গ্রাম এখনও শহরের আশ্রয়, তবে আর কতদিন?
১৫ মে ২০২১ ০১:১৮
বছরে দুই ঈদে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরসমূহ আমরা একটু ফাঁকা হতে দেখতাম। অতিমারিতে শহর প্রায় জনশূন্য দেখার নতুন অভিজ্ঞতার সনদদাতা কোভিড-১৯। দীর্ঘ কোনো ছুটিজনিত কারণ নয়, কর্তৃপক্ষের কোনো প্রশাসনিক আদেশে নয়, বাঁচার আশ্বাসে মানুষ শহর ছাড়ল। মুক্তির নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আশায় সপরিবারে ছুটল ফেলে আসা গ্রামে। তাই করোনার প্রথম ধাক্কায় ক্রমান্বয়ে ফাঁকা হয়ে যেতে দেখলাম ঢাকা শহর। খাঁ খাঁ করতে থাকল সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত। বাসা ছেড়ে দেয় ভাড়াটিয়া। দোকান গুটিয়ে ফেলে ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী। অর্থপ্রসবিনী ঢাকার বাড়ি, দোকানপাট এই প্রথম অর্থহীন মনে হলো। বকেয়া পরিশোধ বা অগ্রিম ফেরত দেওয়া নিয়ে ভাড়াটিয়া মালিকের হৃদয়হীন বাকবিতণ্ডাও দেখেছি । এমন সামাজিক টানাপড়েন নিরসনে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপও প্রয়োজন পড়েছে অনেকক্ষেত্রে।
গতবছরের শেষার্ধ থেকে করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার আপাত ইঙ্গিতে মানুষের আবার শহরমুখী হওয়ার চেষ্টা দেখেছি। নতুনভাবে শহরে থিতু হওয়ার আগেই করোনার দ্বিতীয়বারের চোখরাঙ্গানি। তাই মানুষ আবার আশ্রয় খুঁজছে গ্রামে। কেউ কেউ এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন যে— না বাবা, আর শহরে নয়। গ্রামেই থাকবো। যা পারি এখানেই কিছু একটা করবো। জীবন জীবিকা, আয় উপার্জনের প্রধান কেন্দ্র শহর হলেও শহরে আসলে অনেক কষ্ট। শহরে মশা, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া। শহরে যানজট। ধুলাধুয়া, দূষণ। শহরে ছিনতাই, প্রতারণা। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, নিষ্ঠুরতা। শহরে সড়ক দুর্ঘটনা। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। শহরের বাতাস ভারী। ভিড়ে দমবন্ধ দশা। শহরে মাঠ নেই। পার্ক নেই। শহর বাচ্চা, বুড়ো, বালিকাবান্ধব নয়। শহরে নদী খাল জলাধার ভরাটের অসুস্থ উৎসব। শহর মানে এফ আর টাওয়ারে অগ্নি। শহর মানে নিমতলি, চুড়িহাট্টা, আরমানিটোলার রাসায়নিক দহন। শহর মানে উদ্ধার সক্ষমতার খুব বেশি মই আমরা এখনো বানাতে পারিনি। শহর মানে কোভিড হাসপাতাল। রুগীতে সয়লাব। জরুরি আইসিইউ আর অক্সিজেনের সংকট। শহর মানে অ্যাম্বুলেন্সের আতংকিত ছুটোছুটি। শহর স্মরণ করিয়ে দিলো সবাইকে সেবা দেওয়ায় অক্ষম যে কোনো শহরের মতো আমারাও। অসীম আশার কথা— গ্রামের সবুজ, সূর্য, আলো-বাতাসের রক্ষাব্যুহ ভেদ করে এখনো কোনো আধুনিক মহামারি ঢুকতে পারেনি। তাই জন্মস্থান গ্রাম আমাদের বাঁচানোর আশ্বাসে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তবে গ্রাম কি আর গ্রাম আছে তেমন? অন্তরে বাহিরে গ্রামও কি বদলে যায়নি অনেকখানি? বদলে কি যাচ্ছে না প্রতিদিন অবহেলায়, স্বেচ্ছাচারিতায় আর অপরিকল্পনায়?
গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ করে পাকা রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন দিনের অর্ধেকবেলায় দেশের দূরবর্তী যে কোনো উপজেলা সদরে পৌঁছানো যায়। বিকেলের মধ্যেই পৌঁছানো যায় প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বসতবাড়িসংলগ্ন রাস্তার দুপাশে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত দোকানপাট, বাজার। বাড়ির ভাত দিয়ে সকালের নাস্তার চল প্রায় চলেই যাচ্ছে। ঘুমভাঙ্গা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সেখানে চালু হয়েছে অলস আড্ডা। অলিখিত পালাক্রমে যুক্ত থাকছে উঠতি বয়সের কিশোর থেকে যুবক, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধরা। আড্ডার অনুষঙ্গ হিসেবে চলছে পান-বিড়ি, চা- সিগারেট, পুরি, সিঙ্গারা, চিপস, নিম্নমানের কোমলপানীয়। প্রকাশ্যে গোপনে মাদক ব্যবসাও চলে। মোবাইলের এমবি খরচ করে বয়সভেদে কেউ মশগুল ইউটিউবে। তাকে ঘিরে উৎসুককানের এবং ততোধিক উৎসুকচোখের জনজটলা। উত্তেজনাকর ওয়াজ আর ব্লু সিন প্রধান উপভোগ্য। মোবাইল লুডু, তাস কিংবা ক্রিকেট খেলায় চলছে বাজি ধরা বা জুয়া। সামান্য পথ হেঁটে চলার অভ্যাসটাও হারাতে বসেছে এ প্রজন্মের গ্রামের মানুষ। চাহিবামাত্র হাজির ভ্যান, রিকশা, ইজি বাইক এবং তাতে উঠে বসছে তারা । আপনি স্বাস্থ্য সচেতনতার দোহাই দিয়ে দুকদম হাঁটলেই পাশ দিয়ে অতিক্রম করা যানবাহন থেকে টিপ্পনী— ‘কিপটেমি কইর্যা কত আর পয়সা বাঁচাবা মিয়া, জানডারে এট্টু আরাম দ্যাও, এতো পয়সা খাবে কে, নাকি মরলে সাথে নিয়া যাবা’?
গ্রামে এখন আর থাকছে না ঘর। গড়ে উঠছে বাসাবাড়ি মানে দালান। এটি গ্রামের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষণ। কাঁচাবাড়ির বাৎসরিক মেরামত করে পুষায় না। ধারদেনা করে হলেও পাকা বাড়ি করা উত্তম। বাজারে বাকিতেও মেলে রড সিমেন্ট। মোবাইলে অর্ডার দিলে চলে আসে ইট বালু। বিদেশ থেকে ছেলের পাঠানো টাকার জোরও আছে কারো কারো। প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও পাকাবাড়ি টেকসই। স্থায়িত্ব বেশি। এতে সামাজিক স্ট্যাটাসও বাড়ে। আগে ছিল প্রত্যেক ছেলের পবিবারের সদস্যদের জন্য আলাদা ঘর। এ ক্ষেত্রেও তেমনি আলাদা বিল্ডিং গড়ে তোলার চেষ্টারত সবাই। যৌথ বসবাস বা এক বিল্ডিং-এ ফ্লাটসিস্টেমে বসবাসের কালচার সেখানে গড়ে উঠছে না । এতে এক বাড়িতে শরিকদের ভিন্ন ভিন্ন বাসভবন গড়ে উঠছে। কিন্তু একের সাথে অন্যের কোনো সমন্বয় নাই। আছে পারষ্পারিক ঠেলাঠেলি আর সবার ভালোর প্রতি অবহেলা। পয়ঃনিষ্কাশনসহ সহজ প্রবেশগম্যতার বিষয় তারা বিবেচনায় আনছে না। যা ভবিষ্যতে স্থানিক জলাবদ্ধতাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাড়বে মশার ব্রিডিং সেন্টার। শহরের ব্যাধি স্থানীয়ভাবে গ্রামেও সহজ সংক্রমণ ঘটাবে। তা ছাড়া এক ভবনে একাধিক পরিবারের বসবাসের সংস্কৃতি চালু না হওয়ায় মহামূল্যবান আবাদি কৃষি জমি দ্রুত চলে যাচ্ছে অনুৎপাদন খাতে। টাকা থাকলেও চাষের জমি কি আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারবে করোনাকালে কোনো সরকার?
গ্রামের সেই চিরচেনা খোলা প্রান্তর, খেলার মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে নতুন কোনো স্থাপনা বা বাজারের পেটে। গ্রামের খেলার মাঠের বিকেলটাও আগের মতো নেই আর। খেলার মাঠকেন্দ্রিক বিভিন্ন বয়সের মানুষের বৈকালিক সমাবেশ এখন আর চোখে পড়ে না। ফুটবল, ভলিবল, হা-ডু-ড, দাড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট আর টানে না কিশোর বা যুবকদের। বিকেলের সবুজ মাঠের সোনা রোদে অনুশীলনের ঘামে ভেজে না তারুণ্য। এসব খেলা তো শুধু খেলামাত্র নয়। এতো সব বয়সের মানুষের দম ও শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইম্যুনিটির পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত। পরিবর্তে মোবাইল আসক্তি নিভৃতে কেড়ে নিচ্ছে তাদের জীবনীশক্তি।
ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর, জলাশয়। পরিবেশ চেইন বা শৃঙ্খলের অনিবার্য উপাদান মারা পড়ছে। মানুষের জীবনে এর কী মন্দ প্রভাব– কেউ এ নিয়ে ভাবছে না বা কেউ তেমন সচেতন নয়।
বাংলাদেশের পরিবেশ আইনের কোন ধারায় কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা এখনো পৌঁছেনি মানুষের কাছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন থেকেও এসবের তদারকিতে সময় ও সক্ষমতা না থাকার দোহাই দিচ্ছেন। জলাশয়ও প্রকৃতির জীবন্ত সত্তা, ভরাটের নামে তাকে হত্যা করা যাবে না —হাই কোর্টের এ বার্তা এখনও পৌঁছেনি গ্রামে। বাসযোগ্য পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র ইউনিট হচ্ছে গ্রাম। এখানেই বাস করে প্রাকৃতিক প্রাণসম্ভার। অফুরন্ত প্রাণশক্তি। মানুষসহ প্রকৃতির লক্ষ কোটি জীব অণুজীবকে বাঁচানোর প্রাকৃতিক প্রতিষেধক। যারা বেঁচে থাকে পরস্পর নির্ভরশীলতার সরল নিয়মে ও জটিল সিস্টেমের মধ্যে। আমাদের কারও কোনো কাজে সে সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমরাই, বিপদে পড়বে আমাদের আগামী প্রজন্ম-এ পাঠ গ্রামের কোনো শিক্ষালয়ে এখনও দিতে পারিনি আমরা। বৃক্ষ রোপণ নয়, কর্তনই যেন কালচারে পরিণত হচ্ছে গ্রামে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, পরিবেশ দিবস, ধরিত্রী দিবস, দুর্যোগ প্রশমন দিবস কোনো কিছুই প্রভাব ফেলছে না এখানে। কিছুতেই নেই সামষ্টিক চিন্তাচেতনার প্রতিফলন। শুধু উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি, উপঠিকাদারিতে জড়িয়ে পড়ছে গ্রামের যুবশ্রেণী। জড়াতে না পারলে চলছে নেতা উপনেতাকেন্দ্রিক ভাগ বখরার নিত্যনতুন ধান্দা। ক্ষেত্রবিশেষে নানা উছিলায় চলমান কাজে বাঁধা দিয়ে কিছু আদায় করার ফিকির।
গ্রামে এখন আর কোনো অনুকরণীয় নেতৃত্ব, অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব বা নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে মুরুব্বী সমাজের কেউ মঙ্গলকাজে তেমন আর সময় দিচ্ছেন না। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সামষ্টিক কোনো কল্যাণকাজের প্রচলন এখন আর নেই। গ্রাম পরিবর্তিত হচ্ছে গ্রাম্যতা নিয়ে। সম্মিলিত পরিকল্পনায় ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের কর্মব্রতে ন্যূনতম দেখভালের দায়িত্বে কেউ নেই। দীর্ঘদিন শহরে থেকে গ্রামে ফিরলে তাকে আর নিজেদের বলয়ে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না দলে উপদলে বহুবিভক্ত গ্রামের মানুষ। ঠারেঠোরে তাদের ভাবটা এমন যে— শুনেছি ভালোই কামাই-রোজগার করেছো, পারলে কিছু দিয়ে গ্রাম থেকে বিদায় হও। মাতবরি-সালিশির নামে গ্রামে চলছে প্রতারণার প্রাণায়াম। প্রসারিত হচ্ছে চোরাগোপ্তা আয়ের পথ। ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতাবোধের আরেক অতিমারিতে আক্রান্ত হছে মানুষ। যার খারাপ উপসর্গ সমাজদেহে দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রতিকার, প্রশমনের সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেলে আমরা চরম সংকটে পড়ে যাবো। তখন কি আর গ্রাম শহরের আশ্রয় হতে পারবে? তখন আমরা যাবো কোথায়?
তবু আশার কথা এই যে— এ পর্যন্ত তো গ্রামই শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানে গ্রাম মানে গ্রামের প্রকৃত তারকা কৃষক। ফসলযোদ্ধা কৃষক। শিল্পী সুলতানের পেশলবাহুর, প্রসারিত বুকের পোড় খাওয়া কৃষক। যাদের নিরন্তর প্রার্থনায় ফলে ফুল ফল ফসল। যাদের কণ্ঠস্বর আর অনুপ্রেরণার বাতিঘর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পিতার আশীর্বাদ বিছানো পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যাদের অবদানে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার বনেদি বসতি এখন বাংলাদেশ। যাদের কল্যাণে খাদ্য নিরাপত্তার স্বস্তিভূমি থেকেই উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে দাঁড়ানো বাংলাদেশ। যাদের ফসলের ভরা মাঠই মেগাপ্রকল্পস্বপ্নের সূতিকাগার। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’-এ স্বপ্নের সারথি কৃষকরত্নের আলো ফেলা পথেই প্রাণপ্রাচুর্যে বেঁচে থাকবে গ্রাম। আর গ্রাম বাঁচাবে শহর। কৃষকের প্রতি পক্ষপাতিত্বে আমরা যতদিন উদার থাকব, ততদিন গ্রাম হবে শহরের নিশ্চিত আশ্রয়।
লেখক: উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মহাসচিব, বিসিএস কৃষি এসোসিয়েশন