিন দিতে হবে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে ভ্যাকসিন নিতে সক্ষম নন। সুতরাং এখন পর্যন্ত মূলত সমাজের ধনী, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষরাই ভ্যাকসিন পেয়েছেন। প্রান্তিক দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে ভ্যাকসিন নিয়ে যেতে হলে সরকারকে রেজিস্ট্রেশন প্রথা বাতিল করে ন্যাশনাল আইডি কার্ড অথবা ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালু করতে হবে। এই বিষয়ে বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও সাফল্য আছে, আমাদের উচিত হবে এখনই সেই পথে হাঁটা।

৩) নিরাপদ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা: লকডাউনে ধনী শ্রেণীর কাছে সরকারি প্রণোদনা না পৌঁছে দিয়ে বরং সেই টাকা দিয়ে বেশি বেশি নিরাপদ ও করোনাভাইরাস প্রতিরোধী কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। দরিদ্ররাও যাতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ও মাস্ক পরে তাদের দৈনন্দিন কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে।

লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর