যে চারটি কারণে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো হবে না
১৬ মে ২০২১ ১৪:৫৯
দীর্ঘদিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি বেশ কয়েকটি কারণে আমাদের করোনা পরিস্থিতি ভারতের মতো হবে না। আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি চিন্তা করতে গেলে আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করতে হবে। মানুষের ও নীতিনির্ধারকদের আচরণগত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। শুধুমাত্র পরিসংখ্যান ও গ্রাফ-চার্ট দিয়ে করোনা ব্যাখ্যা করতে গেলে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যাবে না। আসুন সামাজিক বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় দেখি কেন বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ভারত থেকে ভিন্ন হতে পারে।
১. গ্রামীণ অর্থনীতির বৈচিত্র্যময়তা: ঢাকা থেকে যেসব শ্রমজীবী মানুষ রোজার ঈদে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান, তাদের একটা বড় অংশ সহসাই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন না। দীর্ঘদিন মঙ্গা নিয়ে গবেষণা করার সময় দেখেছি ঢাকার অনেক শ্রমজীবী মানুষ যারা রিকশা, ভ্যান চালান, শহরের রাস্তাঘাটে খুচরো জিনিসপত্র (ছাই থেকে চুড়ি) ফেরি করেন, ঝালমুড়ি, বাদাম বিক্রি করেন, ফুটপাথে কিংবা রাস্তার পাশে মুদি দোকান চালান, ঘর-বাড়িতে কাজ করেন, ক্ষুদ্র শিল্পভিত্তিক কারখানায় কাজ করেন; তারা রোজার ঈদে গ্রামে গেলে অনেক সময় কোরবানির ঈদ পর্যন্ত ঢাকায় ফেরেন না।
মধ্যবর্তী এই দুই আড়াই মাস গ্রামেগঞ্জে অনেক কাজ থাকে, ওই সময়ে জমিতে কাজ করলে অনেকক্ষেত্রেই ঢাকার চেয়ে বেশি মজুরি পাওয়া যায়। এছাড়া অনেকের গ্রামে নিজস্ব জমি থাকে, সেখানে কাজ করলে, নিজের বাড়িতে থেকেই কাজ করা যায়, ঢাকায় ভাড়া দিতে হয় না। নিজের জমি না থাকলেও অন্যের জমিতে কাজ করলে বা গ্রামে রিকশা বা ভ্যান চালালেও আয় অনেক সময় ঢাকার চেয়ে বেশি না হলেও, খরচ যেহেতু অনেক কম হয়, তাই অনেকেই পরিবারসহ এই সময়টা গ্রামেই কাটিয়ে আসতে চান। অনেকে এই সময়টা দেশে যেয়ে বিয়ে করেন, গ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন, ফলশ্রুতিতে এদের অনেকেই ঢাকায় ফিরতে একটু সময় নেবেন। ফলে সংক্রমণ কম ছড়ানোয় সেটা ভূমিকা রাখতে পারে।
২. কেন্দ্রীয় সরকার ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা: বাংলাদেশের সরকার একটি কেন্দ্র সরকার। আমেরিকা, কানাডা কিংবা ভারতের মতো আমাদের দেশে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার নেই। ভারত, আমেরিকাসহ অনেকে দেশে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির পেছনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়হীনতার। এইসব দেশের একেক রাজ্যের সরকার একেকভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মহামারিতে তারা সমন্বিতভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দেখেছি আমেরিকার নিউইয়র্কে যখন অবস্থা খুব খারাপ তখন অন্য প্রদেশ থেকে অক্সিজেন বা ভ্যান্টিলেসন সাপোর্ট যথাসময়ে পাওয়া যায়নি। কানাডার অনটারিও সরকারের আহ্বানে ট্রুডোর কেন্দ্রীয় সরকার সাড়া না দেওয়াতে প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ডগ ফোর্ডকে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছে। ভারতেও নানা রাজ্যের সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ছিল প্রকট; এমনকি দেশের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার মধ্যে বাংলায় নির্বাচন হয়েছে, জনসভা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে এক সরকার ব্যবস্থা এবং সমস্ত দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা দুর্বলতা থাকলেও সমন্বয়হীনতার তুলনামূলকভাবে কম। তাই বিভাগভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক বিপর্যয় এখানে প্রকট হবে না বলে ধারণা করি।
৩. ভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্ট শুরুর দিকেই চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সেটি পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে এমনটা মনে করছি না।
৪. ভ্যাকসিনেশনে এগিয়ে থাকা: বিশ্বের অনেক দেশ যখন ভ্যাকসিনের ব্যাপারে কোনো চুক্তিই করেনি, বাংলাদেশ তখন সারা দেশে ভ্যাকসিনেশন শুরু করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক একটি বড় জনগোষ্ঠী যারা রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারত, তারা ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং আমি ধারণা করছি এখন ভ্যাকসিনের সরবরাহ কম থাকলেও শুরুর দিকে একটি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা নেওয়ার কারণে আমাদের এখানে করোনা প্রতিরোধে বেশ কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
সার্বিকভাবে বলতে পারি ১৭ কোটি মানুষের দেশে বেশিরভাগ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে আরও বহু মাস লাগলেও, আপাত দৃষ্টিতে আমরা অন্তত ভারতের মতো বিপর্যয়ে পড়তে হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিঃসন্দেহে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোর হারই নানাধাপে বাড়বে এবং আবার পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। ততদিন পর্যন্ত যত বেশিসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেয়াও সমানভাবে জরুরি।
লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো
সারাবাংলা/আইই