গণতন্ত্রের মানসকন্যার দেশে ফেরার দিন
১৭ মে ২০২১ ২০:৫২
১৯৮১ সালের ১৭ মে। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোকবর্তিকা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ দিন ঢাকায় বয়ে যাচ্ছিল কালবৈশাখী ঝড়ো হাওয়া, বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড-ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া। তাতে কী! শেখ হাসিনা আসবেন তাই কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর- লক্ষ প্রাণ মুজিবপ্রেমীর ভিড়।
বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন।
সেদিন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার মাঝে বঙ্গবন্ধুকে খোঁজে পেতে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে নামে লাখো জনতার ঢল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেদিনের গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। আর বৃষ্টির পানি মিশে গিয়েছিল বাঙালির চোখের আনন্দ অশ্রুতে।
শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয় ছোঁয়া ভালবাসার জবাবে তিনি সেদিন বলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই’।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পরের দিন ১৮মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বিকেল সাড়ে চারটায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সকল নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হাজার হাজার মানুষ ঢুকে যায় বিমানবন্দরের ভেতরে। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই অবতরণ করে বিমানটি। একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায় আবেগ আপ্লুত জনতা। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেওয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন।
বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী স্লোগান—‘শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- মুজিব হত্যার বদলা নেব’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। জননেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন।
এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিলো সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি ও মাথা ঘোমটায় ঢাকা। কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। এ সময় ঝড় বৃষ্টিতে নগর জীবন প্রায় বিপন্ন। রাস্তাঘাটে চলাচলে স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত, তখন এখানে অপেক্ষা করে কয়েক লাখ মানুষ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর চরম এক প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় আজকের বিশ্বনন্দিত মানবতার জননী খ্যাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার বিদেশে অবস্থানকালেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেন দলটির নেতারা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তার উত্তরসূরি শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগ নেতারা তুলে দেন দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাঁথা রাজনৈতিক দলের পতাকা। এরপর থেকে আর থেমে থাকা নয়, নেতাকর্মীদের ভালবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনা বার বার নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন গণমানুষের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের।
১৯৮১ সালের ১৭মে যদি তিনি বাংলাদেশে ফিরে না আসতেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থা আজ কোথায় থাকতো, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ যেভাবে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে তারই বা উত্তরণ ঘটতো কি? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর একটাই— শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার কারণেই আজ গণতন্ত্রের মুক্তি মিলেছে, উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পথে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে তার সাহসিকতা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, দরিদ্রতা বিমোচন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে মানবিক নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি—এমন অসংখ্য দৃশ্যমান কার্যক্রম আজ মহিমান্বিত করেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও অগ্রগতির এই পথচলাকে আরও গতিশীল, মসৃণ ও কন্টকমুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলার মানুষের আস্থা, ভালবাসা ও বিশ্বাসের প্রতীক, গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য