শিক্ষার চেয়ে বিয়ে উত্তম?
২৫ মে ২০২১ ১৭:১৫
শিক্ষার্থীদের বদলে করোনাই যেন দক্ষ-শিক্ষিত হয়ে উঠছে। তার প্রাজ্ঞতায় দেশের শিক্ষা কুপোকাত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা ঝুলছে সাড়ে ৪’শ দিনের কাছাকাছি। এরমাঝেই ছেলে-মেয়ের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স কমিয়ে ১৮-তে নামানোর কথা কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো বাদ দিয়ে এখন নিশ্চিন্তে পুত্র-কন্যাদের বিয়ে দেয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে অভিভাবকদের?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে সবই চলছে। লকডাউন-শাটডাউন কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। সেটাও কেবল শিক্ষা প্রশ্নে। তারা বেতন দিচ্ছে। শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন। তাদের কারো কারো প্রমোশনও হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক উন্নয়ন কাজও চলছে। এরইমধ্যে ১২ এপ্রিল সরকারের জারি করা বিধিনিষেধ তুলে বাসসহ দূরপাল্লার যানবাহন চলছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ খুলে গেছে। এর আগে, এ বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে থাকলে ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ জারি করে। সপ্তাহখানেক পরে ১৪ এপ্রিল থেকে আরও কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয় ২১ এপ্রিল পর্যন্ত। পরে দফায় দফায় এই বিধিনিষেধ ২৮ এপ্রিল, ৫ মে, ১৬ মে ও ২৩ মে মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।
সিনেমা হল থেকে মদের বার, শেয়ারবাজার থেকে গরুবাজার সবই খোলা। বন্ধ কেবল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাঙ্গণ। শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্ববান মহল থেকে বেশ ক’বারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার ইশারা এসেছে। এরমাঝেই ক’দিন পর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরো এতো দিন বা অমুক তারিখ পর্যন্ত বন্ধের নোটিশ জারি চলছে। মাঝে মাঝে ছুটির নোটিশ দেওয়াও একটা কাজ? এর বদলে একেবারে বন্ধের নোটিশ জারি করলে আর কোনো কাজই থাকে না। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর গত ১৭ মার্চ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যা এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। মহামারির মধ্যে গতবছর পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কোনো শ্রেণিতেই বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সব শিক্ষার্থীকে অটোপাস দেয়া হয়েছে। এভাবে আর কতো?
সন্তানরা বখে যাচ্ছে। তারা কেবল শিক্ষার ছোঁয়া থেকেই মুক্তই নয়, পাচ্ছে শিক্ষকদের পরশ। ক্যাম্পাস দেখছে না, সহপাঠিদের সঙ্গ পাচ্ছে না। এগুলোও শিক্ষার অংশ। শিশু বা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত এমন দশা দেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এবারই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন প্রথম বর্ষে (নিউ ফার্স্ট ইয়ার) কোনো শিক্ষার্থী নেই। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারেনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছর অটোপাসের মাধ্যমে এইচএসসি উত্তীর্ণরা ঘরে বসা। করোনার কারণে এখনও ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সঠিক সময়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকে এসব শিক্ষার্থীর ক্লাস শুরু হয়ে যেত। করোনায় শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষয়ক্ষতির এটি সামান্য চিত্রমাত্র। এর অনিবার্য পরিনামে ব্যাপক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, বেড়েছে বাল্যবিয়ে। শহুরে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে থাকতে নানা মানসিক সংকটের মুখোমুখি। এসব নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতের ক্ষতি চোখে দেখা যায়। কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি দৃশ্যমান হতে সময় লাগছে। প্রাথমিক স্তরে পাঠগ্রহণকারী শিশুদের শিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক দিকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এই করোনায়। শহরে ফ্ল্যাটবাড়িতে বন্দি কোমলমতি শিশুরা স্কুলের আনুষ্ঠানিক পাঠগ্রহণ ও বন্ধু-সহপাঠীদের সংস্পর্শ থেকেও বঞ্চিত। রাত জেগে গেমস খেলা, অনলাইন ক্লাসে অনাগ্রহ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ঘুম কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় ভুগছে তারা।
করোনায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোও। ভাড়া বাড়িতে অল্প পুঁজি নিয়ে পথচলা এসব স্কুলের বিরাট একটি অংশ বন্ধ হয়ে গেছে। শিশু শিক্ষার্থীরা অবাক বিস্ময়ে দেখছে, যে স্কুলে লেখাপড়া করত, সেটি রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে। সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। এর অন্তত অর্ধেক করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর শিক্ষক ও স্টাফরা না খেয়ে, একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। গত বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এক দিনও ক্লাসে বসতে পারেনি। করোনায় গত বছরের এইচএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কবে নেওয়া সম্ভব হবে কেউ জানে না। এদের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে সরাসরি ক্লাস করেছে, দশম শ্রেণিতে ক্লাস পেয়েছে মাত্র আড়াই মাস। তাদের প্রিটেস্ট ও টেস্ট কোনো পরীক্ষাই হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বর্ষে দেওয়া হয়েছিল অটোপাস।
এ ধরনের পাস, ব্রেক অব স্টাডি, পরীক্ষা স্থগিত, ফলাফল বাতিল, সেশনজট ইত্যাদির সঙ্গে এদেশ একেবারে অপরিচিত নয়। তা পরাধীন পাকিস্তান জমানা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেও। এর অভিজ্ঞতাটা বড় বেদনাদায়ক। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় ডিগ্রি পরীক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। লোকে তাদের ‘পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট’ বলে বিব্রত করত। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাস এ অঞ্চলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল শরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশন পরিবর্তনের কারণে। ’৬১-তে আইয়ুব খানের মত পাল্টালে জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশনে ফিরতে তাদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয় মাস করে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক দিয়ে আবার ফিরতে হয় আগের নিয়মে। ওই সময়টায় মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষকে ‘অটোপাস’ দেওয়া হয়। বিএ, বিএসসি এবং বিকম হয়ে পরে তাদের গঞ্জনা সইতে হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরের ক্যারিকেচারও এ দেশের শিক্ষাজগতের ইতিহাসের অংশ। সত্তরের নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাও অনেক। একাত্তরের কাহিনি ঊল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বাহাত্তরের ঘটনা চরম কলঙ্কের। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অটোপাস দেওয়া হয়। একাত্তরের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা হয় বাহাত্তরে। এরই মধ্যে সৃষ্ট সেশনজট এড়ানোর জন্য ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুটি ব্যাচকে একত্রিত করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্রিডলক থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে টানা দুই যুগ। আজও অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্যের নাম বাহাত্তরের পাস। সেই কলঙ্কের পুনরাবৃতি আর না হোক।
সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি বারবার বাড়িয়ে সর্বশেষ আগামী ২৯ মে পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা কম। গত ৩ মার্চ ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আছে শুধু বাংলাদেশ। এসব দেশে এ দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। করোনার ভয়াবহতা মফস্বলে তেমন নেই। সেখানে প্রায় সব কিছুই স্বাভাবিক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যাওয়া ছাড়া অন্য সব কাজই করছে। শহরের শিক্ষার্থীরাও এখন আর ঘরে বসে নেই। শিক্ষার্থীদের পদচারণ মার্কেট, বাজার, রাস্তাঘাটসহ সব জায়গায়ই। বিয়ে-সাদি মোবারকও হচ্ছে। ভয় কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ