ভ্যাকসিনের ওপর মিউটেশনের প্রভাব পড়লেও তা কাটানো সম্ভব
৭ মে ২০২১ ১৯:২৯
এইচআইভি ভাইরাসের প্রথম ওষুধটি আক্রান্ত রোগীকে মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এ নিয়ে চিকিৎসকদের উত্তেজনা অবশ্য কিছুদিন পরেই উবে যায়। কারণ ওষুধটি রোগীদের শরীরে মাত্র কিছুদিনের জন্য কাজ করেছিল।
দেখা গিয়েছিল, ওষুধটি ভাইরাস নিধনে খুবই কার্যকর, কিন্তু অনুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসটি ওষুধ থেকেও বেশি শক্তিশালী। ভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্য ওষুধটিকে কাজ করতে বাধা দিচ্ছিল। ওষুধ গ্রহণের পরেও ভাইরাসটি ক্রমাগত অনুলিপি তৈরি করে যাচ্ছিল। ফলে কিছুদিন পর রোগী আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও কি এমনটি ঘটার সম্ভাবনা আছে? প্রাথমিক ট্রায়ালে নিরাপদ ও কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন পরে ভাইরাসের বিবর্তনের কাছে হার মানতে পারে? বিবর্তনীয় অণুজীববিজ্ঞানীরা পোল্ট্রি ভাইরাসের উপর গবেষণা করে দেখেছেন— এগুলো দু’টি আলাদা ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাই আমরা জানি এমন ফলাফলও সম্ভব। আমাদের ধারণা, আমরা এটাও জানি কী দিয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন হয়ত ব্যর্থ হতে পারে— কিন্তু এগুলোতে যদি কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে তাহলে ব্যর্থ হবে না।
ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রতিরোধের ইতিহাস
এ ক্ষেত্রে মানবসভ্যতা ভাগ্যবান বলা চলে। কারণ মানুষের জন্য তৈরি বেশিরভাগ ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধেই বিবর্তনীয় আচরণ দেখাতে পারেনি ভাইরাস। যেমন গুটিবসন্তের ভাইরাস নির্মূল হয়েছে। এটি এখন ভয়ংকর নয়— কারণ ভাইরাসটি ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য বিবর্তিত হতে পারেনি। একইভাবে হাম ভাইরাসের ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম কোনো নতুন স্ট্রেইনের বিকাশ হয়নি।
তবে একটি ব্যতিক্রমও আছে। নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী এক ব্যাকটেরিয়া ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আরেকটি ভ্যাকসিন তৈরি ও তা সবার শরীরের প্রয়োগ করার বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল খরচ ও সময়ের দিক থেকে ব্যয়বহুল।
মানুষের জন্য তৈরি ভ্যাকসিন ব্যর্থ হয়েছে এরকম উদাহরণ খুব কম। তবে এমনটা ঘটার আশঙ্কা কিন্তু আছে। আগের উদাহরণগুলো আমাদের বলছে— ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্যারাসাইট ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ভ্যাকসিনের দ্বারা তৈরি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম এমন মিউট্যান্ট দেখা যায় হেপাটাইটিস বি ও হুপিং কাশির জন্য দায়ী জীবাণুগুলোতে।
এরকম রোগ— যেমন ম্যালেরিয়া, ট্রাইপানোসোমিয়াসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও এইডসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কাজ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ যেসব জীবাণুর কারণে এসব রোগ হয়— সেগুলোর বিবর্তনীয় ক্ষমতা খুবই বেশি। অন্য প্রাণীর জন্য তৈরি বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রায়ই ভাইরাসের বিবর্তনীয় ক্ষমতার কাছে হার মানে।
কোভিডের ক্ষেত্রে কী হতে পারে?
যদি SARS-CoV-2 কোনো ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধেও বিবর্তিত হতে পারে, তাহলে কয়েক ধরনের ফলাফল আসতে পারে। ফ্লু ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল সেটাই হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ভাইরাসের পৃষ্ঠের অণুতে যখন অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধক কোষ আবদ্ধ হয় তখন ইমিউনিটি কাজ করে। যদি ভাইরাসের পৃষ্ঠের ওই অণুগুলো মিউটেশনের কারণে পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে অ্যান্টিবডি আর সেগুলোকে আগের মতো শক্তভাবে ধরে রাখতে পারবে না। ফলে ভাইরাসটি আবার কাজ করবে। এই প্রক্রিয়ায় বুঝা যায়, সিজনাল ফ্লুর ভ্যাকসিনগুলো কেন বছর বছর হালনাগাদ করতে হয়। যদি কোভিডের ক্ষেত্রেও এটা ঘটে— তাহলে এর ভ্যাকসিনগুলোর নিয়মিত আধুনিকায়ন জরুরি।
কিন্তু ভাইরাসের বিবর্তন অন্য দিকেও মোড় নিতে পারে। এটি অবশ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি ভাইরাস বিবর্তিত হয়ে গোপনীয়তার মেজাজ ধারণ করে, তাহলে এর প্রজননের গতি হয়ত শ্লথ হয়ে যেতে পারে ও মানব শরীরের এমন কোনো অঙ্গে এটি লুকিয়ে পড়তে পারে যেখানে ইমিউনিটি কোষগুলো কম সক্রিয়। দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য দায়ী বহু জীবাণু এভাবে কোনো অঙ্গে লুকিয়ে থাকে। এগুলো তীব্র কোনো রোগের কারণ হয় না, তাই তারা শনাক্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে পারে।
তবে বিপদজনক যে মোড়টি নিতে পারে তা হলো যদি ভ্যাকসিনের তৈরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়েও দ্রুত ভাইরাসটি অনুলিপি তৈরিতে সক্ষম হয়ে উঠে। ভাইরাসের আরেকটি কৌশল হতে পারে ইমিউন সিস্টেমকে সরাসরি আক্রমণ করা ও ভ্যাকসিনের দ্বারা তৈরি প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করা।
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার দুর্দান্ত দক্ষতার কারণে অনেক অণুজীব দেহের ভেতরে বহুকাল টিকে থাকতে পারে। যদি SARS-CoV-2 -এর আংশিকও এই ক্ষমতা থাকে, তাহলে করোনার ভ্যাকসিন কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসের মিউটেশন ক্ষমতাকে চাঙা করে তুলবে।
বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিন
কোভিড আসার আগে আমরা এটি নিয়ে কাজ করেছিলাম। আমরা অণুজীবের বিবর্তনীয় ক্ষমতার কাছে হেরে যাওয়া কিছু ভ্যাকসিনের সঙ্গে কর্মক্ষম কিছু ভ্যাকসিনের তুলনা করি।
এতে দেখা যায়, বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, এগুলো ভাইরাল প্রতিরূপ দমন করতে অত্যন্ত কার্যকর। এর কারণে সংক্রমণ বিস্তার রোধ হয়। ভাইরাস কোনো প্রতিরূপ তৈরি করতে না পারলে কোনো সংক্রমণ হবে না, আর সংক্রমণ না হলে বিবর্তন হবে না।
দ্বিতীয়ত আমরা দেখেছিলাম, বিবর্তন প্রতিরোধী ভ্যাকসিন এমন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে যা ভাইরাসের কয়েকটি ভিন্ন অংশে একই সাথে আক্রমণ করে। যদি ভাইরাসের যে কোনো একটি অংশে ইমিউন সেল হামলা করে তাহলে অন্য অংশ মিউটেট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু যদি একইসাথে ভাইরাসের বিভিন্ন অংশে হামলা চালায় তাহলে ভাইরাসটিকে একই সাথে অনেকগুলো মিউটেশন প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। SARS-CoV-2 এর ক্ষেত্রে গবেষণাগারে ইতিমধ্যেই এমনটা দেখা গেছে। ভাইরাসের যে কোনো এক অংশে আঘাত করলেও ভাইরাস বিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু অ্যান্টিবডির একটি ককটেল যখন গিয়ে ভাইরাসকে হামলা করছে তখন এটি আর বিবর্তিত হতে পারছে না।
তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখেছিলাম তা হলো— বিবর্তন প্রতিরোধী ভাইরাস চলমান প্রত্যেকটি স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কাজ করে। এতে একটি স্ট্রেইনের পতন হলে অন্য কোনো স্ট্রেইন সে জায়গা নিতে পারে না।
কোভিড ভ্যাকসিন কি বিবর্তন প্রতিরোধী?
সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০টিরও বেশি কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। অনেকগুলো ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
একটি ভ্যাকসিন মানুষের শরীরের প্রয়োগের পর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেই ভ্যাকসিনটি কতটুকু কার্যকর, এটি বিবর্তন প্রতিরোধী হবে কি না ইত্যাদি জানা সম্ভব। যে কোনো ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে ভাইরাসের জিন পরীক্ষা করে ভ্যাকসিনের ভবিষ্যত জানা যায়। ভ্যাকসিন গ্রহীতার রক্ত পরীক্ষা করেও আমরা বলতে পারি ভ্যাকসিনটি ভাইরাসের কয়টি অংশ হামলা করেছে।
লেখক:
অ্যান্ড্রু রিড
অধ্যাপক, পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি
ডেভিড কেনেডি
সরকারী অধ্যাপক, জীববিজ্ঞান, পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি
ভাষান্তর: আতিকুল ইসলাম ইমন
[২০২০ সালে লেখকদ্বয় এ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। দ্য কনভারসেশন সাইট থেকে নেওয়া এ নিবন্ধটি সারাবাংলার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো। ]