করোনার প্রাদুর্ভাবে শিক্ষার অনিশ্চিত ভবিষ্যত
১৫ মে ২০২১ ১৭:২৯
শিক্ষার্থীরা কিভাবে সংক্রমণের আশঙ্কা এড়িয়ে স্কুলে যাবে? শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন এখনও দুরস্ত। তাহলে, শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান শিক্ষার সময়টা যাতে নষ্ট না হয়—তার দিকে কি এখনো তাকাচ্ছি আমরা?
পুরো শিক্ষাবর্ষ জুড়ে অনিশ্চয়তাতেই তো আছে ছাত্রছাত্রীরা। প্রায় দেড় বছর ধরে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পৃথিবী তাদের বয়ঃসন্ধির মননকে গৃহ-আবদ্ধ অবস্থায় কোন স্তরে প্রভাবিত করল, তার খোঁজ গবেষকরা নেওয়ার সুযোগ এখনও বোধ হয় পাননি। তারপর আছে অনলাইন পড়াশোনা, সেই সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত প্রয়োজন, আর তা না থাকলে চরম অসহায় অবস্থায় পড়া। মেধার থেকে প্রয়োজনীয় হয়ে গেল প্রযুক্তি।
তাছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে ভেঙে পড়া আর্থিক অবস্থার অভিঘাতও তো তাদের উপর কম পড়ল না। বাড়ির পরিবর্তিত আর্থিক পরিস্থিতির জন্য স্কুল ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কত ছাত্রছাত্রীর। তাদের যে পাহাড়-প্রমাণ পার্থক্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, তা তারা কিভাবে করবে—ভাবতেই ভয় লাগে।
অনেকেই বলবেন, পরীক্ষা কি স্বাস্থ্য বা প্রাণের থেকে বড়? কিন্তু স্বাস্থ্যই যদি অগ্রাধিকার হয়, তাহলে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যখন বন্ধ, তখন স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের আংশিক যাওয়া বন্ধ রেখে শিক্ষকদের খুলে দেওয়া হলো কেন? যে বিপদঘণ্টা বাজল, তা তো আমরা সকলেই দেখলাম। সংক্রমিত হতে হলো বহু শিক্ষককে। কয়েকজন শিক্ষককে প্রাণ হারাতে হলো।
কমবয়সীদের নিজেদের দায়িত্ববোধের কথা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তার চেয়েও প্রাসঙ্গিক আরও অনেকের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। তার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরা কথা সম্ভবত সবচেয়ে প্রথমে আসবে। নিশ্চয়ই বিভিন্ন উদযাপন ও শপিংমলের ভিড়ের কথাও আসবে।
টেলিভিশন, অনলাইন, বেতার ও মুঠোফোনের মাধ্যমে সরকার পড়াশোনা চালু রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া চালু রাখার পরও সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। কেন যায়নি?
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন যোগ করেছে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাস। স্কুল বন্ধ। স্কুলে গিয়ে পড়ার বদলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইন শ্রেণীকক্ষের পড়ায় অংশ নিচ্ছে বিশ্বের লাখো শিক্ষার্থী। অনলাইনে ক্লাস করাচ্ছেন শিক্ষকেরা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ক্লাসে বসে পড়ার প্রাচীন ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। বিশ্বের অনেক স্থানেই এখন স্কুলের পড়াশোনা নতুন মাত্রা পেয়েছে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের পর্দায়।
এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে অংশই নিতে পারেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস পরীক্ষা আর মূল্যায়নের যে বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটি নিয়েও নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত শিক্ষাবর্ষের ক্লাস-পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন হয়েছে বিকল্প পদ্ধতিতে। তবে সেই পদ্ধতিটি একদমই সঠিক নয়, গোঁজামিল বটে। এখনও শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ পদ্ধতি নিয়ে একটা গোলকধাঁধায় রয়েছে। অনেকটা দিশেহারা আছে তারা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা অনেকেই ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছে, তারাও বলছেন যেন বহুরকম সমস্যায় তাদের পড়তে হয়েছে। একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, কোনো কিছু না বুঝলে তারা শ্রেণীকক্ষে যেভাবে শিক্ষককে প্রশ্ন করে বুঝে নিতে পারতো, সেটা অনলাইনে সম্ভব হয় না।
অনলাইন ক্লাসের বৈষম্য ও ত্রুটি রয়েছে। এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য হুমকিও হয়ে উঠেছে। উন্নত হোক বা অনুন্নত দেশ হোক, দরিদ্রতম পরিবার ইন্টারনেট সংযোগবিহীন থাকায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে। শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। আর এ বৈষম্য দিন দিন আরও বেড়ে যাবে।
বাস্তবতা হলো, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আরও অনেক দিন। অনলাইন শিক্ষাই তাই প্রকৃত বিকল্প হিসেবে চালিয়ে নিতে হবে। আর ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং ব্রডব্যান্ড সংযোগ যদি সরাসরি শিক্ষক, পাঠাগার এবং গবেষণাগারের বিকল্প হয়; তাহলে বর্তমান ব্যবস্থায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী এর কোনো সুবিধাই গ্রহণ করতে পারবে না; বিশেষত যাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ অর্থনৈতিক মন্দায় দারুণ সংকটে। সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে ইন্টারনেট সংযোগ এবং প্রযুক্তি উপকরণ সরবরাহের কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য শিক্ষার্থীর নেই ইন্টারনেট সংযোগ। এমনকি অনলাইনে পড়াশোনা করার জন্য নেই স্মার্টফোনও। সস্তা শ্রমিকের জন্য পরিচিত দেশের শ্রমজীবীদের ক্রয় ক্ষমতা নিতান্তই কম। তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাদের সন্তানদের জন্য স্মার্টফোন, দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থার মতো বিলাসবহুল শিক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা কেনা সম্ভব নয়।
সরাসরি ক্লাসরুমের যেমন বিকল্প নেই তেমনি দুর্যোগের মুহূর্তে অনলাইন ক্লাসেরও বিকল্প নেই। তবে একথাও সত্য যে শুধু অনলাইন ক্লাসকেই প্রাধান্য দিলে চলবে না, কেননা এটি হচ্ছে অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের বহু উপাদানের মধ্যে অন্যতম, একমাত্র নয়। পাশাপাশি যেসব বিষয়ে জোর দিতে হবে সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে, যেমন অডিও, ভিডিও রেকর্ডিং, স্লাইড, পিডিএফ, ওয়ার্ড ডকুমেন্ট, স্ক্যান, ইমেজ ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সকল শিক্ষার্থীর কাছে সরবরাহ করা, নিয়মিত বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া, মৌখিক প্রশ্নোত্তর, কুইজ, আলোচনা বা ভাইভা নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা এবং সর্বপরি কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে সেই সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। চলতি বছরের প্রায় ৫ মাস অতিবাহিত হলেও শিক্ষার্থীদের পাঠদান, অ্যাসাইনমেন্ট, পরীক্ষা-মূল্যায়ন কী হবে তা জানে না শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা। এমনকি এ বিষয়ে শিক্ষকরাও অন্ধকারে আছে।
যে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত, আগামী দিনে সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দায় ঘাড় তুলে নেওয়া ডাক্তারির ছাত্রছাত্রীরা আজ বাড়িতে বসে অনলাইনে ডাক্তারি শিখতে বাধ্য হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে যদি ডাক্তারি শেখা যেতো তাহলে ঘরে ঘরে ছাত্রছাত্রীরা ইউটিউব দেখেই ডাক্তার হয়ে যেতো। একই কথা খাটে প্রযুক্তিশিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রেও। আইটি, পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে পড়া লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী, যাদের কারিকুলামে ল্যাব, ওয়ার্কশপ বাধ্যতামূলক, কিন্তু তা কখনই অনলাইনের মধ্যে সম্ভব নয়, তাই তাদের, আগামীর দেশ নির্মাণের ভারপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হচ্ছে না। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও অনেক প্রয়োগমূলক বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিঃসন্দেহে পিছিয়ে পড়ছে, যা আগামী দিনে এক বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করবে।
সরকার মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করছে। কিন্তু টেলিভিশনের ক্লাস খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। এর মানে হলো প্রায় অর্ধেক ক্লাস করছে না। মাধ্যমিক স্তরে টেলিভিশনের ক্লাসের চিত্রটিও কমবেশি একই। টেলিভিশন ও বেতারে ক্লাস এককেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে শিশুরা আনন্দ পায় না। প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। এসবে ক্লাস হলেও মূল্যায়নের সুযোগ নেই। ফলে এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তবে জাতীয়ভাবে ঢাকার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্যানেল করে সার্বজনীন টেলিভিশন ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সম্বনিতভাবে এই ক্লাসগুলো দেখা ও একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে কোনো প্রশ্ন অসঙ্গতি দূর করতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের সংযোগ তৈরি করে তাদের সক্রিয় রাখতে হবে। তাহলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কেন্দ্রীভূতভাবে সহজ ও আরও আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক আর সবার সাধ্যের মধ্যে আনা যেতে পারে। আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা অতি উচ্চমানের।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করছে, তাদের যখন কর্মক্ষেত্রে ঢোকার বয়স হবে, সে সময়কার কাজ বা বৃত্তি অথবা পেশা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের হবে, যার সম্পর্কে এখন আমাদের কোনো ধারণাই নেই। ধারণা করা হচ্ছে, করোনার কারণে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কখনও স্কুলে ফিরবে না। তাছাড়া শিশুদের পুষ্টিহীনতা, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে।
এই মুহূর্তে সুস্থ থাকাই সকলের অগ্রাধিকার, সন্দেহ নেই। আমাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে বেরোতে হচ্ছে না বলে হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলছি। কিন্তু এই স্বস্তি কত দিনের? আর তার বিনিময় মূল্যই বা কী? সন্তানের ভবিষ্যৎ নয়তো? শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হবে, এটি মাথায় নিয়েই শিক্ষা উদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। যে কোনোভাবেই হোক, তাদের মানসিক স্বস্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে। শিক্ষা ভেঙে পড়লে সমাজ কি দাঁড়িয়ে থাকবে?